মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

॥দশ॥

কোন একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া একটি লেখা সম্পর্কে বাবা আমার সাথে আলোচনা করতে আমাকে ফোন করেন। আমি বাংলাদেশে হাসপাতালের কাজে এক ধরণের বোধ হয়ে পড়ে আছি। আশপাশে ঘটে যাওয়া বা দেশে ঘটে-যাওয়া অনেক বিষয়ই ব্যস্ততায় চোখে পড়ে না। তিনি বলতে চাইলেন, শাহজালাল বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সব অঘটন ঘটে চলছে সম্প্রতি। তিনি বললেন, আমাদের প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংশ হতে দেখলে কষ্ট পাই। একে ধ্বংশ করে ফেলা হচ্ছে। ধ্বংশের জন্য কলুষ রাজনীতির দাপটই দায়ী।

লেখাটির শিরোনাম—‘‘ড.মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথার প্রতিধ্বনি: ছাত্রদের দোষ নেই, দোষ আমাদেরই’

ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের সোনালী জীবনের ক্ষতির কথা ভেবে অনুতপ্ত হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য  ছাত্রদের তো দোষ নেই, দোষ যে বা যারা এদের ব্যবহার করেছে বা লেলিয়ে দিয়েছে, তাদের। তাঁর দাবী যারা বা যিনি লেলিয়ে দিয়েছেন তার শাস্তির ব্যবস্থা কেন না করে নিরীহ ছাত্রদের জীবন থেকে সোনালী সময়টি কেড়ে নেয়া হল বা হচ্ছে।

তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনার ছাত্রলীগ থেকে আগাছা পরিষ্কার করার বক্তব্যের বিরোধিতা করেও বলেছেন, এদের আমাদের কাছে দেন আমরা  মাথায় হাত বুলিয়ে ভালো করে নেবো। এই বাচ্চাদের দোষ নেই, এদের যা বলা হবে, তাই তারা করে। অনেক সময় না বুঝে অন্যের প্ররোচনায় আবেগ তাড়িত হয়। যা-তা  গোলমেলে করে ফেলে। পরে যখন ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়।

অনেকে বলবেন জানি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল কত কিছু না জানেন। ছাত্রদের ঠোঁটে ওঠার জন্য নতুন ফঁন্দি এটেছেন, নতুন চাল চালছেন, ফাঁদ ফেঁদেছেন ইত্যাদি। মূলত এসব বলা খুব সহজ। কোনো কিছু বলতে চাইলে মুখ ধরে করো আটকানো যায় না।

কিন্তু আমরা জানি, একজন শিক্ষক চাকরি নেন এই ব্রত নিয়েই, অবুঝ সন্তানদের মানুষ বানাবেন। এটা সব শিক্ষকের প্রথম প্রতিজ্ঞা বা অঙ্গীকার থাকেই। যুগযন্ত্রনায় অনেক কিছু করা অনেক শিক্ষকের বেলায় সম্ভব হয় না। কিন্তু আমাদের ভাবতে দোষ কি, যে শিক্ষক একটি বাক্য শেখালেন বা একটি ছোট্ট স্বপ্ন দেখালেন একটি ছাত্রকে, আর সে স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে এই ছাত্রটি নিজ  জীবনে বাস্তাবায়ন করলো নীরবে-যে আলো দেখলো সে, তার চেয়ে সুন্দর এবং মহান কী প্রাপ্তি হতে পারে? এই প্রতিধ্বনিই তো জাফর ইকবালের কণ্ঠ থেকে ঝরেছে, হয়েছে ধ্বনিত।

আমরা জানি এবং জানিয়ে দিতে চাইÑ আমরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করছি রাজনীতিবিদদের বা রাজনীতিকে পাহারা দিতে। এটা ছিল আমাদের মূল কাজ। কতটুকু সফল হয়েছে, জানি না। তবে তৃপ্তি এটাইÑযুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। অপরাধীরা তাদের প্রাপ্য শাস্তি পাচ্ছে। দেশে সামাজ্যবাদ ও মৌলবাদের আষ্ফালন রুখে দিতে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমেই একধাপ এগিয়েছে মনে করি।

এই কথার পর বা প্রসঙ্গক্রমে এখন আরও পেছন দিকে যেতেই হয়।  সম্পতি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছোট্ট এই কথাটি বলে আমাকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছেন। বড় বৃক্ষ ধরে তিনি নাড়া দিয়েছেন। বৃক্ষটি—‘ছাত্রদেরকে ব্যবহার করার সংস্কৃতি’।

ছাত্রসমাজ নতুন নির্মাণের চাবিকাঠি। নতুন নির্মাণের জন্য তৈরিও করা হয়। জ্ঞানবিজ্ঞান সমাজ সব কিছুতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয় উপযুক্ত করে। এটা করেন শিক্ষকরা, অভিভাবকরা। এই নির্মাণের আশা-ই সবার। এ জন্যই বিদ্যাপীঠ গড়ে তোলা হয়। শত কোটি অংকের অর্থ ব্যয় করা হয় এর পেছনে। যারাই এই নির্মাণকে ভয় পায় তারাই এসব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে মানুষ হতে আসা কোমলমতি বাচ্চাদের মেনে নিতে পারে না। ধ্বংশ করে দিতে চায় তার স্বার্থে,প্রতিষ্ঠান ও বাচ্চাদেরকে। যুগপৎভাবে লোভ লালসায় ফেলে ব্যবহার করা, আত্মঘাতি করার ভেতর দিয়ে অন্ধকুপে ছেড়ে দেয়। ইতিহাস জানে, বঙ্গভূমিতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম নায়ক ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ার খিলজি যতটা-না হিন্দু রাজা লক্ষণসেনকে ভয় করেছিলেন তার চেয়ে বেশি ভয় করেছিলেন বিদ্যাপীঠকে। লক্ষণসেনকে পরাজিত করার পরও, তিনি বিশ্বসভ্যতার হাজার বছরের প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালকে ধ্বংশস্তুপে পরিণত করেছিলেন। এই দাগ বা ক্ষত বাঙালি এখনো বহন করছে।

বর্তমানে কী দেখি। আমরা কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে নিপতিত  হলাম? আমাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধ্বংশ করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে? ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থীদের বিপথে ঠেলে দিয়ে সমাজকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করার মহাযজ্ঞ চলছে কি না?

ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন,বাংলাভাগ,পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সব শেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি যা অর্জন করলো তা তো আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এসবের পুরোভাগে তো ছিল আমাদের প্রিয় ছাত্র ও য্বু সমাজ। এই ছাত্র সমাজের ভেতর থেকেই তৈরি হয়েছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সুভাষ বসু,চিত্তরঞ্জন দাশ, একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল মূল প্রাণশক্তি তরুণ ও যুব সমাজ। যার প্রধান অংশ ছিল ছাত্র সমাজ। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরেও দেখেছি, ছাত্রসমাজকে শত বাঁধাবিপত্তির মুখে এগিয়ে যেতে। তখনকার ছাত্ররাজনীতি ছিল জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবী-দাওয়া ভিত্তিক। যেভাবে ৬২,৬৯এর জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের প্রধান দাবী ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির পক্ষে। এভাবে ৯০এর দশকে দেখেছি, মজিদখান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে।

কিন্তু ৯০এর পর থেকে আর থাকল না ছাত্রদের নিজ দাবী নিয়ে রাজনীতি করার সংস্কৃতি। বাদ গেল সব। বাদ গেল ছাত্র সংসদ নির্বাচন। শুরু হল কর্তৃত্ববাদিতা। কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সন্ত্রাস জেঁকে বসল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। নির্বাচনের মাধ্যমে মেধাভিত্তিক ছাত্রনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজনের বদলে পেশিভিত্তিক রাজনীতির আমদানি ঘটল। কারা ঘটালো? সহজ উত্তরÑযারা জ্ঞানের বদলে অর্থের প্রয়োজন মনে করলÑজ্ঞানকে যারা ভয় করে তারা।

আর ধ্বংশ করার মূল যন্ত্রটির মালিক আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তারা যে সন্তান বা যে ছাত্র অথবা যে পোষ্য ছাত্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে অর্থের যোগান দেবে তাকেই নেতৃত্বে বসাতে সচেষ্ট হলেন। জ্ঞানের পূজার বদলে শক্তির পূজা শুরু হল। কেননা, নেতাদের নির্বাচনে কোটি টাকার প্রয়োজন। ভোট পাওয়ার জন্য রাজনীতি আর দরকার নেই। অর্থের বিনিময়ে ভোটের ব্যবস্থা বা ভোট কন্ট্রোল করার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার শুরু। শুরু হল সর্বক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

এই ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সর্বগ্রাসী সংস্কৃতির শিকার শাবির এই বাচ্চা ছাত্ররা। কার মা বাবা কাঁদল আর কাঁদল না, সেটা কারো যায় আসে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে কর্তৃত্ববাদি রাজনীতির বলি যে সব ছাত্ররা অতীতেও হয়েছে, ছাত্রত্ব নষ্ট হয়েছে বা প্রাণ হারিয়েছে, বাবা-মার স্বপ্ন নিমেষেই ধুলিস্যাৎ হয়েছে, কেউ খবর রাখেনি। আর এই ক্ষতি তাদের দোষে নয়, কর্তৃত্ববাদি রাজনীতির দোষেই। এই হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের বেদনাতুর বাবা-মা ভাই বা বোনেরাও এক সময় স্বপ্নহারা হয়ে হারিয়ে গেছে। তাদেরও কেউ খোঁজ রাখেনি।

তাই, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে বলতে শুনি,‘আগাছাদের আমাকে দিন, আমি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ভালো করে নেবো। এদের দোষ নেই। এই ভালো করে নেয়া তার একার দায়িত্ব নয়Ñসব শিক্ষকেরই। এই প্রতিধ্বনিই তার কণ্ঠে। ছাত্রসমাজ দোষ করতে পারে না। তাকে দিয়ে দোষ করানো হচ্ছে। এই দোষ করানো আমরা ছেড়ে দিলেই ছাত্ররা ভালো হয়ে যাবে। কেননা, সে তো শিখতেই এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে এসেছে। এসেছে মানুষ হতে। আসুন, আর দেরি নয়Ñআমাদের সন্তানদের আমরা মানুষ হতে সুযোগ করে দিই।’ (চলবে)

You might also like