পরিবানু

 হামিদ মোহাম্মদ

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। সম্পাদক, সত্যবাণী।

॥বারো॥

বাবা আলম চৌধুরীর আসল কাহিনি বলা হয়নি। না-বলা কাহিনিটাই তার জীবনের নানা বাক বদল। আমাদের গ্রামেই ছিলেন ইরফান আলী নামের এক দরিদ্র কৃষকের বাড়ি। গ্রামটা ডাইকা নদীর পারে। লম্বা-লম্বি উত্তর-দক্ষিণে। নদীর পারে গ্রামটি হলেও সব বাড়ি একেবারে পারে নয়, একটু ভেতরে বাড়িঘর। সামনে গাছগাছালি। পায়ে-হাঁটা পথ বাড়ির ভেতর পৌঁছেছে। তবে ইরফান আলীর বাড়ি নদীর পার ঘেষা। নদীর পারে হাঁটাপথ। নদীর তীরের সাথে বেঁকেবেঁকে গেছে। এই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ উঁকি দিয়ে দেখতে পারে বাড়ির ভেতর কে বা কারা আছে। ইরফান আলীর চারকন্যা উদুম-মাদুম। হাঁটতে গেলে শরীর দপদপ করে। গা’র রঙ ফর্সা। মানুষ ফর্সা রঙের মেয়ে দেখলেই সুন্দর ভাবে। গড়নগাড়ন কতটুকু, তা কেউ ভাবে না। ছিবা সুরতের ধার ধারে না। সুন্দর তো সুন্দরই। গ্রামের ছোকরা ছেলেপিলে চক্কর মারে, খামোখাই ঢু-মারে বাড়িতে। পান তামাক খায়। বাড়ির উঠোনে ধান শুকোতে দেয়া বা বিকেলে আবার ঘরে তুলতে এসব কাজে ব্যস্ত মেয়েদের সাথে দু’চার গাল কথা। এই আড্ডা বেড়ে যায় মেয়েগুলো যত বড় হচ্ছে, তত।

ইরফান আলী একদিন নদীপারের পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার বাবাকে ডেকে বাড়ি নিয়ে যায়। বিষয় একটু নিরলে দু’চারটি কথা। ইরফান আলী এদিক সেদিক কিছু কথা বলার পল বললেন, বাবা, আমি একটি বিপদে আছি। মুখ বিমর্ষ করে নারকেলের হুকোয় তামাক টানতে টানতে বললেন, আমার বাড়িতে অমুক তমুক খামোকা রোজ রোজ আসে। আমার মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাই কী করে। তাদের চোখ খারাপ, খারাপ চোখে তাকায়। চিন্তায় রাতদিন ঘুম আসে না। তিনি একটু কেশে বললেন, তুমি তো মুক্তি, তোমাকে সকলেই মান্য করে, ভয়ও করে, আমাকে একটা বুদ্ধি দাও বাবা।

আমার বাবা ইরফান আলীর কথা শুনেন মনযোগ দিয়ে। ইরফান আলীর শুকিয়ে ওঠা মুখ, ঘন ঘন হুকোয় না-থামা টান চোখের সামনে কুণ্ডলি পাকিয়ে যায়। ইরফান আলীর বুক ধড়ফড় করা শব্দ শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন এর ভেতরেও গুমরে ওঠা কান্নারও ধ্বনি।

আমার বাবা ধসকা-মসকা সোজাসাপটা লোক। সময় নিলেন না। বললেন, কোন কোন সময় ওরা আসে?

–সকালে বিকালে এম কি রাতেও।

–ঠিক আছে, রাতে আমি আসবো। দেখি, কে আসে আর কে কি মতলবে ঘুরায়।

এই থেকে বাবা হয়ে গেলেন ইরফান আলীর বাড়ির সদস্য।

ইরফান আলীর বড় মেয়ে বিবাহিত, নাম তেরাবান। বিয়ে করেই মাসের মাথায় স্বামী চলে গেছে সৌদী আরব। বাপের বাড়ি থাকা ছাড়া উপায় নেই। বে-গাফিল স্বামী লোকটির বাড়িতে আদব-সাতে থাকার পরিবেশই নেই। তাই বাপের বাড়ি ঠিকানা।

ইরফান আলীর বাড়িতে বাবার এই ভিড়ে যাওয়ার ফল ভাল হয়নি। ধীরে ধীরে পান তামাক চা নাস্তার বহর বাড়ে। প্রথম প্রথম তারাই যোগাতো। পরে তিনি কোচভরে বাজার নিজে দিয়ে আসেন। এ থেকেই তার এবাড়ি ওবাড়ি বড়মাছ নিয়ে ওঠা। অভ্যাসটা রীতিমত একটি রোগ হয়ে ওঠে।

একদিন শোনা গেল, ইরফান আলীর বড় মেয়ে বিবাহিত তেরাবানকে ‘আখত’ পড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসেছেন বাবা। আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে তেরাবান এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বাবাকে বশ করার যত উছিল্লা সবই করে বাধ্য করেছে ধাঙড় মেয়েটি। এসেই তেরাবান জুড়ে বসে আমাদের ফটিক ঘরটি, যেটাতে আমরা ভাইবোন পড়তাম, সেটি। আমাদের এ গোছানো ঘরটি এখন বেডরুম। বাবা নাকি বলেছেন,‘তুমি আমার রানী। তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো’। সে সত্যি সত্যিই বসে বসে খায়ও। মা রান্না করে এইমাত্র হাড়ি নামিয়েছেন, সে দপদপ করে এসেই ভাত তরকারি প্লেটভরে নিয়ে যায় ফটিক ঘরে, বেডরুমে। গপ গপ করে গিলে এঁড়ে বাসন রেখে যায় রান্নাঘরে। ধুয়োও না। শুরু হল আজব সংসার। আর ঘটনার পর তো আমাদের মা’রসাপ কে দেখে, ঘরের পুলিতে মাথা টুকতে টুকতে কপালে দাগকেউসহসা দেখলে মনে করবে নামজা পড়তে পড়তে দাগ পড়েছেতা কিন্তুনয়, তপস্যার দাগ নয়আহাজারির

এই ঘুণ ধরল আমাদের সংসারে। মা’ আফিয়া বেগম চটে গেলেন। তিনি আরো আগে থেকেই চটে গেছেন, টের পেয়েছিলেন, ইরফানের বাড়িতে সেই রাত কাটানোর দিন থেকে। দাদীর কাছ থেকে শুনেছি, আমাদের মা আফিয়া বেগমের সাথে বাবা বনিবনা ভাল ছিল না, কেউ কাউকে পাত্তা দিতেন না। সেই ফাঁকে তেরাবানকে তুলে আনা।

এটা প্রচার করা কথা। সত্যমিথ্যা আরো গভীরে। আমাদের বাড়িতে এই থেকে গুমোটভাব। বাতাস বয় না যেন এমন অবস্থা। দেখা গেছে, বাড়ির উঁচু উঁচু গাছ বাতাসে মোচড় খাচ্ছে। কিন্তু উঠোনে এক রত্তিও বাতাস নেই। গরমের দিনে হাসফাস করি আমরা। তখনো বিদ্যুৎ আসেনি, হাতপাখাই সম্বল। মা আগে অনেক হাতপাখা বানিয়ে রাখতেন, এখন আর ওসবে মন নেই। পুরোনোগুলো ভেঙে গেছে, ডাটি নেই, সেই মুরদা পড়ে আছে ঘরে এ কোণে বা ওকোণে। বিড়াল হেগে দিয়েছে কোন কোনটিতে। আমাদের দশা গরম ভাত আর নানান জাতের তরকারি আখাল। মা’র হাতে উঠে না কামকাজ।

তিনি ছুটেন মোল্লাবাড়ি। পীরের বাড়ি। তার বিশ্বাস, তাবিজ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটতেই পাও না। নির্ঘাত তাবিজ। জাদুর কারবার এটি। কামরূপ কামাইঙ্খার দেশের হাওয়া লেগেছে বা পেয়েছে। ইরফান লোকটা মহা মতলববাজ। সত্যি সত্যি মতলবাজ লোকটি। আগে বছরে পুরো সময় তার ধানফানে যেত না। খোরকির জন্য ছুটতে হত এ বাড়ি ওবাড়ি। এখন বাবার বদৌলতে ধানফান আমাদের উগার থেকেই ধান নেয়। নামিয়ে বাবা দেন।

মা’ আফিয়া বেগম এ থেকেই স্বপ্নে দেখেন তেরাবানকে খুন করছেন, অথবা তেরাবান খুন করছে মাকে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে পরে এই চিন্তাটাই মাথায় ঘুরে দিনরাত। এমনকি নিজেও মরে যাচ্ছেন, এটাও মাথায় ঘুরে। কিভাবে মরছেন–গলায় ছুরি বসিয়ে, দা দিয়ে কূপ দিয়ে কখনো বা মনে হয় পুকুরে ডুব দিলে আর উঠে আসছেন না। কথা বলছেন, পানিতে থাকা ‘দেওলা’র সাথে। ‘দেওলা’র সাথে সখ্য মার। কোন কোন দিন সত্যি সত্যি পানিতে ডুব দিয়ে বেশি সময় কাটিয়ে ওঠেন। ফাফরা হয়ে পারে উঠে শ্বাস টানতে টানতে অস্থির। আমরাও কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম। এরপর, আর পুকুরে নামতে দিতাম না, খেয়াল রাখতাম, মা পুকুরে নামে কিনা।

মঙ্গলবার এলেই মা ছুটে যেতেন পীরদের বাড়ি। মা বিয়ে হয়ে আসার সময় ফিরাযাত্রায় নিয়ে এসেছেন দিলারাকে। আমরা খালা ডাকি। এই দিলারাই মা’র ভরসা। সে-ই নিয়ে যায়, ঐ  কোন এক পীরের বাড়ি বা খুব দূরে কোথাও কোন মোল্লার তাবিজ আনতে। তাবিজ আনেই আনে। তাবিজ একটার পর একটা বদলায়। বদলাতেই আছে। কী তাবিজ! সে-ই জানে।

চার বা পাঁচ বছর গড়িয়ে গেল এমনি। তেরাবানের পেট থেকে তখন তিন সন্তান।এক চলে দুই মেয়ে।

একদিন শোনা গেল বাবা তেরাবানের ছোটবোন সরজানকে নিয়ে পালিয়েছেন। স্কুল থেকে বাড়ি এসে দেখি সবাই একেক জায়গায় তুপমেরে বসে আছেন। তুপ মানে স্তুপ হয়ে থাকা। নড়ছেন না কেউ কোথাও। দিন পেরিয়ে রাত নামতেই শোনা গেল ঘটনা সত্য। আমরা শুনলাম, সরজান তার বোন তেরাবান আমাদের পরিবারে যে নাগিনী হয়ে ওঠেছিল, সেটির প্রতিবাদ করেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। হাসি পেল। মানুষ তার সুবিধার জন্য কত কিছু বানিয়ে বানিয়ে কাহিনি বানায়। আমি তখন ছোট, ফাইভে পড়ি। কিন্তু বুঝ তো কম নয়, হেরফের বোঝার বয়স হয়ে গেছে। তাই, টের পেলাম মূলত আমাদের সহায়সম্পদে ভাগ বসানো, এক ধরনের লুট করার সুযোগ সৃষ্টি। ইরফান আলী, সেই উজবুকটা একটার পর একটা মেয়ে ঠেলে দিয়েছে। বাবার পিঠে সোয়ার করে দিয়েছে। সোজাসাপটা এই বুঝ নিয়েই আমরা ভিন্ন এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম।

এর ক’বছর পর আমার মা’র পেটের ভাই একজন বিদেশ গেল। আমরা বাড়ি করলাম সিলেট শহরে। সেখানেই পড়ালেখার প্রতি উদাসীন হওয়া আমরা পাঁচ ভাইবোন বুনো ঘাসের মত বড় হতে থাকি।

আমি একটু বড় হলে, আমারই খালাতো ভাই, যেটাকে এখন গর্দভ মনে করি, সে-ই আফজাল মিয়া আমার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। তার পাগলামির তোড়ে আমিও এক সময় ভেসে যাই। নানা সোলেমান গাজি ভেবে চিন্তে বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমিও ভেবেছিলাম মা’র অসহনীয় সংসার যাতনার মাঝে আমার পোকা হয়ে থাকার চেয়ে জান বাঁচাই। কিন্তু জান বাঁচলা কই? মা একদিন সত্যি সত্যি মরে গেলেন। মরে গেলেন, তিনি যে খুন করতে চেয়েছিলেন সতিনদের বা নিজে পানিতে পড়ে মরতে চেয়েছিলেন, কিংবা ছুরি গলা বসিয়ে মরতে চেয়েছিলেন, সে রকমই। তবে, এসব কিছুই করেননি, নিজের ‘গা’র কাপড়ে আগুন দিয়ে পুড়ে গিয়ে মরেছেন।

আামার বুঝ মতে, বাবা সরল মানুষ। প্রতিবাদী হয়েছিলেন গ্রামের যুবকদের আচরণে। গরীব লোকের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। সেই প্রতিবাদের তরমুজের মত গলি পেরিয়ে যত অঘটন।

এরপর, মাছওয়ালাদের হয়ে হাওরাঞ্চলে ভাসানপানিতে মাছ ধরার অধিকার আদায়ের  লড়াইয়ে নাম লেখানো। পরে ইজারাদারদের নিয়োজিত শকুনের মত লোকদের গুলিতে পানিতে ডুবে মরা। নিয়ম শৃঙ্খলাহীন জীবন বাবার জন্ম দিল কত কত কাহিনির। কোনটাই আমাদের হল না। আমাদের মা। খুন করা, মাথায় চেপে যাওয়া  এমন ঘোর চিন্তা মাকে নিয়ে গেল তৃষ্ণাতুর কোন এক কুহক। পাড়ার লোকজন মুখ টিপে টিপে হাসে। হাসে আমাদের দুরবস্থার জন্য।

আমাকে এই কুহক পেরুতে হবে। জেদ চাপে। আমি সেলাই শিখি। বাজারে সেলাইকরা কাপড় ব্লাউজ পেটিকোট আরো কি কি বেচি। কিন্তু এর অন্তরালে পেয়ে বসে বিউটিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন। নেশাটা যদি পেশা হয় পয়সা কামাই তো হবে। নেমে পড়ি আরেকটি অজানা রাস্তায়। যে রাস্তায় মানুষের জীবন ঝনঝন করে। অনেকটা আলো অনেকটা অন্ধকার এই জগত। (চলবে)

You might also like