পরিবানু

 হামিদ মোহাম্মদ

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। সম্পাদক, সত্যবাণী।

॥এগারো॥

নানা সুলেমান গাজির ডেরায় উঠেই আমার প্লান-প্রোগ্রাম শুরু। আগেই বলেছি, আমি কলেজে ভর্তি হব। নানাও খুশি। যে রুমটি আমার থাকার ব্যবস্থা হল, সেটি আমার ছোটবেলার ঘরের মত। পড়ার টেবিল, কাপড় রাখার আলনা, আলমারি, শোবার খাট, টেবিল ল্যাম্প আরো যা যা দরকার সব কিছুই গোছালাম। নানা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে উঠেছেন এই টিনের চারচালা ঘরে। ছোটখালা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে নানা এই বাড়িতে ওঠেন। রিটায়ার্ড তিনি।

নানা আর নানি আমার বন্ধু। আমার পুত্রধন উজ্জ্বলও তাদের বন্ধু। প্রথমে একটি একাডেমী স্কুলে ভর্তি করলাম উজ্জলকে। আমার বদলে নানা সুলেমান গাজি-ই গার্জিয়ান। আমার ছেলে উজ্জলও আমার জায়গা দখল-করা সুলেমান গাজির পরিচর্যাকে গুরুত্ব দেয়, ভাল লাগে তার। জুতা-জামা পরিয়ে দেন, চুল আছড়িয়ে দেন। কাঁধেবইভর্তি রঙিন ব্যাগ ঝুলিয়ে যখন আগে আগে ছুটে, তখন সুপুরুষই লাগে। আমার নানা সুলেমান গাজিকে সে ডাকে ‘বড় বাবা’। বড় বাবাই এখন ধ্যান জ্ঞান উজ্জ্বলের। এক সপ্তাহ পর ছুটলাম শাহমীর কলেজে। সেখানে আমার বাবার বন্ধু মাহরীন চৌধুরী শিক্ষক। তিনি আমার ছোটবেলা থেকে চেনা। তার  কোলে উঠেছি কত। কলেজে ভর্তি হওয়া, তিনিই ভরসা আমার। একাদশ শ্রেণী মানবিকে ভর্তি। তিনি ছোটাছুটি করে ভর্তি কাজ সেরে দিলেন। নিয়মিত কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ছিলাম না, সেই দিকটা তিনি সামলালেন। শেষে জানলাম, তিনি আমাকে পড়িয়েছেন বলে একটি অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করেছেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

কলেজে ক্লাশ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সাংস্কৃতিক সপ্তাহ।খেলাধূলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কলেজটি কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠা বলতে রঙিন হয়ে ওঠে।জ্বল জ্বল করতে থাকে উদ্দীপনাউচ্ছলতায়নাচ, গান ও খেলাধূলার মহড়া চলে ক্লাশে ক্লাশে। আমি কোন কিছুতেই অভ্যস্ত নই। শুধু আবৃত্তিতে নাম দিলাম। কিন্তু জড়তা কাটেনি। যতই উচ্চারণ ভাল হউক জড়তার জন্য তৃতীয় হলাম। দু:খে কষ্টে একদিন বিছানায় পড়ে একটা ঘুম দিলাম।

এ সময় একটি কাণ্ড ঘটলো কলেজে। ছাত্র সংগঠনের দুটি গ্রুপে মারামারি হল ক্যাম্পাসে। সরকার সমর্থিত দলের সাথে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের। গোলাগুলি হয়েছে। কয়েকজন আহত হয়েছে। খুব বড় ঘটনা না-হলেও কলেজ থমথমে। কিন্ত ঘটনার চেয়ে বড় ঘটনা একটি ঘটে গেল। সেটি– রায়হান নামের যে ছেলেটি খুব দল বেঁধে ক্যাম্পাসে চলতো না, প্রায়ই মাঠ কোনাকুনি এক ভবন থেকে অন্য ভবনে ক্লাশে ছুটে যেতো, গলায় নচিকেতার গান লেগে থাকতো, হাত দুলিয়ে গাইতো, থমথম করতো কণ্ঠ, সে ছেলেটি থানায় গিয়ে গ্রেফতার হওয়া দুটি ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছে। এতে শেষ নয়, সে থানায় বলেছে, যারা গ্রেফতার হয়েছে, ওরা গোলাগুলি করেনি, সে নিজে করেছে, তাকে এরেস্ট করে ওদের ছেড়ে দেয়া হউক। সবাই এই ঘটনায় হতভম্ব। তার পীড়াপীড়িতে পুলিশ ছেলেদের ছেড়ে দিয়েছে। তবে, পুলিশ তাকে আর গ্রেফতার করেনি।

আমি এ ঘটনা শুনে হতবাক। মন খারাপ ছিল আবৃত্তিতে থার্ড হওয়ার কারণে, সে মন খারাপ ভুলে যাই। সে তার ক্লাশে পেছনে বসতো আর গুন গুন করতো। কেউ তেমন পাত্তা দিতো না, সে এমন জেদী মানুষ, ভাবা-ই যায় না। শুনেছি, সে গোলাগুলি করেনি, অথচ সতীর্থদের ছাড়িয়ে আনতে এমন আত্মহননমূলক ঘটনার জন্ম দেবে, এটা  আমার জীবনে প্রথম ঘটনা বা শোনা।

কেন জানি আমি অস্থির হয়ে ওঠি রায়হানকে কাছ থেকে দেখার। তাকে ক্যাম্পাসে দেখলেই ডেকে কথা বলতে চাই। কিন্তু কই? কে তাকে পায়। একদিন দুদিন। এক সপ্তাহ। একদিন তাকে খুব কাছে পেয়ে ধরি ধরি করি। সে থামতেই চায় না। ক্লাশের জন্য দৌঁড়াচ্ছে। আমার কোমল ডাক একটু ছড়া হলে সে থামলো। আমি যেন অভিভাবক, না থেমে কি পারে!  আমার কড়া সুর তার কানে ঢুকেছে। যাকে শুধু রায়হান ডাকার কথা, তাকে ‘রায়হান ভাই’ ডেকে থামাই। সে আমাদের সেকশনের ছাত্র নয়, তাই পাওয়া মুস্কিল। ক্লাশ যখন ছুটি হয়, তখন ক্লাশরুম বদলের সময় ক্রস হয়, দেখাদেখিটাও অতি সামান্য।

থামিয়ে দাঁড়ালাম সবেধন একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের সদ্য ফুল ফোটা ডালের ছায়ায়। আমি হাত ধরেই ফেললাম অজান্তে, না আবেগে, মনে নেই। সে ইতস্তত করেছে বটে। কলেজে কোন মেয়ে কোন ছেলের হাত ধরবে এমন পরিবেশ নেই। এখনো এধরণের পরিবেশ তৈরি হয়নি। সম্ভবত আমিই কোন ছেলের হাত প্রথম ধরেছি এই কলেজে। কিংবা রীতি ভেঙেছি প্রথম। খুব যে ইচ্ছে করে, তা নয়। প্রেম, তাও নয়। কাউকে ধরে আটকাতে হলে বোধ হয় এমন ঘটে। তখন আমার শরীর তির তির করে কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল, জানি না।

রায়হানকে হাত ধরে আটকাতেই, মন থেকে গাঢ় এক সোপার্জিত উচ্চারণ বেরিয়ে এল। বললাম, –রায়হান ভাই, যা শুনেছি তা কি সত্য?

কথাগুলো আমার মুখ থেকে এমনভাবে বেরিয়ে এলো মনে হবে কত দিনের দাবী, কত পরিচয়,কত অধিকার এই মানুষটির ওপর।

সে এর আগেই আমার হাত ধরাতেই অবাক হয়েছিল। কোন কিছু বুঝতে না-পারা দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে, এক দৃষ্টে নয়, আড়চোখে। আসলেই বুঝতেই পারেনি, ঘটনাটি কি?

আমিও জানি না, আমি কি ঘটনাচ্ছি। সে আমার ঝাঝালো কথায় এক ধরনের হোঁচট খেলো। হালকা করেই বললো, তোমার জেনে কি দরকার।

আমি ততক্ষণে হাত ছেড়ে দিয়েছি। বললাম, খালি খালি একজন মানুষ কি নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনে? এটা আমার জানা ছিল না। তুমি এমন করেই একটা ঘটনা ঘটিয়েই আমাকে বিস্মিত করেছো।

আচ্ছা শোন তো, আমি ক‘দিন ধরেই চেষ্টা করছি এমন মানুষটাকে কাছ থেকে দেখতে, দেখতে চাই কেমন মানুষ তুমি। বলো তো, তুমি মানুষ, না ফেরশতা!

সে হেসে বললো, এতো কথার দরকার নেই, একজন না একজন তো জেল কাটতেই হতো,  তো আমি কাটলে দোষ কি? খামোকা আমাদের নির্দোষ বন্ধুরা জেল কাটবে, আর আমরা ঘুমাবো। কী করে ঘুমাই। এজন্য এই সামান্য কাজটা করলাম। আর কিছু বলবে?

এই একটুতেই আমি যে তার প্রেমে পড়ে গেছি, সেটা বলতে পারিনি। বলবো কী করে। শুধু মাথা নেড়েই ‘না’ জবাব দিলাম। চোখ তুলে চেয়ে দেখি, এতোক্ষণে আমাদের ক্লাশের অন্য বন্ধুরা চারপাশে। আমি মাথা নিচু করেই সামনে এগিয়ে গেলাম।

এক ক্লাশ বাকী রেখে বাসায় ফিরলাম। মাথা ঠনঠন করছে, ব্যথায় একদম মাথা নাড়াতে পারছি না। কেন এমন করে, কোন বিপদ হলে নাকি এসব করে, নানি বলতেন।

বরাবরের মত ঘুম দিলাম। মন খারাপ হলে আমি ধুম করে পড়ে ঘুম দিই। উজ্জ্বল স্কুল থেকে ফিরে আমাকে ঘুমে দেখে ফিরে গেছে তার ‘বড় মা’র কাছে। অর্থ্যাআমার নানির কাছেআমার ভালমন্দ নানা যেভাবে বুঝেন, সেভাবে নানিও বুঝেন। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ার কারণ তিনি জানেন না, কিন্তু বুঝতে পেরেছেন, মন ভাল নেই। তাই উজ্জ্বলকে নিয়ে তিনি কী যেন আগডুম-বাগডুম খেলা পেতেছেন।

সন্ধে হয় হয় এমন অবস্থায় বিছানা ছেড়ে এলাম। উজ্জ্বলকে নিয়ে নানি খেলছেন গুটিখেলা। ছোটবেলা আমরা কচুর ডাগু কেটে কেটে গুটি বানিয়ে খেলতাম। দাবা খেলার মত খেলাটি। যেটাকে বাংলা দাবা খেলা বলা যায়। চারকোণা খাটের ওপর বসা নানি। খাট উঁচু নয়, হয়তো তিন ইঞ্চি উঁচু হবে। গেরুয়া রঙের মেঝেতে খেলার ছক বানিয়েছেন চক দিয়ে। নানির কোলে আমি মাথা রাখলাম। এটা আমার অভ্যাস। মন ভাল না হলেই এটা আমি করি। নানির কোল হয় তখন আমার গহীন আশ্রয়।

মা বাবার ধুম্রজাল জীবন আমার মাঝে সর্বদাই ঘুরপাক খায়। সহস্রপ্রশ্ন আমাকে তাড়া করে। আমি খুঁজে বেড়াই কী কী যেন। তারা কী কী খুঁজেছেন, কী পেয়েছেন আর কি পাননি, আর কত কিছু নড়েচড়ে ওঠে। সবই মুলত ধুম্রজাল। আমি এই ধুম্রজাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। নিজেকে গড়ার এক উদগ্র কামনা আমাকে তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। সেই ঘূর্ণিপথে আমার নতুন যাত্রা। কলেজে ভর্তি হওয়ার পেছনে সহসা দৌঁড়। সেই দৌঁড়ে আমি আবিস্কার করি রায়হানকে। দ্রুত, অতি দ্রুত রায়হান আমার সত্ত্বাজুড়ে অধিষ্ঠান হয়েছে। টের পাইনা। বুকে ধড়ফড় করা এক সত্ত্বা আমার মাঝে নাছোড় কেউ নাচে।  (চলবে)

You might also like