বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা,দেশ বিরোধী ও সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রেরই অংশ – নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনায় নেতৃবৃন্দ

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

নিউইয়র্কঃ ১৯৯২ সালে যে আন্দোলন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শুরু করেছিলেন, মূলত সেই আন্দোলনের কারণেই বাঙ্গালী জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে এক হতে পেরেছিলেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করতে পেরেছিলেন বলে উল্লেখ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় আলোচকবৃন্দ।

গত ২২শে জানুয়ারি ২০২২ শনিবার জুম কনফারেন্সে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনের নিউইয়র্ক চ্যাপ্টারের সভাপতি ফাহিম রেজা নুরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ নুরুন নবী বলেন, শহীদ জননীর জীবন ও আন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে অবহিত করতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি কখনোই ভাবিনি যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাকে দেখতে হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাকে অত্যন্ত ব্যতীত করে। অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি বলেই আজ এমনটি হচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, এই সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে – সোশাল মিডিয়াতে মিথ্যাচার করে স্বাধীনতা বিরোধীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধু যেমন তার আদর্শে ইস্পাত কঠিন ছিলেন, শহীদ জননী যেমন আদর্শকে ধরে রেখে জাতিকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন, আমাদেরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শকে ধারণ করে দেশবিরোধী ও সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করতে হবে।

প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ তার আলোচনায় শহীদ জননীর লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এনি ফ্রাঙ্কের ডাইরির সাথে তুলনা করে বলেন, বইটি আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যেতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাথে সাথে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মাধ্যমে শহীদ জননী শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী না, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপড়ে। এর অন্যতম কারণ ৭২ -এর সংবিধান প্রণয়নের দাবি থেকে অনেক দুরে সরে গিয়ে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বেশি।১৯৭১ একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিচ্ছু বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক ডঃ মহসিন আলী বলেন বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কিছু বলা যেত না, স্বাধীনতা বিরোধীরা যখন সারাদেশে আস্ফালন দেখাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এই সংগঠনের আন্দোলনে শুরু করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু একথা সত্য আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে জাতীয়ভাবে যথাযত সম্মান দিতে পারিনি। আগামী প্রজন্ম যেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ত্যাগের কথা জানতে পারে সেই ব্যবস্থা ও প্রচেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।

সংগঠনের উপদেষ্টা ও সাপ্তাহিক বাঙ্গালির সম্পাদক কৌশিক আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে যদি দ্বিতীয় কোন মহান ঘটনা থাকে সেটি ছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন ও এই সংগঠনের আন্দোলনের সূচনা। দুঃখের বিষয় হল এই যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতি সর্বস্তরের মানুষের যে শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ ছিল, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যেভাবে পালিত হওয়া কথা, তা কিন্তু হয়না।১৯৭১ সালে আমদের যা অর্জন ছিল, ১৯৭৫ সালে পরে সেই অর্জনের অনেকটাই আমরা হারিয়েছিলাম, কিন্তু সেই হারিয়েফেলাকে আবার পুনরুদ্ধার করার যে প্রচেষ্টা বা সক্রিয়তা, সেটা হত না যদি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সেই হাল না ধরতেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর মত এক বিশাল ত্যাগী নেতার যথাযত মূল্যায়ন যেভাবে করতে পারিনি, সেভাবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকেও যথাযত মূল্যায়ন করতে পারিনি। এই সংগঠনের আন্দোলনের যে গুরুত্ব ছিল, আন্দোলনের কিছুটা সুফল যে আমরা পেয়েছি এবং ভবিষ্যতে আরও সুফল যে আমাদের পেতে হবে সেই বিষয়গুলো বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

ঢাকা থেকে সংযুক্ত সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল তার বক্তব্যে বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তররের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আমি মনে করে তার পরিপূর্ণ সুফল আমরা এখনো পাইনি। কারণ শুধু শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, কিন্তু তাদের সহযোগী এবং দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের কাজ আমরা এখনো সম্পন্ন করতে পারিনি। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ,কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করা। জিয়া এবং এরশাদ সরকার সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশে অনেক দুরে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেই লক্ষ্যকে আবার পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের মাঠে নামতে হবে এবং মাঠে থাকতে হবে।

ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সংযুক্ত বঙ্গবন্ধু পরিষদ ক্যালিফোর্নিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক রানা মাহমুদ যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী এবং যুদ্ধাপরাধী আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেন। সুইডেন থেকে সংযুক্ত সর্ব ইউরোপীয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি তরুণ চৌধুরী বলেন বাংলাদেশের বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন। শিক্ষা ব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জাহানারা ইমাম, জাতীয়তাবাদ, মানবিক মূল্যবোধ ও সহনশীলতার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা না হলে এর পরিণাম আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।সভায় আরও সংযুক্ত ছিলেন সংগঠনের সহসভাপতি যথাক্রমে অধ্যাপিকা নাজনিন সিমন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির হোসেন, সহ সাধারণ সম্পাদক শুভ রায়, জাকির হোসেন বাচ্চু, অধ্যাপক সাহদাত হাসান, সুইডেন থেকে মশিউল আলম, প্রমুখ। আলোচণা সভার সঞ্চালনায় ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, নিউইয়র্কের সাধারণ সম্পাদক স্বীকৃতি বড়ুয়া।

You might also like