লন্ডনে পলাশী দিবসের আলোচনায় ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের প্রতিবাদ
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
লন্ডন: গত ২৩শে জুন “অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন” (দ্যা ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট) এর উদ্যোগে ও “দ্যা গ্রেট বেঙ্গল টুডে”এর পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব লণ্ডনের লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে পলাশী দিবসের আলোচনা ও ভারতের নতুন সংসদ ভবনের ম্যুরালে বাংলাদেশকে যুক্ত করে ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
“অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন” (দ্যা ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট) এর আহবায়ক ও “দ্যা গ্রেট বেঙ্গল টুডে” এর প্রধান সম্পাদক হাসনাত আরিয়ান খানের সভাপতিত্বে এবং সাংবাদিক ও কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা ও প্রতিবাদ সভায় তৃতীয় বাংলাখ্যাত বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির বরেণ্য গুণীজনরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সভার সভাপতি আলোচনা ও প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত গুণীজনদের স্বাগত জানান ও অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
যুক্তরাজ্যে পলাশী দিবসের আলোচনা ও ভারতের নতুন সংসদ ভবনের ম্যুরালে বাংলাদেশকে যুক্ত করে ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাঙালির প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, “ভারতের নবনির্মিত সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিজাতীতত্তের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে ভারত রাষ্ট্রের অখণ্ড অংশ হিসেবে মানচিত্রে দেখানোর ঔদ্ধত্য আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল। আরএসএস ও বিজেপি সরকারের এই সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা কোনদিনই সফল হবে না।”
প্রতিবাদ সভায় বক্তারা ভারতের বিজেপি সরকারের এমন দৃষ্টতাপূর্ণ আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে ভারতের নবনির্মিত সংসদ ভবনে স্থাপিত ‘অখণ্ড ভারত’ মানচিত্র অপসারণের দাবি জানান।
সভায় বক্তারা আরও বলেন, “পলাশীর প্রান্তে নবাবের পরাজয় আমাদের গোটা জাতির জন্য বিরাট বড় শিক্ষা। হতাশাজনক হলেও সত্য, পলাশী যুদ্ধের পরাজয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা আজও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। তৎকালীন সময়ে জাতির মধ্যে ছিলো না কোন ঐক্যবদ্ধতা। ফলে, রবার্ট ক্লাইভের সামান্য সামরিক শক্তি ও কূটকৌশলের কাছে বাংলা হারায় তার স্বাধীনতা। আজ আমাদেরকে অর্জন করতে হবে জাতীয় ঐক্যের শক্তি। নিজেদের মধ্যে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও ভেদাভেদকে ভুলে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। দেশপ্রেমকে শুধু জাতীয় দিবসগুলো উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস সচেতন হতে হবে। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। সদাসর্বদা তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত রাখতে হবে। প্রিয় জন্মভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের থেকে মুক্ত রাখতে হলে সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক নাগরিক গঠনের লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে আর কখনো পলাশীর পটভূমি রচিত হবে না এ সোনার বাংলায়।”
পলাশী দিবসের আলোচনা ও ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাঙালির প্রতিবাদ সভায় বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির বরেণ্য গুণীজনদের মধ্যে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সভাপতি ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী; লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন; লেখক ও গবেষক ব্যারিষ্টার নাজির আহমেদ; প্রাবন্ধিক ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব পীর আহমেদ কুতুব; লেখক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক আবদুল মুনেম জাহেদী ক্যারল; সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট বদরুজ্জামান বাবুল; ইউকে নিউজ বাংলার পরিচালক সাংবাদিক মহিউদ্দিন আফজাল এবং কবি ও চিন্তক আহমেদ ময়েজ আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী বরেণ্য গুণীজনরা বিলেতের মাটিতে এই প্রথমবারের মত পলাশী দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। সেইসাথে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুগে যুগে শাহাদাত বরণকারী সকল শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
এফএম নিউজ টিভির পরিচালক ও নির্মাতা সাংবাদিক ফয়সল মাহমুদ, সাংবাদিক মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামান, সাংবাদিক আজিজুর রহমান, আলোকচিত্রী ফজলুল হক, দর্পণ টিভি পরিচালক সাংবাদিক রহমত আলী, ইক্যুয়াল রাইটস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক মাহবুব আলী খানশূর আলোচনা ও প্রতিবাদ সভায় অংশ নিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন।
এ সময় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনির, পিএইচডি গবেষক হাসান শোয়াইব অনন্ত ও কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট আবদুল মুহিত প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে উপস্থিত হতে পারবেন না বলে সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রধান সম্পাদক লেখক ও গবেষক ফরীদ আহমেদ রেজা এবং সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট শামসুল আলম লিটন এপোলজি দেন। ব্যস্ততাজনিত কারণে আসতে না পারায় এমডি হায়দার খান নান্না দু:খ প্রকাশ করেন।
পলাশী দিবসের আলোচনা ও ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাঙালির প্রতিবাদ সভায় অংশ নিয়ে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সভাপতি ও পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, “আজকের এই আয়োজনে স্বাধীন বাংলাদেশকে, যে বাংলাদেশকে অনেক কষ্ট করে প্রথমে ভাষার স্বাধীনতা, তারপর ভূখন্ডের স্বাধীনতা, সেই স্বাধীন বাংলাদেশকে যুক্ত করে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সংসদ ভবনের ম্যুরালে স্থাপন করে অখন্ড ভারতের যে কার্যক্রম আমি তাঁর নিন্দা জানাচ্ছি।” অখন্ড বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেহেতু এটা রাজনৈতিক সিদ্বান্ত, আমি জানিনা আমরা এটা পারবো কিনা। তবে সাউথ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন এই ব্রিটেন থেকেই শুরু হয়েছে। ভেলা পিলে, টেনিসন মাকিওয়ানে, আব্দুল মিন্টি, ইউসুফ দাদু, কাদের আসমাল ও অলিভার টাম্বো’র মত মাত্র পাঁচ ছয়জন লোক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্রমবর্ধমান মহাজাগতিক রাজধানীতে বসতি স্থাপন করে এবং তাদের নিজস্ব জীবনযাপনের জন্য কাঠামো স্থাপন করে। তাঁরা এটিকে একটি ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে এখান থেকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে, রাজনীতির মধ্যে থেকে তাঁরা এটি করেছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা দাড়িঁয়েছিলেন। আজ থেকে বিশ-ত্রিশ বা চল্লিশ বছর আগেও তাঁরা ভাবতে পারেননি যে তাদের এই মুভমেন্টটা একদিন অনেক বড় হবে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ভেলা পিলে এবং টেনিসন মাকিওয়ানেই প্রথম ব্রিটিশ মাটিতে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জীবাণু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা ১৯৫০ এর দশকে মিটিং করা শুরু করে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য বয়কটের প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রভাবশালী মুভমেন্টে পরিণত হয়েছিল। ছোট পরিসরে যে একটা হাম্বল বিগিনিং নিয়ে এখানে একটা আন্দোলন বা চেতনার কথা বলা হচ্ছে, ভালোভাবে যদি এটাকে নার্সিং করা যায়, পরিচর্যা করা যায় তাহলে এটা একসময় আরও বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। আমাদের বাঙালিদের বড় একটা সূত্র আছে, সেটা হচ্ছে ভাষার সূত্র। বাংলাদেশ স্বাধীন হিসেবে সেই ভাষাটাকে যদি আমরা শক্ত করি, এই ভাষার প্রতি যদি আমাদের নিজেদের শ্রদ্ধা ও মর্যাদা দিয়ে যেতে সক্ষম হই তাহলে ভাষার মাধ্যমেই আমরা আমাদের অন্য ভূখন্ডের মানুষগুলোকে একসূত্রে গাথতে পারি। এটাই হবে আমাদের একত্রিত হবার এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। এজন্য আমাদের এই আন্দোলন চলবে ঠিক আছে কিন্তু একইসাথে আমরা বাংলা ভাষার রজ্জুটাকে শক্ত করবো। এই সূত্রেই আমরা আরও বেশি শক্তি অর্জন করতে পারব। আমি আপনাদের এই অনুষ্ঠোনের সফলতা ও সার্থকতা কামনা করি।”
প্রাবন্ধিক ও কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব পীর আহমেদ কুতুব বলেন, “যে বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছি আজ থেকে প্রায় ২৬৬ বছর হয়ে গেছে। ঠিক এই সময়ে আমাদের ভাই হাসনাত আরিয়ান খানের ডাকে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। এই আয়োজন করার জন্য উনাকে ধন্যবাদ। পলাশীর এই যুদ্ধ বা পলাশীর এই পরাজয় এটা একটি ব্যাপক আলোচনার বিষয়। আমি যখন ছোট ছিলাম আমাদের বাড়ির লাইব্রেরিতে কলকাতা থেকে বিভিন্ন পত্রিকার সৌজন্য কপি আসতো। সেই সময় থেকে আমি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে ছোট ছোট গল্প পড়তাম। সেখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে যা লেখা হতো আমাদের কাছে হাস্যকর লাগতো। পরবর্তী সময়েও নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। একগ্রুপ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তুলে ধরেছেন। আরেক গ্রুপ নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিভিন্ন ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছেন। এই যে দুইটা দ্বন্দ্ব, এই দ্বন্দ্বের কারণে আমি মনে করি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিলো।” তিনি ইংরেজদের সাথে পলাশীর যুদ্ধের ঐতিহাসিক নানা প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন বলেন, “এই ধরণের কিছু অনুষ্ঠান ছোট আকারে হলেও আমাদের প্রেস ক্লাবের শুরু করা দরকার। এটা অনেকটা স্টাডি সার্কেলের মত হবে। আমরা অনেক কিছু শিখতে পারব। আজ থেকে বারো-চৌদ্দ বছর আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজ উদ্দিন সাহেব লণ্ডনে একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তখন যে কয়েক কোটি বাঙালি ছিলো এরা আর কিছু না, শুধু যদি জল নির্গমনও করতো তাহলেও ইংরেজদের ওই মাত্র তিন হাজার সেনাদলকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো।”
লেখক ও গবেষক ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ বলেন, “পলাশী দিবসটা খুব ভালোভাবে পালিত হচ্ছে না। এখানেও না, বাংলাদেশেও না। এবং অনেকে জানেও না। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি যারা তাঁরা কিছুই জানে না। আমরা এত ইতিহাসবিমূখ জাতি! সঙ্গতি আমাদের কম কিন্তু এগুলো একটা জাতি গঠনে আমাদের দরকার বেশি। পলাশী যুদ্ধ অত্যন্ত বেদনাদায়ক ইতিহাস আমাদের জন্য। স্বাধীনতা হারিয়ে আমরা দুইশো বছর ব্রিটেনের কলোনি ছিলাম। এ থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার যে, আসলে কেনো পরাজিত হলো, ওই সময়ে নবাবের ভুলটা কী ছিলো? বিশ্বাসঘাতকদের কী ভূমিকা ছিলো? এগুলো যদি ভালো করে আমরা বার বার রিপিট না করি, জাতির মননে যদি এগুলো গ্রোথিত না হয়, তাহলে জাতি বার বার স্বাধীনতা হারাতে পারে। আজকে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ কিন্তু বাংলাদেশের মানচিত্র আরেকটা দেশের সাথে যুক্ত করে পার্লামেন্ট ম্যুরাল বসানো হচ্ছে, কাদের প্রতিবাদ করার কথা ছিলো? আমরা এখানে প্রতিবাদ করছি, করে যাবো। কিন্তু এটার প্রধান এবং মূখ্য দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের সরকারে যারা আছেন তাঁদের। তাঁরা শক্তভাবে এটার প্রতিবাদ জানানোর কথা। কিন্তু আমরা সেটা দেখছি না। আজকে যদি ইন্ডিয়াকে যুক্ত করে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ম্যুরাল বসানো হতো, ইন্ডিয়া কী বসে থাকতো? এর প্রতিবাদটা আসা উচিত ছিলো সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু আমরা সেখানে কবরের নিরবতা লক্ষ্য করছি। উল্টো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা ভাসানীসহ আরও যারা জড়িত ছিলেন, তাঁদের কোন নাম গন্ধও কোথাও নাই। মওলানা ভাসানী কবে জন্মগ্রহণ করেছেন আপনি একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেন, সে বলতেও পারবে না। কবে ইন্তেকাল করেছেন, কেউ বলতে পারবে না। অথচ উনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী তাঁরা কিন্তু আমাদের অহংকার। সোনার বাংলার সোনার সন্তান। কবে যে তাঁদের জন্মবার্ষিকী যায়, মৃত্যুবার্ষিকী যায় আমরা জানি না। এগুলো জানানোর জন্য সরকারের বাইরে যে শ্রেণীটার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার তা হলো সিভিল সোসাইটি আর সাংবাদিক। কিন্তু সেখানেও কেউ নাই। সাংবাদিকরা অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত, দলীয়ভাবে দ্বিধাবিভক্ত। সিভিল সোসাইটিও কবরের নিরবতা পালন করছে বাংলাদেশে। আজকে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ৫২ বছরের স্বাধীনতা শুধু মাত্র নামেই স্বাধীনতা! আপনার চিন্তায়, আপনার মেধায়, আপনার কর্মে, আপনার বাচনভঙ্গি, আপনার শব্দের স্বাধীনতা কোথায়? একটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে বাংলাদেশে। ভয়ে সিভিল সোসাইটির কেউ-ই কথা বলছে না। এই অবস্থায় আজকে আমরা পলাশী দিবস পালন করছি।”
লেখক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক আবদুল মুনেম জাহেদী ক্যারল বলেন, “আমার জানামতে এদেশে এই প্রথম পলাশী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই প্রথম দিনেই আমরা যারা উপস্থিত হতে পেরেছি আমি মনে করি আমরা সবাই সৌভাগ্যবান। আমরা সবাই এই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। আমি এজন্য আজকের সভার সভাপতি হাসনাত আরিয়ান খান ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন ও অখণ্ড বাংলা চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মওলানা ভাসানী বলেছিলেন- “আসাম আমার, পশ্চিবঙ্গ আমার, ত্রিপুরা আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।” কিন্তু বাংলার নব্য মীর জাফরদের কারণে সেটা হয় নাই। এটা খুবই দু:খজনক, কষ্ট লাগে। মীর জাফররা যুগে যুগে সব সময় থাকে। মীর জাফর এত সুন্দর একটা নাম অথচ মানুষ এই নামটাকে ঘৃণা করে, মানুষ এটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করে। আমি হাসনাত আরিয়ান খান ভাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাই। এরকম আয়োজনের ফলে মানুষ সত্যিকারের ইতিহাসটা জানতে পারবে।”
কবি ও চিন্তক আহমেদ ময়েজ বলেন, “আজকের এই অনুষ্ঠানে দুটো বিষয় একসাথে এসেছে। পলাশী দিবস এবং অখন্ড বাংলা। এটার সাথে সম্পৃক্ত বাংলার বিভাজন ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন। ব্রিটিশ শাসনের সময় বেঙ্গল সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। কারণ দখলদারিত্ব শুরু হয়েছিলো বেঙ্গল থেকে। তারপরে ব্রিটিশরা যখন আস্তে আস্তে গ্রাস করতে শুরু করেছে আমরা কিন্তু তখনও দখলদারিত্বের ভিতরেই ছিলাম। এবং সর্বশেষ গ্রাস করার পরে যখন তাঁরা চলে আসলো, যাদেরকে ছেড়ে চলে আসলো তাঁরা কিন্তু বেশিদিন সেই নির্যাতনের ও শোষণের শিকার আমাদের মত হন নাই। ক্লাস টেনে দীনবন্ধু মিত্রের একটা গল্প ছিলো। গল্পটা পরে নাটক হয়েছিলো। দীনবন্ধু মিত্রের এই গল্পটা পাঠ্যসূচিতে এখন আছে কিনা জানি না। এই গল্পের মধ্যে পাওয়া যায় যে বেঙ্গলটা কেমন ছিলো। দীনবন্ধু মিত্র সেই জেনারেশন যেই জেনারেশনকে এলিট ক্লাস হিসেবে গণ্য করা হতো। মধুসুদন দত্তদের ঠিক পরপরই। তাদের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে সেটাকে রেনেসাঁ বলা হয়। যদিও রেনেসাঁ অনেক কিছু ধারণ করে, কিন্তু বেঙ্গলে কোন রেনেসাঁ আন্দোলন হয় নাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যয় একটা কনফারেন্সে বলেছিলেন, আমরা যে রেনেসাঁর কথা বলি রেনেসাঁ তো সব কিছু নিয়ে হয়। আমি যদি নূন্যতম আমাদের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির কথা বলি সেটা কোথায়! আমরা তো শুরুই করতে পারি নাই। ফরাসিতে যে রেনেসাঁ আন্দোলন হয়েছিলো আমরা তো তাঁর ধারে কাছেও নাই। তারপরেও বেঙ্গলের পরিবর্তনটা এসেছে এডুকেশনের মাধ্যমে। আমাদের তখনও এডুকেশন ছিলো। এডুকেশনের পার্টটা যখন পরিবর্তন হলো তখন আস্তে আস্তে আমরা আসলে মুৎসুদ্দি, কেরানী উপাধীতে ভূষিত হই। কারণ যে জেনারেশনটা তৈরী করা হয়েছিলো দখলদারদের বা ব্রিটিশদের সার্ভিস দেয়ার জন্য, তাদেরকে ততটুকুই শিক্ষিত করা হয়েছিলো। তারপরও যতটুকু তাঁরা ধারণ করেছেন ব্যক্তিগতভাবে করেছেন, ইউরোপ থেকে ধারণ করেছেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অগ্রবর্তী হলেও তিনি বলেছেন- ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।” কবি আহমেদ ময়েজ আরও বলেন, “অখন্ড বাংলা পতনের পর যে প্রাণ পুরুষ তিনি হলেন, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। তিনিই প্রথম অখন্ড বাংলার দাবী উত্থাপন করেছিলেন। এই উত্থাপন করে কেনো তিনি কংগ্রেস থেকে দুরে সরে আসলেন এগুলো আমাদের ভাবা উচিত।”
সাংবাদিক ও কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট বদরুজ্জামান বাবুল বলেন, “এই দেশে পলাশী দিবস! এটা শোনে আমার ভালো লেগেছে। পলাশী দিবসের আলোচনা ও অখন্ড ভারত মানচিত্রের প্রতিবাদের কথা শোনেই আমি আসলাম। বিলেতের মাটিতে আজকে থেকে পলাশী দিবস শুরু হয়েছে। আশাকরি এটা চলবে। আমি হাসনাত খান ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। যারা সহযোগিতা করেছেন তাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। এই আন্দোলন যেনো কন্টিনিউ থাকে। আমরা হাসনাত ভাইকে সহযোগিতা করবো এবং চেষ্টা করবো যদি হায়াতে বেঁচে থাকি আগামীতে আরও বড় পরিসরে করার। যে চেতনা নিয়ে আজকে থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে আমাদের পরবর্তী বংশধর এটাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সবার জন্য আমার শুভকামনা থাকলো।”
ইউকে নিউজ বাংলার পরিচালক সাংবাদিক মহিউদ্দিন আফজাল বলেন, “আজকের আলোচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশে অনেক দিবসই পালিত হয় কিন্তু পলাশী দিবস পালিত হয় না। পলাশীর পরে আমাদের জাতির বিশাল একটা পতন এসেছিলো। শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে জাতি পিছিয়ে গিয়েছিলো। তিনি প্রেস ক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরীর বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে ঐক্য সৃষ্টির জন্য বাংলা ভাষার উপর জোর দিতে বলেন।”
সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে “অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন” (দ্যা ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট) এর আহবায়ক ও “দ্যা গ্রেট বেঙ্গল টুডে” এর প্রধান সম্পাদক হাসনাত আরিয়ান খান বলেন, “আজকের এই বিশেষ দিনের বিশেষ সময়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য এবং পলাশী দিবসের আলোচনা ও ভারতের নতুন সংসদ ভবনের ম্যুরালে বাংলাদেশকে যুক্ত করে ‘অখন্ড ভারত’ মানচিত্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাঙালির প্রতিবাদ সভায় যোগদানের জন্য আমি আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনাদের মত এত এত বরেণ্যে গুণীজনদের খুবই মূল্যবান ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য শোনবার পর এবং সেখান থেকে নোট নেয়ার পর আমার আর কিছুই বলার থাকে না, থাকা উচিত না। ইনফ্যাক্ট আপনাদের মত বরণ্যে গুণীজনদের সামনে কথা বলবার মত কোন যোগ্যতাই আমার নেই। আপনারা যোগ্যতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বয়স ও অভিজ্ঞতায় সবাই আমার চেয়ে অনেক অনেক বড়। আমি আপনাদেরকে শ্রদ্ধা করি, সন্মান করি এবং আপনাদের কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত শিখি। আপনাদের কাছ থেকে শেখার জন্যই আমি আমার বক্তব্যটা লিখে এনেছিলাম যে, অনুষ্ঠানে আমি কোন কথা বলবোনা। আমি শুধু আপনাদের কাছ থেকে শুনবো, নোট নিবো। আপনাদের সবার বক্তব্য আমি খুব মনোযোগ সহকারে শুনেছি এবং নোট নিয়েছি। আপনাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনে মুগ্ধ হয়েছি। আপনাদের কথাগুলো আমার মনে থাকবে।” লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় পলাশী ট্রাজেডি। পলাশী প্রান্তরে এদেশের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটেছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। এই দিনে ভাগীরথীর তীরে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। পলাশী শুধু পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ভাগীরথী নদী তীরের এক খন্ড জমি নয়, আম্রকানন নয়, যুদ্ধের ময়দানও নয়। এটি হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষদের রক্তক্ষরনের স্থান, ষড়যন্ত্রকারীদের পাহাড়সম প্রহসনের স্থান। এটা দেশদ্রোহী বেইমানদের চিনবার স্থান। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই স্থান প্রেরণার বাতিঘর। যে প্রেরণা যুগিয়েছে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় নবাব সিরাজ ও তাঁর সেনাদল। যারা দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে লড়াই করেছেন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় জীবন দিয়েছেন। প্রহসনের ঐ যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মীর মদনদের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও মানুষ নবাবকে, মীর মদনকে, পলাশীর যুদ্ধে জীবনদানকারী সকল শহীদদেরকে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেন। পক্ষান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রাজ বল্লভ ও রায় দুর্লভদের মানুষ আজও ঘৃণা করেন। ”
তিনি আরও বলেন, “১৯৪৭ সালে দীর্ঘ দুইশো বছরের গোলামীর জিঞ্জির থেকে আংশিক ও ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা কিছুটা মুক্তি পেলেও প্রকৃত মুক্তি আমাদের আজও আসেনি। প্রকৃত স্বাধীনতা আমরা আজও পাইনি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটা স্বাধীন ভুখন্ডের অভ্যুদয় হলেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, আরাকান, বিহার ও উড়িষ্যা নামক আমাদের হাত পাগুলো এখনো বিচ্ছিন্ন। উপরন্তু নিজ দেশেই আমরা পরবাসী হয়ে আছি। পলাশী বিপর্যয়ের ২৬৬ বছর পরও বাস্তব পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি হয়নি। দিন দিনই বাংলাদেশ একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিনত করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সমগ্র অর্থনৈতিক কর্মকান্ডই এমন ব্যক্তিরা নিয়ন্ত্রণ করছেন যাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও আমরা পারিনি সার্বজনীন ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য কোন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে। যার মাধ্যমে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম তৈরী হবে। গড়ে উঠেনি স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে নিজস্ব শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবকাঠামো। আমরা পারিনি নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ঘটাতে। বার বার জনগণকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হয়েছে, এখনও করতে হচ্ছে। কখনো বাকশাল, কখনো স্বৈরাচার, কখনো গণতন্ত্রের লেবাসে দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের ক্ষমতালিপ্সা জাতিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো দলবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। লাগাতার মিথ্যাচার, পরস্পরকে গালমন্দ, ভৎসনা, কুৎসা রটনা, খাটো করার প্রশিক্ষন যত হয়েছে তার তুলনায় দেশপ্রেমের প্রশিক্ষন নেই বললেই চলে। জাতীয় স্বার্থের চাইতে দলীয় স্বার্থ, তার চাইতেও ব্যক্তিস্বার্থ তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের মহান নেতাদের প্রতিনিয়ত অসন্মান করা হচ্ছে। তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, নবাব সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাস্টার দা সূর্য সেন, বিপিন চন্দ্র পাল, লীলা দত্ত নাগ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবীর ওসমানীর জীবনী বিস্মৃত হয়েছে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা আজ ধুকে ধুকে মরছে। ভাষা শহীদ আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমানের পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে মরছে। আমাদের জাতীয় নেতাদের প্রতিনিয়ত অপমান করা হচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক কলহ ও অনৈক্যের সুযোগে আমেরিকা ও চায়নার মত দেশগুলো আমাদের উপর দাদাগিরি করছে। সর্বশেষ ভারত আমাদের স্বাধীন অস্ত্বিত্বকেই অস্বীকার করে তাদের নতুন সংসদ ভবনের দেয়ালে বাংলাদেশকে যুক্ত করে ‘অখণ্ড ভারত’মানচিত্র স্থাপন করেছে! ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক ভারতীয় জনতা পার্টির মতাদর্শগত অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) মধ্যে অখণ্ড ভারতের ধারণা বহু দিন ধরেই বিদ্যমান। আরএসএস মনে করে, অখণ্ড ভারত হলো প্রাচীন সাংস্কৃতিক ভারতবর্ষ। প্রাচীনকালে যেসব এলাকায় ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল, তা নিয়েই অখণ্ড ভারত। আরএসএস তাত্ত্বিকদের ধারণা, অখণ্ড ভারত কোনো অবাস্তব কল্পনা নয়। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও আরএসএসের মধ্যে সমন্বয় রক্ষাকারী দলের সাধারণ সম্পাদক রামমাধব বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, “ঐতিহাসিক কারণে যে ভূ-খণ্ডগুলো আলাদা হয়েছিল, মানুষের ইচ্ছাতেই তা আবার এক হতে পারে বলে মনে করে আরএসএস।”আমরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এই ইতিহাস বিকৃতির তীব্র নিন্দা জানাই। এবং আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একইসাথে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে যুক্ত করে নেপাল যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, আমরা এরও নিন্দা জানাই এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাই।”
হাসনাত আরিয়ান খান বলেন, “ভারতীয় জনগণের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরা তাদের ভালোবাসি। ভারতীয় জনগণও আমাদেরকে ভালোবাসেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, বাঙালি জাতির উৎপত্তি আদি পুরুষ নুহ (আঃ) এর প্রপৌত্র ‘বঙ’ বা ‘বঙ্গ’ হতে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, হযরত আদম (আঃ) থেকে আমাদের এই মানব জাতির শুরু। কিন্তু নুহ (আঃ) সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন ঘটে। এই মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সকল কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ জীবিত ছিল না। শুধু নুহের নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নুহ (আঃ) এর অনুসারী; পরবর্তীতে এই ৮০ জন থেকেই মানব জাতির আবার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই নতুন যাত্রায় বাঙ্গালি জাতিরও সম্পর্ক ছিল। বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে ছিলেন নুহ (আঃ) এর এক পুত্র; নাম তাঁর ‘হাম’। নুহ (আঃ) তাঁর পুত্র হামকে বললেন, ‘তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্যে চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে’। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। সেখানে এসে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতের দিকে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নাম অনুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান। আর হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ’ বা ‘বঙ্গ’। এই ‘বঙ্গ’- এর সন্তানরাই বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করে। এই গল্প সত্যি হলে বলতে হবে বাঙালির আদি পুরুষ হচ্ছেন ‘বঙ্গ’। এবং ভারতীয়রা আমাদের ভাই। কাজেই ভারতীয় জনগণের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নাই। আমাদের সাধারণ মানুষের মত তাঁরাও দিল্লীর ক্ষমতাসীনদের শাসন, ত্রাসন ও সংহারে বিপর্যস্ত। একারণে ১৩৪২-৫২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ দিল্লি থেকে স্বাধীন হয়ে সমগ্র বাংলাকে একত্রিকরণ করে অবিভক্ত বাংলা সালতানাত গঠন করেন। তিনি সম্মিলিত এ রাজ্যের ‘বাঙ্গালাহ’ নামকরণ করেন এবং এর অধিবাসীদের বাঙালি নামে অভিহিত করেন। সেই থেকে বাঙালি নামের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী পরিচয় লাভ করে। ফলে বাংলার আপামর জনগণ অভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও ভাষার অঙ্গনে সমবেত হয়। তিনি গৌরবোজ্জ্ল অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। বাংলার সাংস্কৃতিক আবহ ও জ্ঞানগত উৎকর্ষের কারণে বহু পরিব্রাজক ও পণ্ডিত এখানে ভ্রমণ করেন। বাংলা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেন। বস্ত্তত, উদার নীতি গ্রহণ করে তিনি জনগণের মধ্যে সংহতি স্থাপনের মাধ্যমে বাঙালি সমাজে এক নতুন জীবনধারার সূচনা করেন। দিল্লির কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এভাবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সালতানাতকে সুদৃঢ় করেন। এ সালতানাত প্রায় দুইশো বছর টিকে ছিল। হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই স্বাধীন বাংলা সালতানাতের সীমানা ছিলো। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরী’ বইয়ে বাংলার সীমানা উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুসারে, সুবা বাংলা পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমে তেলিয়াগড় পর্যন্ত ৪০০ ক্রোশ এবং উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে হুগলি জেলার মান্দারন পর্যন্ত ২০০ ক্রোশব্যাপী বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশরা দুইশো বছর উপমহাদেশ শাসন করলেও এ জনপদের নাম “বেঙ্গল”ই রেখেছিলো। আমরা বিভিন্ন সময়ে অখন্ড বাংলাকে হারিয়েছি আবার ফিরে পেয়েছি। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে আসার ৭৬ বছর পরেও আমরা অখন্ড বাংলাকে আর ফিরে পাইনি। দিল্লীর শাসকেরা আমাদেরকে আর ফিরিয়ে দেয়নি। তবে বাংলার বিদ্রোহী চেতনা তো ফুরিয়ে যায়নি। ইতিহাস বলছে, বাংলা কখনো অন্য কোনো অঞ্চলের বশ্যতা সহজে মেনে নেয়নি। সব যুগে এ অঞ্চলের শাসকরা ছিলেন স্বাধীনতাপ্রিয়। বাংলার মানুষরাও ছিলেন স্বাধীনচেতা। বাঙালির রক্ত ভিন্ন জাতের রক্ত। এই রক্ত কোনোদিন পরাভব মানে না। ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলেও আমাদের হাত পাগুলো এখনো বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা ভারত বা দিল্লীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করছি। এই আধুনিক যুগে এসে আমরা কোন রক্তপাত চাই না। আমরা বিনা রক্তপাতে দখলে রাখা বাংলার অংশগুলো দিল্লীর শাসকদের ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছি। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিট্রিশ সরকার যেমন গণভোটের আয়োজন করেছিলো। আমরাও দিল্লীর কাছে সেরকম গণভোট আয়োজন করার দাবী করছি। আমাদের বিশ্বাস গণভোট হলে বাঙালি জাতির পশ্চিমাংশও দিল্লীর শাসকদের তথাকথিত ভারত সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হবেন এবং পুরো বাঙালি জাতি আবার অবিভক্ত বাংলার বাসিন্দা হবেন। বাংলাদেশিত্ব/বাঙালিত্ব’ আইডেন্টিটি আমাদের জন্মগত অধিকার। আমরা তা অর্জন করবই। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যে স্বাধীন ও অখন্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী যে স্বাধীন ও অখন্ড বাংলার স্বপ্ণ দেখেছিলেন, শরৎ বসু যে স্বাধীন ও অখন্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, মওলানা ভাসানী যে স্বাধীন ও অখন্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমরা সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবোই। পলাশী দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। একেবারে প্রাচীন যুগ থেকে মহান বঙ্গ সভ্যতা হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। অখণ্ড বাংলা বা অখণ্ড বাংলাদেশ তারই প্রতিচ্ছবি। আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য জীবন উৎসর্গকারী সকল বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বাঙালিকে জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা প্রদানকারী ও সর্বপ্রথম শাহ-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি ধারণকারী শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমরা গর্বিত, আমরা বাঙালি। জয় বাংলা।”
এসময় তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনগণকে “অখন্ড বাংলাদেশ আন্দোলন” (দ্যা ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট) এ যোগ দেওয়ার আহবান জানান।