পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥তের॥
পয়লা বৈশাখে আমাদের কলেজের একটি মেয়ে তিন্নি নাম, সে কলেজের একটি অনুষ্ঠানে নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। নৃত্যটি ছিল ‘এসো এসো হে বৈশাখ’ গানের সাথে। কী অপূর্ব নৃত্য। পুতুলের মত দেখতে মেয়েটি। জানলাম, বাড়ি সিলেটে। শ্রীহরিদাসের শিশু একাডেমীর ছাত্রী। শ্রীহরিদাসকে আমি চিনি। তিনি শিশু একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী এবং প্রান্তিক কচিকাঁচার মেলায় নাচ শেখাতেন। আমিও নাচ শেখার চেষ্টা করেছিলাম শিশু একাডেমীতে কিছুদিন। দলনৃত্যে একবার অংশ নিয়েছিলাম। মা বাবার এলোমেলো জীবন আমাকে ছিটকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর কোথায় যেন হারিয়ে যাই। নানা বাড়ি চলে আসি। সিলেটের মোগলাবাজারের এক অজো পাড়াগাঁ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক নানা। নানা বাড়ি আসার পর পড়াশোনায় মন দিই। ক্লাশ ফাইভে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হই হাইস্কুলে। পাশের গ্রামেই হাইস্কুল। এসএসসিতে পড়ার সময়ই আমার পিছ নেয় আফজল মিয়া। আমি নাকি দেখতে ‘পরি’। সে ক্লাশ টেনে ওঠেই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে পাড়ি দেয় সৌদি আরব। সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা যুবক আফজল মিয়া। লোকে বলে সৌদিফেরত। আফজল মিয়া বেগনা নয়, বড় খালার ছেলে। সেই সুবাধে তার নিয়মিত যাতায়াত নানাবাড়ি। আমার পিছ লাগা সহজ হয়ে ওঠে এজন্য। ফুরফুরে সেন্টের গন্ধ ছুটে তার পেছনে। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমার পিছু নেয় কখনো। ছোটবেলা খেলার সাথী হতে পারেনি, কিন্তু তার হাবভাবে মনে হয় সে আমার বালিকাবেলার সাথী। আমার চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের বড় হবে। তবুও মনে হয় কচি যুবক। বাচবিচার থাকে না। এক অন্ধ সত্ত্বা জেগে ওঠে মনে, দেহে। গুন গুন করে মৌমাছির মত গানের কলি। রাতের ঘুম তাড়িয়ে বেড়ায় কে যেন। আমিও প্রেমে পড়ে যাই। প্রথম প্রেম নাকি এরকমই হয়। জটপট বিয়ে। নানা রাজি ছিলেন না। নানির জোরাজুরিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে বাবা মা’র উপস্থিতিটাই ছিল মাত্র। মূলত তারা নাখোশ ছিলেন এই বিয়েতে। আমি আফজল মিয়ার প্রতি অন্ধ হয়ে পড়ায় নানা এক তরফা মতামত দিয়ে বসেন।
গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরে আবার শহরের স্কুল ছেড়ে গ্রামে–এই টানাপোড়নে না হল নাচ শেখা, না হল পড়ালেখা। প্রেমে পড়ে বিয়ের পিড়িতে বসা। আফজল মিয়াদের বিশাল পরিবার। পাঁচ ভাই তিন বোন, তার উপর মা-বাবা। এমনি লোক গমগম ঘরের বউ আমি।
বছর পাঁচেক সংসার। তারপর কোন এক কুহক গহবরে পড়ে ছিটকে পড়ি। তিন বছরের উজ্জ্বলকে নিয়ে মা’র সংসারে ঝুলে-পড়া। এসব চিন্তা করতেই মাথা ধরে। তবে শান্তনা, পাঁচ বছর গ্যাপ দিয়ে আবার কলেজে পড়ছি। তবে আমি যে ভাতে মরবো না, এটা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি সেলাই জানি, জানি বিউটিশিয়নে কাজ। এখন শিখতে চাই নাচ–তথা নৃত্যকলা। যে কোন কিছুই শেখার নেশা আমাকে পেয়ে বসে, অবিরাম শিখতে চাই। জীবনে সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙতে মন বাজপাখির মত ছুটতে থাকে। আমিও ছুটি।
তিন্নির নাচ দেখে আমি অভিভুত। অনুষ্ঠানের পরে তাকে চিমটি দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সে আমাদের ক্লাশেরই মেয়ে। তবে, সায়েন্স সেকশনে পড়ে। প্রথম বর্ষ পরীক্ষা সামনে। পড়ার চাপ, সেদিকে নাচের মোহ। কী যেন মোচড় দিয়ে বয়ে চলে মাথায়। উদাস উদাস লাগে।
একদিন তাকে ধরেই ফেললাম আমাকেও নাচের স্কুলে নিয়ে যেতে। ছোটবেলা যে আমি সামান্য নাচ করেছি, সেটা বললাম তাকে। আরো বললাম, শ্রীহরিদাসও আমার টিচার ছিলেন তখন। আমিও সিলেটের মেয়ে শুনে সে চনমন করে ওঠে। আমি ভরসা পাই।
নাচের স্কুলের নাম ‘চিন্ময় ললিতকলা একাডেমী’। নাটকপাড়া বেইলিরোড। চমৎকার পরিবেশ। হুট করেই ভর্তি হয়ে গেলাম। আমার শরীরের জড়তা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী মোক্ষম উপায়। মনে হল, এটা যেন কোন এক ঐশ্বিরিক পাওয়া।
কলেজে এক পাল বন্ধু। রায়হান, তিন্নি তো আছেই। যেন হাত ধরাধরি করেই ছুটছি। রায়হান কলেজের ভাল ফুটবল খেলোয়াড়। অন্যদিকে জাতীয় ফুটবল দলে তার নাম-ডাক। এবারে আন্ত-বিভাগীয় কলেজ ফুটবল প্রতিযোগিতায় দু’গোল দিয়ে কলেজকে জিতিয়ে এনেছে, তাই সবার মুখে মুখে তার নাম।
রায়হান ফুটবলে দক্ষ হলেও কণ্ঠ থেকে গান যায়নি। গায়ে আগুনধরা নচিকেতার গানগুলো তার কণ্ঠে আছেই। শিরিষতলায় কিংবা কলেজের পুকুরপারে, তালতলায় গানের গুন-গুনানি শুনলেই বুঝতে হবে রায়হান আছে বা এদিক দিয়ে যাচ্ছে। কলেজ মাত করে রাখা রায়হানকে আমার পছন্দের একজন হয়ে ওঠার পেছনে তার সততা। যে সততার জন্য জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিল সে বন্ধুদের বাঁচাতে। এমনি বিরল কোন যুবক আমার চেনাজানা নেই। আমার কেন, কলেজের কারোই নেই। সেই নচিকেতার বিপ্লবী গান যার কণ্ঠে, ফুটবল যার পায়ে অপরূপ শিল্পরূপ, সাঁই সাঁই করে ছুটেচলা যুবক এখন আমার মনের মানুষ। আমার বন্ধু সে।
তবে রায়হানকে আমার নাচ শেখার কৌতুহলটা জানাইনি। অতীতে সেলাই শেখা, বিটিশিয়ান হওয়া এবং আমার যে এক পুত্র সন্তান আছে, আমারও যে বিয়ে হয়েছিল সব কিছুই লুকিয়ে রেখেছি রায়হানের কাছে, এমনকি কলেজেও লুকিয়ে রেখেছি।
এসব অন্য কারোর বা রায়হানের জানা হলে, আমার মনের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে–এ বিশ্বাস কিভাবে যেন আমার মনে গেঁথে আছে। এসব গোপন রাখার মাঝে আমার কোন কিছু হওয়ার বাসনা প্রোথিত, এটাই নিয়ত শ্বাসরুদ্ধকর এক স্বপ্নকে জিইয়ে রাখে। আমি স্বপ্ন দেখি।
কীসের স্বপ্ন? মনে মনে ভাবি, যে স্বপ্ন আমাকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে। তাই, যা পাই শিখি। শিখতে শিখতে এক সময় এমন কোন শক্তি, এমন ক্ষমতা সঞ্চয় করতে চাই, যে পরিচয় সর্বোচ্চ।
কলেজ ক্যাম্পাসে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে হুট করে আমরা ক’জন ছাত্রছাত্রী ঠিক করি কলেজটিকে একটি বাগানে রূপ দিতে। চাঁদপুর পুরানবাজার কলেজের একটি ভিডিও আমাদের এক বন্ধু খুঁজে পায় ইউটুবে। কী অসম্ভব সুন্দর কলেজটি। ফুলে ফুলে রঙিন, সবুজে সবুজ। গুচ্ছ গুচ্ছ সারি সারি গাছ। নাম না-জানা শত বৃক্ষরাজি। কলেজ ছুটির পর ছাত্রছাত্রীরা ছায়ায় বসে গান গায়, বই পড়ে, আড্ডা মারে, প্রেম করে। কেউই একটি পাতাও ছিড়ে না, ডালও ভাঙে না। এসব দেখাশোনা বা পরিচর্যা করার জন্য আলাদা কোন মালি নেই, কোন লোক নেই। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা মালি, কাজের লোক। গাছের নীচে ঝরা পাতা নেই, ঝকঝকে তকতকে পরিবেশ। ছাত্রশিক্ষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এমনই এক স্বপ্নময় সুন্দর জীবনের হাতছানি হয়ে আছে। আর কলেজটির দেয়ালে বিশেষ বিশেষ জায়গায় অঙ্কিত বিশিষ্টজন স্মরণীয়-বরণীয়দের ম্যুরাল, চিত্রকর্ম এবং রয়েছে ঐতিহাসিক বাণী ও কবিতা–উৎকীর্ণ। কোথাও কোন ময়লা নেই, না দেয়ালে, না মাঠে।
আমাদের মাঝে প্রশ্ন জাগে, সেটা কি আমরা পারি না?
যেই চিন্তা, সেই শুরু। কলেজের ছাত্রশিক্ষক মিলে সভা ডাকা হল। কোন আপত্তি ছাড়াই শুরু হল কলেজকে বাগান করে তোলার লড়াই।
(চলবে)