পরিবানু

 হামিদ মোহাম্মদ

‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।  –সম্পাদক, সত্যবাণী।

॥নয়॥

বিউটিশিয়ান বাবলির পরামর্শ, জীবনকে বদলে ফেলার যুদ্ধ শুরু করা আমি রেণু নাম বদলে ফেলি। পুরোনো সাবেকী ঢংয়ের নাম আর মানায় না। এক ঝটকায় নাম রাখলাম ‘পরীবানু’। পরীবানু এখন বিউটিশিয়ান। সাজ-করা বা সাজানো শিখতে শিখতে সাহস বেড়ে যায়। আমিও এখন লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটি। একজোড়া মেয়ে এখন এক সাথে দাঁপিয়ে আসা-যাওয়া করি। লোকের চোখ এড়ায় না। তবে, গায়ে বোরখা।

যাতে লোকে চিনতে না-পারে, তেমনই চলাফেরা। অল্পদিনেই মনের জোর এমন বেড়ে গেল আমার গলার স্বর বদলে গেল। মিনমিনে মেয়েটি আর নই। রাস্তায় একবার একটি ছেলেকে ফুটবল বানিয়েছিলাম। ফুটবল মানে, আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। একটি ছেলে প্রায়ই বিড়ালের মত ঘুরতো আমার সাথে। আগপিছ করতো যাওয়া-আসার সময়ে পথে। পেছন থেকে  একদিন দিলাম চোট, পড়ে গেল সামনে। উহ করে উঠতে শোনা গেল। বৃষ্টির  দিন ছিল না। গায়ের ধুলো ঝেড়ে চলে যায়। এরপর, আর দেখিনি।

চোট দেয়ার পর মনে হল আমি একবার স্কুলে ফুটবল খেলতে একজনকে ফেলে দিয়েছিলাম এমনি। সেও, সেদিন পড়া থেকে দ্রুত উঠে খেলায় মত্ত হয়ে যায়। এই ছেলেটিও এদিন মানুষের ভীড়ে মিশে যায় দ্রুত। আমি আর এ পাশ ওপাশ তাকাই না। সামনে হাঁটতে গিয়ে সাহস করে একটা দম নিলাম। পাখার বাতাসের মত একটু বাতাস বেরুলো ভেতর থেকে। মনে মনে দেখতে পাই, আমি ডিমের কুসুমের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছি।

বিউটিশিয়ান হওয়ার নেশা কেন ছাপলো মাথায়, তা খুঁজে পাইনি। একটা কিছু শেকার নেশাটাই বড় লাগল। এটা পেয়ে বসে যখন আমার বাই বাবলু রহমান আমাকে ঠেলে দেয় পথে। কেন দেয় সেটা সে জানে। সেদিন থেকে কোন কিছু হয়ে ওঠা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দৌঁড়ঝাঁপ শুরু। হাতের কাছে যা পাই আকঁড়ে ধরি। ছুটে চলি। ছুটতে ছুটতে বিউটিশিয়ান হওয়ার স্বপ্নে পেয়ে বসে। সেই শেখার অনুসঙ্গী বাবলি হয়ে ওঠে আমার পথপ্রদর্শক। পথের সঙ্গী।

এ পথে পা বাড়িয়ে টের পাই মানুষ এ নতুন পেশার ভেতর খুঁজে বেড়ায় কোন এক ধান্ধা। ধান্ধা মানে কেউ কেউ মনে করে পার্লাারের মেয়েরা অনৈতিক কাজে লিপ্ত। এটা সেলাই কাজে যখন নামি,তখনো টেইলারিংয়ের মেয়েদের নিয়ে মানুষের এই কুচিন্তা বিরাজ করে।

আমি খুঁজে পেয়েছি, মেয়েরা যখনই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, সেখানেই মানুষ খুঁজে বেড়ায় একটা কিছু, বুঝে বা না বুঝে র্দুগন্ধ ছড়ায়। টেইলারিংয়ে কাজে  বা পার্লারে নিয়োজিত মেয়েরা, মানে দু:শ্বরিত্র, চরিত্রহীনা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে  গিয়ে এসব মানুষের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে বোরখা নিলাম। যাতে কে যাচ্ছে বা আসছে, টের পায় না কেউ। মেয়েরা স্বাধীন হতে চাইলেই এই বিপদ।

সেলাই শেখার পর বিউটিশিয়ান হওয়া, আমাকে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। মনে মনে ভরসা, আমি অন্তত না-খেয়ে মরবো না। আমার সন্তানকে নিয়ে ভাবতে হবে না, কোন অসহায়ত্ব আমাকে আর কাবু করতে পারবে না।

এই অবস্থায় মনে হল, লেখাপড়ার দুয়ার তো আমার এখনো খোলা। আমি যদি ঢাকায় নানার বাসায় উঠি, নানা রিটায়ার্ড হয়ে ঢাকা উঠেছেন ভাড়া বাড়িতে, আমার আদর সোহাগের নানা আমাকে নি:শ্চয় আশ্রয় দেবেন।

কলেজে ভর্তি হয়ে অন্তত সমাজে গ্রহণযোগ্য কোন কিছু করার যোগ্যতা অর্জন করা মানে, লেখাপড়া করা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা, কী করে যায়।(চলবে)

You might also like