লন্ডনে রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনঃ চলচ্চিত্র সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক – রোশনারা আলী এমপি

নিলুফা ইয়াসমিন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী

লন্ডন : উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে  আনন্দ-ঘন পরিবেশে লন্ডনে ২৩তম রেইনবো ফিল্ম চলচ্চিত্র উৎসবের  এর পর্দা উঠেছে। ২৯ শে মে রবিবার দুপুর ১২টায় পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ড রোডের জেনেসিস সিনেমা হলে যুক্তরাজ্যের প্রথম বাঙালি এম পি রোশনারা আলী বহু প্রতিক্ষিত চলচ্চিত্র উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রদর্শিত হয়েছে  আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত বাংলা ছায়াছবি ‘মায়ার জঞ্জাল’।  বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় এই ছায়াছবিটি নির্মিত হয়েছে। ছবিটি পরিচালনা করেছেন  ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী।

কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দুই ছোট গল্প ‘বিষাক্ত প্রেম’ ও ‘সুবালা’ অবলম্বনে  নির্মিত হয়েছে ‘মায়ার জঞ্জাল’। ছবিটির মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপি করিম  এবং কোলকাতার অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী।

সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফ্যাস্টিভ্যাল ডিরেক্টর মোস্তফা কামাল এবং জুড়ি বোর্ডের প্রতিনিধি লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ নাহাস পাশা বক্তব্য রাখেন। ফ্যাস্টিভ্যাল কমিটির সদস্য সৈয়দা সায়মা আহমেদ এবং অপর সদস্য নব প্রজন্মের প্রতিনিধি সামির কামাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যৌথভাবে  পরিচালনা করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বেথনাল গ্রীণ ও বো এলাকার এমপি রোশনারা আলী কমিউনিটিতে রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসবের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বিলেতে আগে বাংলা ছায়াছবি দূরের কথা, ভারতীয় ছায়াছবিও দেখার সুযোগ হতোনা। যদিও কখনো কোন  সিনেমা হলে ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখানো হতো তখন  বাঙালিরা দল বেঁধে ঐ চলচ্চিত্র দেখতে যেতেন। কারন ভারতীয় হলেও একই অঞ্চলের বলে বাঙালিরা ঐ সব চলচ্চিত্র দেখে নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাধ পেতেন। তিনি  বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ রেইনবো সোসাইটির মাধ্যমে কমিউনিটির লোকজন বিভিন্ন দেশের ভাল ছায়াছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছেন।

রোশনারা রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসবে কমিউনিটির নব প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সম্পৃক্ত করার আহবান জানিয়ে বলেন, চলচ্চিত্র সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।

সৈয়দ নাহাস পাশা রেইনবো সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের সাথে তাঁর প্রায় ৩০ বছরের পরিচয় আছে উল্লেখ করে বলেন, মোস্তফা কামাল ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে গত ২৩ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে যাচ্ছেন, যা প্ৰশংসনীয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোস্তুফা কামাল বলেন, প্রথম দিকে চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য ছায়াছবি সংগ্রহ করতে অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা নানা প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের জবাবে সন্তুষ্ট হলেই তাঁরা ছায়াছবি পাঠাতে সম্মত হতেন। কিন্তু রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এখন এমন এক উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, প্রযোজকরা নিজেরাই তাঁদের ছায়াছবি পাঠিয়ে দেন প্রদর্শনীর জন্য। তিনি বলেন, এবার বিভিন্ন দেশের প্রযোজকরা চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য ৮৪ টি চলচ্চিত্র জমা দিয়েছিলেন। আমরা যাচাই বাছাই করে মোট ৪৪টি চলচ্চিত্র নির্বাচিত করেছি। মোস্তুফা কামাল বলেন, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি যুক্তরাজ্যের একটি অলাভজনক চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্যে সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মাল্টি কালচার সোসাইটি এবং পরিবারের সবাই একসঙ্গে উপভোগ করার উপযোগী চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শনীর জন্য বাছাই করা হয়।

২৯শে মে শুরু হওয়া এই উৎসব এক নাগাড়ে ৫ই জুন পর্যন্ত চলবে। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, ভারত, চীন, ইরান, বুলগেরিয়া, গ্রীস, জার্মান, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, ইরান, সুইজারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া এবং লিথুনিয়া থেকে ফিচার, শর্ট এবং ডকুমেন্টারী মিলিয়ে মোট ২০টি ভাষায় ৪৪টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে এবারের রেইনবো চলচ্চিত্র উৎসবে।

আটদিনব্যাপী বাংলাদেশসহ নানা দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি, এক্সিবিশন, চলচ্চিত্র সেমিনার এবং শিশুদের চলচ্চিত্র প্রদর্শীত হবে। এছাড়া চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ থাকছে আরো নানা আয়োজন।

রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগে জেনেসিস সিনেমা হল ছাড়াও রিচ মিক্স এবং  ব্রাডি আর্টস সেন্টারেও প্রদর্শিত হবে ছায়াছবি, কোন প্রবেশ মূল্য লাগবেনা। প্রতিটি চলচ্চিত্রে আছে ইংরেজী সাবটাইটেল।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে নব প্রজন্মের প্রতিনিধি সামির কামাল (মোস্তফা কামালের ছেলে) উল্লেখ করেন, গত ২০ বছর যাবৎ এই উৎসবের সাথে তিনি জড়িত আছেন। সেই ছয় মাস বয়স থেকে বাবা মায়ের   সাথে প্রতিটি চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছেন। আগামী দিনগুলোতে তিনি চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে নিজেকে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এবারের উৎসবে মায়ার জঞ্জাল ছাড়া আরো যে চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শিত হবে সেগুলো হলো: আজব কারখানা (বাংলাদেশ), ভোকা (ভারত, উরিয়া), বিশ্ব সুন্দরী (বাংলাদেশ), ঢাকা ড্রীম (বাংলাদেশ), জীবন খাতার প্রতি পাতায় (ভারত), কালবেলা (বাংলাদেশ), কালকক্ষ (ভারত), মিডিয়াম স্পাইছ (ভারত, মারাঠী), মুখোশ (ভারত), সেভেন্থ স্ট্রিং (ভারত, আসামীজ), শেমখোর (ভারত, ডিমাসা), ফিয়ার (বুলগেরিয়া), টাঙ্গরা ব্লুজ (ভারত), দ্য নিউজপেপার (শ্রীলংকা), দ্য পোর্টট্রেট (ভারত, মালায়লাম), চন্দ্রাবতী কথা (বাংলাদেশ), ইয়ানজেনস জার্নি (চীন)।

এছাড়া চারটি ছবি – ভোকা, কালকক্ষ, জীবন খাতার প্রতি পাতায় এবং দ্য পোর্টট্রেট ডেলিগেট সেন্টারে দেখানো হবে। নতুন প্রজন্মের দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত হবে পাঁচটি শর্ট ফিল্ম।

সূচী 

৩০শে মে বিকাল চারটায় এবং সন্ধ্যা ছয়টায় ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হবে যথাক্রমে শ্রীলংকার ছায়াছবি দ্য নিউজপেপার এবং বাংলাদেশের ছায়াছবি ঢাকা ড্রীম।

৩১শে মে বিকাল চারটায় এবং সন্ধ্যায় ছয়টায় ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হবে যথাক্রমে ইয়ানজেনস জার্নি (চীন) ও চন্দ্রাবতী কথা (বাংলাদেশ)।

ব্রাডি আর্টস সেন্টারে পহেলা জুন প্রদর্শিত হবে দুটি ছায়াছবি। বিকাল চারটায় প্রদর্শিত হবে ফিয়ার (বুলগেরিয়া) এবং সন্ধ্যা ছয়টায় টাঙ্গরা ব্লুজ (ভারত)।

২রা জুন ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হবে ভারতের নির্মিত দুটি ছায়াছবি। বিকাল চারটায় প্রদর্শিত হবে শেমখোর (ভারত, ডিমাসা) এবং সন্ধ্যা ছয়টায় মুখোশ (ভারত)।

ভারতে নির্মিত ছায়াছবি মিডিয়াম স্পাইছ এবং বাংলাদেশের ছায়াছবি কালবেলা ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রদর্শিত হবে যথাক্রমে ৩রা জুন বিকাল চারটায় এবং সন্ধ্যা ছয়টায়।

৪ জুন যথারীতি দুটি ছায়াছবি প্রদর্শিত হবে, বিকাল চারটায় ভারতের সেভেন্থ স্ট্রিং এবং সন্ধ্যা ছয়টায় বাংলাদেশের আজব কারখানা।

চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী দিনে ৫ই জুন রিচমিক্স সেন্টারে প্রদর্শিত হবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বনামধন্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী পরিচিলিত এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা সিয়াম আহমেদ ও পরীমণি অভিনীত ‘বিশ্ব সুন্দরী’।

ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ ও ওমেন ফিল্ম কনফারেন্স:

৪ঠা জুন  ব্রাডি আর্টস সেন্টারে দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠিত  হবে  ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ। এবং বিকাল ৪টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে ওমেন ফিল্ম কনফারেন্স।

অনুষ্ঠানকে সফল করতে প্রতিবারের ন্যায় এবারও কাজ করছে ফ্যাস্টিভ্যাল কমিটি। কমিটির সদস্যরা হলেন ড্যারেক ম্যালকম, মোস্তফা কামাল, শামীমা ফেরদৌস, কবিরুল ইসলাম খান, জয়শ্রী কবির, আহমেদ মুজতবা জামিল, দেবানিক কুন্ডু (ভারতের প্রতিনিধি), জহুরী জামানি (ইরানের প্রতিনিধি), আবু মুসা হাসান, আনয়ারুল কবীর, বুলবুল হাসান, সৈয়দ জোবায়ের আহমেদ, সৈয়দ মকিব আহমেদ, সৈয়দা সায়মা আহমেদ, দীপ্তি অনুপম, ফরিদা কামাল, ফেরদৌস খান, ইমরান খান, মেহের আহমেদ, নাদিয়া লোদি ওহাব, নিলুফা ইয়াসমীন, সাদেক আহমেদ চৌধুরী, সেলিনা খান, স্মৃতি আজাদ, শাহনাজ বেগম মণি ও সামির কামাল।

জুরি বোর্ড

জুরি বোর্ড এ আছেন জয়শ্রী কবীর, সৈয়দ নাহাস পাশা, ডাঃ জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, পুলক গুপ্ত, জহুরী জামানি ও সাদেক আহমেদ চৌধুরি।

জুরি বোর্ড বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এওয়ার্ড নির্ধারণ করবে। উৎসবের সমাপনী দিনে এই এওয়ার্ডগুলো দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের উদ্যোগে দু‘হাজার সালে লন্ডনে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উৎসব। এরপর থেকে প্রতি বছর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

You might also like