পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥পনেরো॥
চিন্ময় ললিতকলা একাডেমীতে ভর্তি হয়েই পরিচয় হয় নাইমুর রাজার সাথে। তার একটি মডেল ফার্ম আছে। ললিতকলা একাডেমীরও সে অন্যতম ডাইরেক্টর। এখান থেকেই মডেল সংগ্রহ করে। নাচ শেখার পাশাপাশি আমি মডেলিংয়ে নাম লেখাই। এই যেন দিকনিদের্শনা পেয়ে যাই। অভিনয় কিভাবে করতে হয়, কিভাবে এ জগতে প্রবেশ করতে হয় তা জানা ছিল না। এক অর্থে অভিনয় করবো এমন স্বপ্নও পোষা হয়নি কখনো। কিন্তু ধড়াস করে একটি বিশাল দরজা খুলে গেল চোখের সামনে। আমার দৌঁড়ঝাঁপ কে দেখে। নানাকে আমার এসব লাফলাফি জানাইনি। তিনি জানেন, আমি টিউশনিতে বিকেলে যাই। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি নাচি, মডেল হই। ধীরে ধীরে আমার দেহ তৈরী হয়। জড়তা কাটে। জড়তা না-কাটার এই শংকাটাই আমার শত্রু ছিল। অতি অল্প দিনেই আমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ খুলে যায়।
মনে পড়ে আমাদের ভাড়াবাসার পাড়াটির কথা। এ পাড়ার দশ্যি ক’টি ছেলের কথা। ছেলে তো ছেলে। ওরা ছাত্র। লেখাপাড় করে। কোন কলেজে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা জানার কাজ আমার নয়। ছেলেগুলো বিকেলে বসতো ঘাসের মাঝে। আমাদের বাসার সোজা পূব দিকে। এক চিলতে মাঠ। মাঠ নয়, একটি খালি প্লট। কেউ কিনে রেখেছে। হয়তো কোন প্রবাসী বা ব্যবসায়ী। আমাদের জন্য এটা মাঠ। পাড়ার বাচ্চারা খেলে। ফুটবল, কখনো ক্রিকেট। বর্তমানে ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাচ্চারাও এই জনপ্রিয়তা বুঝে। তারা ফুটবল বাদ দিয়ে ক্রিকেট খেলে।
এই মাঠেই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ঐ ছেলেগুলো শীতের দিনে বিকেলে রোদ পোহাতো। কোনদিন তিনজন, কোনদিন আবার পাঁচজন। পাশেই একটি মেছে ওরা থাকে। সকাল সন্ধ্যায় পড়ার শব্দ শোনা যায়। কেউ কেউ জোরে শব্দ করে পড়ে। কেউ কেউ আস্তে শব্দ করে পড়ে। বুঝা যায়, ওরা পড়া মুখস্ত করছে। ওরা প্রতিদিন বিকেলে কাছিমের মত বসে থাকতো। মাঝে মাঝে শোয়ে পড়তো। মনে হতো কাছিমগুলো উল্টে শুয়েছে।
কেন জানিনা, আমিও ঐ সময়টিতে বেরোই। ছাদে উঠি। বারান্দায় দাঁড়াই, টুল টেনে বসি। সামনের বাগানে গোলাপ ফোটা দেখি। ওদের দিকে তাকাই। তারাও তাকায়। কোন ইঙ্গিত নয়, শুধু তাকানো। কখনো সোজা তাকাই, কখনো তেরচা। তারাও সমান সমান এটা ওটা করে। আমি টের পাই–এর মাঝে যেন একটা ভয়ানক সৌন্দর্য লেপ্টে আছে, গড়িয়ে পড়ছে। বিকেলে রোদের তেরচা হওয়া, গড়িয়ে পড়ার সাথে ওরা ভাসায়। একই রকম–প্রকৃতি আর মানুষ। মানুষ ও প্রকৃতি।
মাঝে মাঝে আমারও মনে হত ওখানে যাই। প্রথমে খুব মনে হতো না। আস্তে আস্তে বেশি মনে হতো। পড়তে বসলে মনে হত, শুলেও মনে হত। রাত্রে ঘুম না এলে তখনো মনে হত। মনে হত আমিও ঘাসে শুই। ঘাস হই। ঘাসে ওদের গতরের দাগ লেগে আছে কি না। আমি দেখতে যাবো-দাগ। ঘাস কি মরে যাচ্ছে ওদের শরীরে চাপে, থেবড়া হয়ে আছে কিনা, না সবুজ দুর্বা, কে জানে? হয়তো ওরা জানে। ঘাসে হয়ত তাদের গায়ের গন্ধ লেগে আছে, নাও থাকেতে পারে।
আমাদের বারান্দায় ভেজা কাপড় শুকানোর জন্য একটি তার টাঙানো। আমি প্রায়দিন অথবা প্রতিদিন কাপড় মেলে দিই। মেলার সময় দেখিনা ওদের। হয়ত সকালবেলা ওরা পড়ায় ব্যস্ত। তাই বাইরে আসেনা। বিকেলবেলা কাপড় আনার সময় ওদের ঘাসে বসতে দেখি। ওরা মেয়েদের কাপড় নিয়ে কিছু ভাবে কিনা, জানি না। হয়ত ভাবে। লাল সেলোয়ার, সেলোয়ারের চিপা, উরুর দিকটা, কেমন?। ঘষা খেয়ে মেজমেজে হয়ে যাওয়া জড়িমড়ি অংশটি! কিংবা ভাবেই না। এটার আমার কৌতুহল। ছেলেদের কৌতুহলটা আমার জানার ইচ্ছা। আমার স্বামী গর্দভটার নিকট থেকে এমন ধরণের কোন কৌতুহল কোনদিন জানতে পারিনি। সে প্রেম করছিল আমার সাথে। তবে সেটা পরে দেখেছি যৌনকর্ম ছাড়া আর কোন টান তার নেই। সে জন্য এসব চিন্তা আমার ভেতরে আসেনি, হয়ত ছিল। তার চাওয়া মেটানোর পর এমন কিছু মনে আসতো না। ইচ্ছা থাকলেও মরে যেতো। আমার বিয়ে ছিল। ওরা জানেই না। আমি সন্তানের মা, তাও ওরা জানে না।
তাদের মাঠ বা খালি প্লটটি আমাদের বাসার সামনের প্লটের পরের প্লট। দুটোই খালি জায়গা। তবে আমাদের সামনের প্লটের ঈশাণ কোণায় একটি ছাপটা ঘর। এখানে থাকে বা বাস করে কলসুমের মা। আমাদের বাসাসহ আরো কয়েকটি বাসায় ঝিয়ের কাজ করে। আমি জানতাম না, কলসুমের মা-ও তাদের মেসে কাজ করে। এখন মাঝে মাঝে দেখি, সে মিট মিট করে হাসে আমার মুখের দিকে চেয়ে।
আমার কাঁশি হয়েছিল। কাপড় ভাঁজ করে কাঁধে রাখতে রাখতে একদিন খুব কাঁশলাম। ওরা বার বার তাকালো। তারা মনে করছে কিনা আমি তাদের দৃষ্টি আকষণ করছি। আসলে তা নয়। আমার শরীর খারাপ, রাতে জ্বরও উঠেছিল। বোধহয় সর্দিটর্দি হবে, নাকের তলায়, মগজের দিকে জ্বলতে থাকে।
একদিন তেল চিটচিটে কাগজের টোঙায় সে কি নিয়ে এসেছে। এসে আমার হাতে দিল। আমি বললাম–কি এটা? সে হেসে বললো–বলবো।
–বল না আগে কি এটা?
সে বললো, সিঙ্গারা।
–সিঙ্গারা আনতে গেলে কেন তুমি গরীব মানুষ। কেউ দিয়েছে?
সে হেসে বললো, জ্বি।
আমি হাতে না নিয়ে বললাম– কে দিয়েছে?
হাত পুব দিকে বাড়িয়ে বললো, ঐ স্যাররা দিয়েছে আপনাকে।
–এত্তো সাহস কথাটি বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। মৃদু হেসে হাতে নিলাম। বললাম–কোন দোকানের।
সে বললো–আপামনি, ঐ যে মামুনের দোকানের, আপনাকে যে দোকান থেকে এনে দিই। আপনি মজা পান, সে দোকান থেকেই আনছি।
–তারা কি ঐ দোকানের খায়?
–জ্বি।
মনে হল ঢাকা শহর। এটা মফস্বল শহর নয়। যে মেয়েদের নিয়ে ভাবতে ভয় পায় কোন ছেলে। সোজাসাপটা মেশে, চলে ফিরে মানুষ। আর ঢাকা শহর কী ঘেষাঘেষি করে চলা বাসে, রাস্তায়, যে কোন যানবাহনে হিসেব ছাড়া। আর আমাকে সিঙ্গারা সেঁধেছে ছেলেরা, তা-ও মুখোমুখি দেখা না হলেও ক হাত দূরের প্রতিবেশী।
আমি ‘খাবো’ এমন ভঙ্গি করে পাকঘরে রেখে দিলাম। আমি সহসা কারো দেয়া কোন জিনিস বা খাবার খাই না। যদি ভিন্ন উদ্দেশে কিছু খাওয়ায়! জাদুটোনার উদ্দেশেও তো হতে পারে। মানুষ মেয়ে মানুষকে পটাতে কত কিছুর আশ্রয় নেয়, নিতেও পারে। আমার মরে যাওয়া মা এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার সংসার তছনছ করে দিলেন। আমার সংসারও এ নিয়ে ভেঙে গেছে।
একদিন হুট করে আমিও গেলাম কলসুমের মাকে সাথে করে ওদের মেসে। তারা তো অবাক। অবাক হওয়ারই কথা। তারা ভেবেছে, আমি হয়ত বকা দিতে গেছি। হয়ত বকা দিব–‘কোন সাহসে সিঙ্গারা পাঠাও বাবারা।’
আসলে কোন কিছু নয়। আমার কৌতুহল। কৌতুহলটা খুব ছোট। ছেলেরা মেসে থাকে। কেমনভাবে থাকে, সেটা আমার জানার আগ্রহ। কাপড়চোপড় খুব এলোমেলো কিনা, আলনা আছে, কি নেই, না দড়ি টাঙিয়ে কাপড় রাখে ওরা। বিছানা গোছগাছ করে রাখে কি না। আমি ধাঙড় মেয়ে। কিন্তু বাচ্চামির শেষ নেই। কথা বলতে বলতে সামান্য চোখ বুলানো। ছেলেগুলো ঘরেই ছিল, টিপটিপ বৃষ্টি, মাঘ মাসের বৃষ্টি এমনি-ই টিপটিপ হয়, বড় জড়ি হয় না। বৃষ্টির জন্য ওরা ঘরেই আছে, তা এক ধরনের ঝাঁপ দেয়ার মতো আমরা ঝটিকা সফর। আলতুফালতু কিছু কথা বলার পর আবার ছুটে ফিরে এলাম। চোখে পড়লো একটি ছেলের কাঁধ বরাবর চুল। আরেকটার ওলঠিয়ে আছড়ানো। একজনের ছোট চুল, একদম ছোট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কেউ দর্শনে, কেউ বাংলায়। সবার কথা জানা হয়নি।
আমাকে দেখে বা আমার সাথে কথা বলতে ছেলেগুলো ঘেমে ওঠেছিল কিনা, দেখিনি। আসলে খেয়ালও করিনি। শুনেছি, ছেলেরা মেয়েদের সাথে হঠাৎ কথা বলতে পারে না। বিশেষত কোন নতুন মেয়ের সাথে। আমি তাদের কাছে নতুন না হলেও নতুন। সামনাসামনি দেখা হয়নি। কথা তো হয়ই নি। ঘামই পরে। কপালে তো ঘাম চিক চিক করতো দেখিনি।
দেখা হওয়ার কথা নয়। তাদের চলাচলের রাস্তা ভিন্ন পথে ঘুরে গেছে পাড়াটার পেছনের প্রধান সড়কে। আমি যাই বাসা থেকে বেরিয়েই ডানে মোড়, তারপর বায়ে মোড় এরপরে সোজা পঞ্চাশ ফুট,তারপর ঘুরে যাওয়া বাক পেরিয়ে একটি পেট্রলপাম্পের গা ঘেষে প্রধান রাস্তায় নামি। কখনো হেঁটে, আবার গলির ভেতর কেউ গিয়ে রিকশা ছাড়লে ভাগ্যক্রমে রিকশায় ছুট।
আমি ভাবি এখন ঐ ছেলেদের কাউকে না কাউকে পেয়ে যেতে পারি প্রধান সড়কের মোড়ে,আমি যেখান দিয়ে প্রধান সড়কে পা রাখি বা বেরোই, সেখানে। অথবা না-ও পেতে পারি।
কিন্তু আমি। আমি মাঝে মাঝে সমিল চেহারার কাউকে কোন রিকশায় দেখলে ভাল করে দেখতে চেষ্টা করি, ওরা কেউ কিনা, ভাবি। আসলে সেদিন কারোর চেহারা ভাল করে দেখিনি। মনেই নেই কার চেহারা কেমন। যতটুকু মনে আছে, ঝাপসা। কেউ খুব লম্বা,একজন বেটে,তবে ততটা নয়–মাঝারি। আর সব দশ দশা।
এখন ভাবছি, অন্য কেউ যদি প্রধান সড়কের মোড়ে আমাকে ফুল দিতে দাঁড়িয়ে থাকে বা দেয়। আমি যদি বিরক্ত হই, ছেলেগুলো শুনলে আমার পক্ষ নিয়ে তোলকালাম কাণ্ড ঘটাতে পারে। হয়ত মারামারি, খুনখারাবিও হতে পারে। তারা এখন যেন আমার গোষ্ঠীর গোষ্ঠী, বিশেষত লম্বা চুলওয়ালা ছেলেটির বন্ধুর বন্ধু আমার চিন্ময় একাডেমীর নাইমুর রাজা। এ তথ্যটি অর্থাৎ নাইমুর রাজা একদিন আমাকে বলেছে। কথায় কথায় বলেছে আমার পাড়ায় ওর যাতায়াত আছে। এবং যাতায়াতটা ঐ মেসে। স্রেফ, আড্ডামারা। তবে আমি যে ঐ পাড়ায় থাকি, এটা নাইমুর আগে জানতো না। এখন জলবৎ তরলং।
আমার নানা বা নানি কেউ ওসব জানেন না। কিন্তু বুঝেন, আমি আগের মত জড়োসড়ো কেউ নই আর। এছাড়া পাড়ার লোকরা হয়ত জানে আমি ভাড়াটিয়া পরিবারের কেউ। আজ আছি কাল নাই–এরকম ভাড়াটিয়ার পরিবারের সদস্য আমি। মাঝে মাঝে দুএকটা ছেলে সাইকেল দিয়ে আগ-পিছ করে আমার রিকশার বা আমার হেঁটে যাওয়ার সময়। করবেই তো, একতো নারী, তার উপর গায়ের রঙ আর আমার দাপুটে চলনবলন কাউকে প্ররোচিত করতেই পারে। করলে, কী আর করবো। তবে ভয় পাই না, কোন কোন সময় বিরক্তও হই না। ভাবি, আমি মেয়ে মানুষ, আমার পিছে যদি দুএকটা ছেলে ঘুর ঘুর না-করে, তাহলে আমি কোন ধরণের মেয়ে মানুষ। ভেবে আনন্দও পাই। কেউ ফুল ছুঁড়ে মারলে বা কেউ সাহস করে হাতে তুলে দিলে, দিতেও পারে। ভাবতে মজাই লাগে। (চলবে)