পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার অপসারণ নিয়ে দেশে-বিদেশে ক্ষোভ

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য মজলুম জননেতা পীর হবিবুর রহমানের নামে স্থাপিত গণপাঠাগারটির অস্তিÍত্ব এখন আর নেই। পাঠাগার অপসারণের পাশাপাশি কয়েক বছর আগেই নামিয়ে ফেলা হয়েছে সাইনবোর্ডও।পাঠাগার প্রতিস্থাপন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টালবাহনা করে যাচ্ছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। এই অবস্থায় দেশে বিদেশে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। দাবি ওঠেছে দ্রুত পাঠাগারটি প্রতিস্থাপন করে পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার।

পাঠাগারটি প্রতিস্থাপনের দাবি জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (০২ সেপ্টেম্বর) বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন- ‘আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্যক্তিবর্গ লক্ষ্য করলাম, পরম শ্রদ্ধেয় স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মজলুম জননেতা পীর হবিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা সিলেট পৌরসভার লাইব্রেরী সরিয়ে ফেলা হয়েছে নাকি বিলুপ্ত ঘটনো হয়েছে তার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না।
সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পারি লাইব্রেরী ঘরটি ভেঙ্গে সেখানে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে এখন সিটি কর্পোরেশনের গোদামঘর ও ড্রাইভারসহ অন্যান্য কর্মচারীদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দৃশ্যত পাঠাগারের অস্তিত্ব সেখানে নেই। বইপত্রেরও হদিশ নেই। আরও জানা গেছে, ভবনটি তৈরির আগে ভবনের নীচতলায় লাইব্রেরী থাকবে না অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হবে এমন কোন বিজ্ঞপ্তিও পৌর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে দেওয়া হয়নি। স্বাভাবিকভাবে সকলেরই ধারনা ছিল ভবন তৈরি শেষ হলে নীচের তলায়ই লাইব্রেরী যথারীতি স্থান পাবে। কিন্তু তার পুনঃস্থাপন না দেখে দেশের ন্যায় বিদেশে বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ১৬ ফেব্রয়ারী জননেতা পীর হবিব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অভিভক্ত ভারতের আসাম প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক থেকে রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ৫২ সালে সিলেট জেলা (বৃহত্তর সিলেট) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক, মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর একান্ত সুহৃদ পীর হবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন কামরানের সভাপতিত্বে এক নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা পরিচালনা করেন সিলেট জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক লোকমান আহমদ। সিলেটের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ।

জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ তার স্মৃতি তর্পনে পীর হবিবুর রহমানের নামে সিলেট পৌর পাঠাগারের নামকরণের প্রস্তাব রেখে পরবর্তীতে কোন একটি রাস্তার নামকরণ করা নিয়েও মেয়র কামরানের প্রতি আহ্বান জানান।মাননীয় মেয়র কামরান জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে সিলেট পৌরপাঠাগারের নামকরণ করেন, ’পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার’। বালাবাহুল্য, জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ মৃত্যুর আগে তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংগৃহীত সবগুলো বই এই পাঠাগারে দান করে গেছেন। শত বছরের এই পাঠগারটি পীর হবিবুর রহমানের নামে নামকরণে পাঠাগারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে এর সাথে অসংখ্য অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আবেগ জড়িয়ে আছে।

আমরা বিশ্বাস করি এর পেছনে পৌর কর্পোরেশনের কোনও অভিসন্ধি নিহীত নেই। একইসাথে আমরা মনে করি কাউকে সম্মান দিতে না পারলে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু কারো সম্মান কেড়ে নেওয়া কিংবা তার আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা অপমানিত-অবদলিত করার অধিকার নিশ্চয় কারো নেই। এই মুহূর্তে ভবনের পরিপাটির কাজ চলছে। আমরা আশা করি এবং সম্মানিত পৌর মেয়রের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যথাশীঘ্র যথারীতি ভবনের যথাস্থানে পাঠাগারটি পুনঃস্থাপন করে দেশে বিদেশে সৃষ্ট ক্ষোভ-প্রতিক্রিয়া ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান করবেন। আমরা মাননীয় মেয়রের আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।’

বিবৃতিদাতারা হলেন- লেখক, প্রবন্ধকার ও সাবেক টিভি প্রযোজক বেলাল বেগ, প্রবীণ সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক যুগভেরীর সাবেক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা ও উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র সহসভাপতি সুব্রত বিশ্বাস, সাপ্তাহিক প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকার সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী, জালালাবাদ এসোশিয়েসন, যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি হেলাল চৌধুরী, লেখক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও বাংলা একাডেমী পদকপ্রাপ্ত তাজুল মোহাম্মদ ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন আহমদ।
এছাড়াও গতকাল বুধবার (০১ সেপ্টেম্বর) দেশের ২৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক পাঠাগারটি প্রতিস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। তারা পাঠাগার অপসারণের প্রতিবাদও জানান।

এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক, সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, ত্যাগী রাজনীতিবিদ জননেতা পীর হবিবুর রহমানের নামে সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নামকরণকৃত ‘পীর হবিবুর রহমান পৌর পাঠাগার’ এর সাইনবোর্ডটি কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে। এই কলঙ্কজনক ঘটনা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন এ পর্যন্ত রহস্যজনক নিরবতা পালন করে চলেছে, যা উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সিলেটসহ দেশের সচেতন নাগরিকদের। সুরমা নদীর তীরে এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারটি নগরবাসীর জ্ঞানতৃষ্ণা মিটাতো। জননেতা ও প্রাক্তনমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের দান করা অনেক পুস্তক এই পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিল। এই পাঠাগারের জায়গায় নির্মিত বহুতল ভবনে পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারের কোন অস্তিত্ব নেই, সেই সঙ্গে অস্তিত্ব নেই শতাব্দীর জ্ঞান-সমৃদ্ধ অতি মূল্যবান গ্রন্থসমুহের। সিলেটের মাননীয় সিটি মেয়র, জেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, পীর হবিবুর রহমান পৌর পাঠাগারটি অপসারণ এবং এর সাইনবোর্ড অপসারণে কারা দায়ী, মূল্যবান গ্রন্থসমূহ সংরক্ষণে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- সর্বোপরি পাঠাগারটি কোথায় পুনস্থাপিত হলো-তা অবিলম্বে সিলেটবাসী সহ দেশবাসীকে অবহিত ও আশ্বস্ত করার দাবী জানাচ্ছি।’

বিবৃতিদাতারা হলেন- মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবীদ ড. হায়াত মাহমুদ, ইতিহাসবীদ ও শিক্ষাবীদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. সারওয়ার আলী, শিক্ষা আন্দোলন নেতা রাশেদা কে চৌধুরী, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহবুব, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ঐক্য পরিষদেও সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এম আকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তবারক হোসেইন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফৌজিয়া মোসলেম, উন্নয়নকর্মী খুশী কবির, নারীনেত্রী রোকেয়া কবির, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি এস এম এ সবুর, সভাপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পারভেজ হাসেম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের প্রো ভিসি ডা. শহীদউল্যা শিকদার, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. সেলুবাসিত, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি ড. সৈয়দ আবদুল্লা আল মামুন চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফয়েজ আহমেদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীশা, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেট জেলা শাখার আহ্বায়ক মুকির হোসেন চৌধুরী, পীর হবিবুর রহমান স্মৃতি পরিষদের সভাপতি সৈয়দ বেলায়েত আলী লিমন।

You might also like