ব্রিকলেন ১৯৭৮, ঘুরে দাড়ানোর সময়ঃ লন্ডনে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের চিত্র প্রদর্শনীর উদ্ভোধন

মতিয়ার চৌধুরী
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সত্যবাণী

লন্ডনঃ গতকাল ৯ই জুন বিকেলে পূর্ব লন্ডনের বেথনালগ্রীনের ফোরকর্ণাস গ্যালারীতে আনুষ্টানিক ভাবে উদ্বোধন করা হলো ‘ব্রিকলেন ১৯৭৮, ঘুড়ে দাঁড়ানোর সময়’ নামের চিত্র প্রদর্শনীর। প্রদর্শনী চলবে ১০ জুন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, সকলের জন্যে প্রবেশাধিকার ফ্রি। খোলার সময় সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা । মঙ্গল  থেকে শনিবার, বৃহস্প্রতিবার  রাত ৮টা।  ফোর কর্নাস গ্যালারী  ১২১ রমান রোড, বেথনালগ্রীণ , লন্ডন লন্ডন-ই২  ওকিউএন।  নিকটবর্তি আন্ডার গ্রাউড ষ্টেশন বেথনাল গ্রীণ-সেন্ট্রেল লাইন। সে সময়কার ফটোগ্রাফার পলট্রেভারের ক্যামেরায় ধারনকৃত ৭০টি ঐতিহাসিক ছবি এই প্রদর্শনীতে স্থান পাচ্ছে। ন্যাশনাল লটারী হেরিটেজ ফান্ডের সহয়োগীতায় প্রদর্শনীর আয়োজন করছে ফোরকর্ণাস গ্যালারী, স্বাধীনতা ট্রাষ্ট ও আলতাব আলী ফাউন্ডেশন।

 অনুষ্বঠানে  কথা বলছেন , কার্লা মিচেল, পলট্রেভার, নুরুদ্দিন আহমদ, জুলিবেগম ও আনসার আহমেদ উল্লাহ।

উদ্ভোধনী অনুষ্টানে আয়োজনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন  ফটোগ্রাফার পলট্রেভার, স্বাধীনতা ট্রাষ্টর জুলি বেগম, আনসার আহমেদ উল্লাহ, আলতাব আলী ফাউন্ডেশনের পরিচালক নূরুদ্দিন আহমদ, ও ফোর কর্নারের আর্টিকষ্টিক ডেভল্যপমেন্ট পরিচালক কার্লা মিচেল। সেময় ব্রিটিশ বাঙ্গালীদের যারা  বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন অনেকেই আর ইহজগতে নেই,  যারা এখনও জীবিত আছেন , তাদের কয়েকজন উপস্থিত হয়েছিলেন উদ্ভোধনী অনুষ্টানে। তাদের মধ্যে, সেদিন বাঙ্গালীদের পাশে যে কয়েকজন ইংরেজ দাড়িয়েছিলেন তাদের অন্যতম ডেনিস জোন, সাবেক ডেপুটি মেয়র আকিকুর রহমান, সাবেক কাউন্সিলার সোনাহর আলী, সাবেক মেয়র ছয়ফুল আলম, সাবেক কাউন্সিলার ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ রাজন উদ্দিন জালাল, জামাল আহমদ, সাবেক মেয়র আব্দুল মুকিত চুনু এমবিই, রফিক উল্লাহ প্রমুখ। বক্তা এবং আন্দোলনকারীরা বলেন ১৯৭৮ এর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন ব্রিটিশ সামাজিক ইতিহাসের একটি অংশ, ‍১৯৭৮ এর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঘটনাটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তির দাবী জানান তারা

ঐতিহাসিক ঘটনার নেপথ্যে

১৯৭৮ সালের শুরুর দিকে  ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা মারগারেট থ্যাচার  ‘ ‘‘ওয়ার্ড ইন এ্যকশন‘‘ নামক একটি টেলিভিশন পোগ্রামে বলেছিলেন ব্রিটিশদের একটি অংশ মনে করে ব্রিটেনে আগত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অভিবাসীদের কারনে তাদের কৃষ্টি ক্যালচার হুমকীর মুখে পড়বে। এই মন্তব্যটি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর ব্রিটেনের বর্ণবাদী ন্যাশনাল ফন্ট ও অন্যান্য বর্ণবাদিরা সমগ্র ব্রিটেন তথা ইষ্টলন্ডনের ব্রিকলেন ও তার আশপাশ এলাকায় বাঙ্গালী অভিবাসীদের উপর ক্রমাগতভাবে  শারিরিক আক্রমণ ও বর্ণবাদী আচরন চালাতে থাকে। বিশেষ করে স্কীনহেডদের আক্রমন বাড়তে থাকে । এসময় সমগ্র বিটেনে চাকুরী ও আবাসিক সমস্যা ছিল প্রকট। তার আগে মাইগ্রেন্ট ইহুদী সম্প্রদায়কেও একই সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছে। ন্যাশনাল ফন্টের মুখপত্র ‘‘ পিস এট ব্রিকলেন, মাইগ্রেন্ট সম্প্রদায়কে নিয়ে উসকানী দেয়, বিশেষ করে রোববার সকালে স্কিনহেডরা বাঙ্গালীদের উপর আক্রমন চালায়। সেসময়কার বাঙ্গালীরা কেউ একা রাস্তায় বের হতেননা। অতিডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির লক্ষ্যবস্তু, যারা উচ্চ বেকারত্ব এবং খারাপআবাসনের জন্য তাদের ভুলভাবে দোষারোপ করেছিল। ইষ্টএন্ড বিশেষ করে পূর্ব লন্ডন সকল সময়ই মাইগ্রেন্ট কমিউনিটির জন্য চিল উম্মুক্ত। ১৭ শতকের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা ফরাসীহুগুয়েনটস থেকে শুরু করে ১৯ শতকের আইরিশ দরিদ্র এবং রাশিয়া পোল্যান্ডে কস্যাক পোগ্রোম থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের জন্য পূর্বলন্ডন সর্বদাই অভিবাসীদের আশ্রয়স্থল। এটির বর্ণবাদী সহিংসতাএবং প্রতিরোধের সমান দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।  ওয়াজওয়াল মজলির নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইউনিয়ন অফ ফ্যাসিস্ট ১৯৩৬ সালে ডকের দিকে পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বিখ্যাতকেবল স্ট্রিটেরযুদ্ধেইহুদি, আইরিশ ডকার এবং কমিউনিস্টদের দ্বারা বাধা দেওয়াহয়েছিল। যা ভেটল অব ক্যালষ্টীট নামে পরিচিত।

১৯৭৮ সালের ৪টা মে গারমেন্টস শ্রমিক আলতাব আলীরহত্যাকান্ডের সয়য় স্থানীয় নির্বাচন যেখানে ৪১ জন বর্ণবাদী ন্যাশনালফ্রন্ট প্রার্থী দাঁড়িয়েছিল, বাঙালি সম্প্রদায়ের জন্য   একটি টার্নিংপয়েন্ট চিহ্নিত করেছিল।  যে দিন আলতাব আলী বর্ণবাদীদের হাতে খুন হন। ঐদিন ছিল স্থায়ীয় নির্বাচন। এই ঘটনার পর বাঙ্গালী সহ সকল মাইগ্রেন্ট কমিউনিটির মানুষ ঐক্যব্দ হয়, গড়ে তোলে প্রতিরোধ। ১৪মে আলতাব আলীর কফিন নিয়ে সাতহাজার মানুষ হাইড পার্ক হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে  গিয়ে  স্মারক লিপি প্রদান করে দশ নং ডাইনিং ষ্ট্রীটে।  এবছরই ব্রিটেনের  বাঙ্গালী যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।  এন্টি রেসিষ্ট মৃভমেন্টের কারনে ইষ্টলন্ডন থেকে বর্নবাদ  বিশেষ করে ন্যাশনফন্ট , পাররাইট পিচু হটতে বাধ্য হয়।  স্থানীয় ফটোগ্রাফার পল ট্রেভর ৪০০টিরও বেশি ফটোগ্রাফে বর্নবাদীদের নাটকীয় ঘটনাগুলি তুলে ধরেছেন তার আলোক চিত্রে। যার মধ্যে অনেকগুলি এই প্রদর্শনীতেপ্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হবে৷ তার ছবিতে ফুটে উঠেছে কীভাবেস্থানীয় বাঙালি সম্প্রদায় সেসময় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছেন। জাতিগত নির্যাতন সহ্য করেছিল এবং কীভাবে তারা সহিংসতা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের

১৯৭৮এর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া কয়েকজন

 

যদিও ব্রিটেনের বাঙালীদের  আগমন ঘটে আজ থেকে আড়াইশ বছরআগে। কারো কারো মতে তারও আগে ইতিহাসবিদদের অনেকেইমনে করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পেনী ভারতে যাবার পর থেকেই বঙ্গালী সহভারতীদের ব্রিটেনে আগম শুরু হয়। তবে তা সহজ ছিলনা। প্রথমএবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাজার হাজার বাঙ্গালী ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধকরেছে, বহু জায়গায় বিশেষ করে টাওয়ারহিল মেমোরিয়ালে বিশ্বযুদ্ধেবাঙ্গালীদের ত্যাগের কথা নাম সহ খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে ব্রিটেনেদশ লক্ষাধিক বাঙ্গালীর বসবাস। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রয়েছেবাঙালীদের প্রতিনিধিত্ব, সমগ্র ব্রিটেন থেকে এবছরও প্রায় চারশতাধিক বাঙ্গালী কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়েছেন।অফিস আদালতসহ মেইনষ্টীমে বাঙ্গালীদের অবস্থান। শুধু তাই নয়  ব্রিটেনেরবহুজাতিক সমাজে আমাদের ভাষা সংস্কৃতিরও পরিচিতি ঘটেছে।সমগ্র ব্রিটেনে তৈরী করা হয়েছে অসংখ্য শহীদ মিনার। রাস্থায়ইংরেজীর পাশাপপাশি বাংলা লিখা শোভা পাচ্ছে।  ভারত বাংলাদেশের পরে রাজধানী লন্ডন শহরকে বলা হয় তৃতীয় বাংলা।আর এটি সম্ভব হয়েছে বাঙ্গালীদের ত্যাগের বিনিময়ে।

You might also like