বঙ্গবন্ধু ও নেতাজির ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন চর্চার বিকল্প নেই
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের পুরোগামী নেতা অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র উদ্যোগে ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনাকালে ওয়েবিনারে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘নেতাজী ও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন।নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ গবেষক ও শ্রী শিক্ষায়তন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা মৈত্রেয়ী সেনগুপ্ত, নির্মূল কমিটি নরওয়ে শাখার সভাপতি লেখক খোরশেদ আহমদ, নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, নির্মূল কমিটি আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক শহীদসন্তান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী শম্পা,নির্মূল কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ কামরুজ্জামান, নির্মূল কমিটি সিলেট শাখার আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চক্রবর্তী, নির্মূল কমিটি সুইজারল্যান্ড শাখার উপদেষ্টা ব্লগার অমি রহমান পিয়াল, নির্মূল কমিটি মানিকগঞ্জ শাখার সভাপতি এডভোকেট দীপক ঘোষ ও নির্মূল কমিটি খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মহেন্দ্রনাথ সেন।
বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বহুমাত্রিক অবদানের উল্লেখ করে আলোচনা সভার সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতার দর্শন প্রচারিত হচ্ছে। উগ্র ধর্মান্ধরা বিভিন্ন সময়ে ধর্মের নামে বলপ্রয়োগ, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডÑ এমনকি গণহত্যা সংঘটিত করলেও জনগণ সব সময় মানবতাবাদী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করেছে। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই শীর্ষ নেতা রাষ্ট্রনায়ক নেতাজী সুভাষ বসু এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রণোদনা ছিল আমাদের হাজার বছরের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন।
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্ত-রাষ্ট্রীয় সংঘাত, ছায়াযুদ্ধ, যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে ধর্মের নামে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ও রাজনীতি থেকে পৃথক রেখেছিলেন ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস, বিদ্বেষের অবসানের পাশাপাশি ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য। নেতাজী ও বঙ্গবন্ধু কেউই ধর্মবিরোধী ছিলেন না। তারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করলেও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন। নেতাজী ও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শনের গুরুত্ব বর্তমান সন্ত্রাস-সংঘাত কবলিত বিশ্বে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার চর্চা রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে অনুশীলন করতে হবে।
স্মারক বক্তৃতায় অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘উপমহাদেশের দুই প্রধান রাষ্ট্রনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে এক প্রজন্মের ব্যবধান থাকলেও, তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তায় “ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার দর্শন”ই ছিল প্রধান নিয়ামক। স্কুলজীবন থেকেই তারা উভয়ে ছিলেন প্রতিবাদী এবং আর্ত-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল, দরদী হৃদয়ের অধিকারী। তারা দুজনেই শৈশব থেকেই উদার, অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। যা তাঁদের পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়। নেতাজি জনগণের মধ্যে সত্যিকারের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি একাধিক বক্তৃতা এবং লেখনীতে ধর্ম এবং বর্ণ প্রথা নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৪৪ সালে তিনি সুস্পষ্টভাবে তার টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, স্বাধীন ভারত ধর্মীয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতহীন নীতি গ্রহণ করবে। এবং ধর্মের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তির বিশ্বাসের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বাধীন মতো ধর্ম পালন করতে পারবে।বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কল্যাণে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি এদেশের মাটি ও মানুষের উপযোগী করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ বিতর্কিত সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা দূর করে বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতার কালিমা লেপন করেছে। আজও বাংলাদেশ জিয়া ও এরশাদের ‘সামরিক সাম্প্রদায়িকতার’ কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।’
ভারতের নেতাজী গবেষক ও শ্রী শিক্ষায়তন কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপিকা মৈত্রেয়ী সেনগুপ্ত বলেন, ‘ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেছিলেন নেতাজী। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত- “আমার সোনার বাংলা” গানটিও নেতাজির খুব পছন্দের একটি গান ছিল। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হবার অনেক আগেই এ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এবং নেতাজির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় কিছু পার্থক্য থাকলেও মিলই বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধুও দেশ স্বাধীন করবার জন্য শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরা দুজনেই ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিতে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন- যেটি বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানে উল্লেখ করে গিয়েছেন। ফলে ভারত এবং বাংলাদেশের সমস্যাগুলো যেমন খুব অনুরূপ, পাশাপাশি সেগুলোর সমাধানও আমাদের দুই মহান রাজনৈতিক নেতা- নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে গিয়েছেন।অন্যান্য বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে জঙ্গি মৌলবাদের মূল উৎপাটন করতে হলে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপশক্তিকে পরাস্ত করতে না পারলে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সাম্যের ভিত্তিতে দেশ গড়ার স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না। একইসাথে বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে হলে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের নিরন্তর চর্চার কোনও বিকল্প নেই। অনলাইন এ আলোচনা সভার শেষে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জীবন ও কর্মের ওপর নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা সাইফ উদ্দিন রুবেল নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “নাইবা হলো পারে যাওয়া’ প্রদর্শিত হয়।