বিজয় দিবসে আজও পরিবারের সদস্যদের খুঁজে ফেরেন ধর্মেন্দু
রক্তিম দাশ কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, কলকাতা
কলকাতা থেকে: বিশ্বের মানচিত্রে যখন জন্ম নিচ্ছে নতুন দেশ। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ৯.৩০টায় যখন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান নিয়াজি মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় সেনার যৌথবাহিনীর প্রধান অরোরা কাছে আত্বসর্মপনের প্রস্তুতি চলছিল। ঠিক তখনই সিলেট শহরের মির্জা জাঙ্গলের ডা. দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দোর বাড়ি কেঁপে উঠল ভয়ঙ্কর এক মর্টার বিস্ফোরণে। মুহুর্তের মধ্যে এন্দো পরিবারের ৮ সদস্য শহিদ হলেন। আজও শেষ দিনটির কথা স্মরণ করলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেদিনের স্বজনহারা পরিবারের জীবিত সন্তান কলকাতায় বসবাসরত ধর্মেন্দু কুমার এন্দ বাপ্পু।
সিলেট মিউনিসিপালটির অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ছিলেন দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিলেট শহর ছিড়ে তিনি যাননি মাতৃভূমির টানে। গোপানে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। সেসময় শহরে থাকা মানুষদের আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন আশা-ভরসা। সেদিন সকালে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য রেডিওতে কান পেতে ছিলেন দিগেন্দ্র চন্দ্র। আর ঠিক তখনই তাঁর বাড়িতে এসে পড়া মর্টারের একটি গোলা নিমেষে প্রাণ কেড়ে নেয় তাঁর এবং স্ত্রী সুরুচি বালা, তাঁর বেয়াই গোপেশ দাসের। মারত্বক আহত হয়ে হাসপাতালে বিকালে মারা যান দিগেন্দ্র চন্দ্রর ছেলে দীপ্তেন্দ্র,মেয়ে শিখা এবং নাতি অপু মারা যায়। ৭ দিন পরে মারা যান আর এক মেয়ে শিবানী,বউমা খণা এবং নাতনি পম্পা। দিগেন্দ্র চন্দ্রর মেজ ছেলে মর্টারের আঘাতে বা হাত চিরদিনের চন্য অকেজো হয়ে যায়।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে দিগেন্দ্র চন্দ্র এন্দর নাতি এবং দীপ্তেন্দ্রর একমাত্র জীবিত ছেলে কলকাতার বিজয়গড়ের বাসীন্দা ধর্মেন্দু এন্দ বলেন,‘ আমার পরিবারের ৯ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের অন্তিমক্ষণে এসে শহিদ হলেও আজও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনও স্বীকৃতি মেলেনি। মুক্তিযুদ্ধে একই পরিবারে এই ভাবে মৃত্যুও ঘটেনি। আজ সিলেট শহরে আমাদের বাড়ি ভাগাড়ে পরিনত। কেউ কোনও স্বীকৃতি দেয়নি। আমি সেদিন ঘটনাক্রমে বাড়ির বাইরে ছিলাম বলে বেঁচে যায়। আমার ছোট বোন সম্পা পাশের ঘরে ছিল বলে ও বেঁচে যায়। আমার আর কাকার ছেলে প্রতীকও বাইরে ছিল বলে রক্ষা পেয়েছিল।’
ধর্মেন্দু বলেন,‘ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সম্পা এন্দকে সিলেট থেকে কলকাতায় দমদমে আমার পিসির বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর আমি ঢাকায় মামার বাড়িতে চলে আসি। পড়াশোনা শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমার প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি। এখন আমি ভারতের নাগরিক। তবু প্রতি ১৬ ডিসেম্বর আসলে আমি বিজয় নয় শোকদিবস পালন করি আমার পরিবারের শহিদদের স্মৃতিতে। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমি আমার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকেই হারিয়েছি। আর দেশকে স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্ত করতে গিয়ে দেশ ছাড়া হয়েছি। আমার পরিবারেরই আত্মত্যাগকে যদি বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিত তাহলে আমার এই কষ্টের জীবনে কিছুটা হলেও ভাল লাগত।’