বন্যা-সিলেট অঞ্চলঃ কারণ ও প্রতিকার

সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই এ ৪টি নদীর প্রবাহ থেকেই বন্যায় প্লাবিত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। এগুলো বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের মণিপুর পাহাড়ের মাও সংসাং হতে বরাক নদীর উৎপত্তি। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি জকিগঞ্জের অমলসীদ নামক স্থানে এসে নদীটি দু’টো শাখায় বিভক্ত হয়। উত্তরের শাখাটি ‘সুরমা’ আর দক্ষিণের শাখাটি ‘কুশিয়ারা’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সুরমা-কুশিয়ারার ৩শ’ কিলোমিটার উজানে বরাকের উৎপত্তিস্থল প্রায় ৩৭৮ ফুট উপরে। এভাবে মনু ও খোয়াই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে নিম্নমুখী প্রবাহ নিয়ে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে কুশিয়ারায় মিলিত হয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদী সিলেট অঞ্চলে প্রবাহিত লংলা, গোয়াইন, পিয়াইন, সারী ইত্যাদি অন্যতম।
বর্ষায় কি পরিমান পানি এ নদীগুলোতে প্রবাহিত হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। শত শত বছর যাবৎ এসব অববাহিকায় যে পরিমান পানি প্রবাহিত হত এখনও তাই হয়। কিংবা বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে না হয়, একটু বেশিই হয়। কিন্তু বিগত প্রায় ১৫/২০ বছর যাবৎ এ নদীগুলোর বর্ষাকালিন প্রবাহ এ অঞ্চলের জনপদ ভাসিয়ে ধ্বংসলীলা চালায় কেন? এজন্য কি নদীগুলো দায়ী নাকি যারা আক্রান্ত তারা দায়ী। একটু ভাবুন।
এসব নদীর প্রচুর শাখা-প্রশাখা ছিল। যেসব শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের ছোট-বড় অসংখ্য হাওড়-বিল ইত্যাদি প্রাকৃতিক জলাধারে নদীগুলোর অতিরিক্ত পানি প্রবেশ করতো। এখন অনেক শাখা নদী ভরাট হয়ে গেছে, খাল ভরাট হয়ে গেছে। নদী বা খালের জায়গাও জবরদখল হয়ে গেছে। স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ কিংবা বাঁধাগ্রস্ত। এসব উদ্ধারের কোন উদ্যোগ নেই, কারো চিন্তাও নেই,এটাই প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ- বিগত ৪০ বছর যাবৎ চলমান ভোট ভাগানোর উন্নয়নের রাজনীতি। অপরিকল্পিত,অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে রাস্তা নির্মাণ, বাড়িঘর নির্মাণ ইত্যাদি হয়েছে। গ্রামের যে পথে নৌকা চলতো, সেখানে এখন দামী দামী জীপ গাড়ি চলে। পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে উন্নয়ন। যেখানে ১০০ ফুট ব্রিজ দরকার সেখানে ১০ফুট কালভার্ট, যেখানে কালভার্ট দরকার সেখানে সরাসরি রাস্তা নির্মাণ করে ভরাট করা হয়েছে।  জলাশয় ভরাট করে স্টেডিয়াম, ক্যান্টনমেন্ট, ইপিজেড, আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া লুটেরা রাজনীতির সুফলভোগী একশ্রেণীর কালো টাকার মালিক ভুমিখেকো, যারা অসংখ্য প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করে হাউজিং বা আবাসিক এলাকা স্থাপন করে কোটি টাকার লুপাট করছে। হাকালুকি, দেখার হাওড়ের মত জায়গায় মানববসতি গড়ে উঠেছে।
অতি সাম্প্রতিককালে খাদিম পরগণা থেকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা পূ্র্বে জৈন্তাপুরব্যাপী বিস্তৃত বিশাল হাওড় ভরাট করে নতুন ক্যান্টনম্যান্ট করা হয়েছে। সুরমা নদী থেকে কয়েকটি খাল কুশিঘাট থেকে বাঘার খালপাড় পর্যন্ত এই সীমার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ভরাট হওয়া হাওড়ে পড়েছিল, এরমধ্যে কুশীগাঙ (প্রচলিত ভাষায় কুই গাঙ)আছে। নতুন ক্যান্টনম্যান্টের জন্য হাওড় ভরাট হওয়ায় ছোট ছোট খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। শুধু কুশীগাঙে একটা কালভার্ট দেয়া হয়েছে। ক্যান্টনম্যান্ট হওয়ার পর কুশীঘাট থেকে মুরাদপুর, খালপাড় পর্যন্ত ১০/১৫ ফুট গভীর জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। এসব খাল ও কুশী নদী বর্ষায় সুরমা নদীর উপচে পড়া পানি প্রবাহিত করে ভরাট হয়ে যাওয়া হাওড় দিয়ে নিয়ে যেতো চিকনাগুলের কাপনা নদীতে। সেই পথ ধরে পানি ছড়িয়ে যেতো জৈন্তার হাওড় বিলে অর্থাৎ প্রাকৃতিক প্লাবণ ভুমিতে। বিগত প্রায় ৭/৮ বছর যাবৎ সুরমার অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেট নগর প্লাবিত হওয়ার এটাই অন্যতম প্রধান কারণ।
তৃতীয় কারণঃ পলিতে ভরে যাওয়া মূল নদীগুলো নিয়মিত ড্রেজিং না করা। এ রকম মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা-ই প্রতিবছরের নিয়মিত বন্যার উপজীব্য।
বন্যার কবল থেকে বাঁচতে, নাব্যতা নষ্ট হওয়া নদীগুলো বাঁচাতে পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে দ্রূত পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। না হলে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় স্থায়ী রূপ নেবে।
লেখকঃ কলামিস্ট, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং রাজনীতিবিদ
babulrq.syl@gmail.com
১৯.০৬.২০২৪

You might also like