‘বাঙালি অভিবাসীদের জীবন সংগ্রামের অনবদ্য দলিল’: বাঙালি-ব্রিটিশ লেখক সাবনা বেগমের ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফিল্ডস’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান
বিশেষ প্রতিবেদন
সত্যবাণী
লন্ডন, ১৮ মার্চ: বাঙালি-ব্রিটিশ লেখক সাবনা বেগমের ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফিল্ডস’ গ্রন্থের প্রকাশনানুষ্ঠানে গ্রন্থখানা বাঙালি অভিবাসী-জীবনের সংগ্রামের অনবদ্য দলিল বলে মন্তব্য করেছেন প্যানেল আলোচকবৃন্দ।
গত ১৪ মার্চ বিশপসগেইট ইনস্টিটিউটের গ্রান্ড লাইব্রেরী হলে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন সত্তর দশকের স্কোয়ার্টারাস ও আবাসন আন্দোলনের অন্যতম প্রবীন ব্যক্তিত্ব, লেখক ও গবেষক তাজ আলী। আরো ছিলেন আবাসন আন্দোলনের অন্যতম নেতা মো. গোলাম এহিয়া খসরু, গোল্ডসমিথ কলেজের এডুকেশন স্টাডিজের লেকচারার, বাঙালির অভিবাসন সংগ্রাম এবং আত্মপরিচয় নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিত্ব আমিনুল হক।
গ্রন্থের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান লোরেন্স উইশার্ট-এর জুমানা ইউনিসের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে বাঙালি ও মূলধারাসহ ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের গবেষক, লেখক ও অনুসন্ধানী পাঠকের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। দুই পর্বে অনুষ্ঠিত প্রকাশনানুষ্ঠানে প্রথমপর্বে গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা, পরে ছিল প্রশ্নোত্তরপর্ব।
উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতার প্রশ্নোত্তরপর্ব ও আলোচনা পর্বে লেখক সাবনা বেগম বাঙালি কমিউনিটির সত্তর দশক শুধু নয়, তার গবেষণায় উঠে আসা অভিবাসী সংগ্রামের নানা তথ্য ও লোমহর্ষক ঘটনাবলির বর্ণনা দেন। সাবনা বেগম সম্প্রতি লন্ডনের কুইনমেরী ইউনির্ভাসিটি থেকে সত্তর দশকে আবাসন সংকটে-পড়া বাঙালির স্কোয়াটারার্স ও স্কোয়াটিং করে ঘরের তালা ভেঙে ঘর দখল করার সংগ্রাম ও আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার এই গবেষণা নিয়ে ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফিল্ডস’ গ্রন্থখানা প্রকাশ করেছে বিলাতের বিখ্যাত পাবলিশার্স ‘লোরেন্স উইশার্ট’।
প্রবীন ব্যক্তিত্ব লেখক ও গবেষক তাজ আলী সত্তর দশকে সংঘটিত বর্ণবাদ ও আবাসন সংকট সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, তখন বাঙালিরা ছিল ব্রিটেনে ভাসমান একটি অভিবাসীপ্রত্যাশী সম্প্রদায়। মানবেতরভাবে জীবনযাপনকরা এই বাঙালিদের খালিঘর থাকা স্বত্বেও কোনো ঘর দেওয়া হতো না। এটা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ। এছাড়া রাস্তাঘাটে চলাচল ছিল দু:সাধ্য। বর্ণবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্ট যেখানে-সেখানে আমাদের লোকদের মারধর করতো, এমনকি অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। এরকম একটি বর্ণবাদী আক্রমনের শিকার হয়ে আলতাব আলী নামক গার্মেন্টসকর্মী পূর্ব লন্ডনের এলডার স্ট্রিটে নিহত হন। গৃহহীন বাঙালিরা পূর্ব লন্ডন শুধু নয়, অন্যান্য বারায়ও নিরুপায় হয়ে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছেন। সাবনা বেগম বলেন, পূর্ব লন্ডনের ডীল স্ট্রিটের একটি স্কোয়াটিংকরা ঘরে তার জন্ম হয়েছে। তিনি তার পিতার নিকট থেকে সে সময়ে তাদের পরিবার ও অন্যান্য বাঙালিদের অবর্ণনীয় দু:খ-কষ্টের বর্ণনা শুনেছেন। বাঙালির জীবন সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হওয়া থেকেই তার আগ্রহ জাগে গবেষণা কাজের। প্রায় চার বছর তিনি বাঙালির এই সংগ্রাম সম্পর্কে ভুক্তভোগী নানা মানুষ ও পরিবারের সঙ্গে দেখাকরা,আলাপ, সংগ্রামকরা ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার ও তথ্য সংগ্রহ করেই গবেষণাকাজ সম্পন্ন করেন। তিনি বলেন, আমি যতই মানুষের কাছে তাদের সংগ্রামের কথা শুনেছি, ততই আমি বিস্মিত হয়েছি, সেদিনগুলো কত ভয়ংকর ছিল। আমাদের নতুন ও আগামী প্রজন্ম আমার এ কাজ থেকে প্রকৃত ইতিহাস জেনে যদি সামান্য উপকৃত হয়, তবে আমি তৃপ্তিবোধ করবো।
প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্নরাখা হয়, আবাসন সংকট সমাধান কোন আন্দোলনে সফল হয়। সাবনা বলেন, আমার গবেষণায় উঠে এসেছে বা আমি যে তথ্য পেয়েছি, তাতে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি যুব সম্প্রদায়সহ সাধারণ বাঙালির কয়েকটি সংগঠন প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এবং আবাসনসংকট সমাধানসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগসুবিধা আদায়ে লাগাতার আন্দোলন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের অভিবাসী বাঙালি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় দু শতাধিক শ্রোতা ও দর্শক এক আবেগঘন পরিবেশ ব্রিটেনে বাঙালি অভিবাসনের তথ্যবহুল কাহিনি শুনেন এবং করতালির মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করে তুলেন। উপস্থিত শ্রোতারা পরিবেশিত হালকা খাবার গ্রহণ এবং পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে বিক্রয়ের জন্য টেবিলে সংরক্ষিত ‘ফ্রম সিলেট টু স্পিটালফিল্ডস’ গ্রন্থখানা ক্রয় করেন এবং লেখক সাবনা বেগমের অটোগ্রাফ নেন লাইনধরে একে একে। এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। জানা গেছে, প্রায় শতাধিক গ্রন্থ এদিন বিক্রয় হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত ৯টায়।
উল্লেখ্য, সাবনা বেগমের পৈত্রিক বাড়ি ছাতক উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নের চেলারচর গ্রামে। পিতা আবদুল মছব্বির ও মাতা গুলজাহান বেগম। এছাড়া সাবনা বেগম কবি হামিদ মোহাম্মদের ভাতিজি। ৭ ভাইবোনের মধ্যে সাবনা দ্বিতীয়। লন্ডনের ওয়ালথামের বাসিন্দা সাবনা বেগম দীর্ঘদিন ইজলিংটনের একটি সিক্সথফরম স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।