লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সেমিনার: বাংলা ভাষার বিকৃতির বিষয়ে সচেতনতা জরুরি
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
লন্ডন, ০৯ নভেম্বর: যে জাতি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধংস্ব করে, সঠিক চর্চা করতে ব্যর্থ হয়, সেই জাতি কখনো অন্য জাতির কাছে সম্মান পায় না। ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক সেমিনারের আলোচনায় এমন বার্তাই দিয়েছেন বক্তারা। গত মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বাংলা ভাষার সঠিক বানান ও ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহবান জানান। তাঁরা বলেন, বিশেষ করে বাংলা গণমাধ্যম ও প্রকাশনায় যুক্ত ব্যক্তিরা বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারের বিষয়ে অধিক সচেতন ও যত্নশীল হওয়া জরুরি।
গত ৪ নভেম্বর থেকে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আয়োজনে চলছে মাসব্যাপী বাংলা নাট্যোৎসব ‘সিজন অফ বাংলা ড্রামা’। বিলেতে বাংলাদেশিদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরার বৃহত্তম আয়োজন এটি। এ আয়োজনে অংশ নিয়ে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব ওই সেমিনারের আয়োজন করে।
‘সিজন অফ বাংলা ড্রামা’র এবারের মূল প্রতিপাদ্য—’মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং ‘আত্মপরিচয়’ (ফ্রিডম অব পীস অ্যান্ড সেল্প আইডেনটিটি)। বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন পরিবেশনায়। মঞ্চ নাটক, গীতি নাট্য ও নৃত্য নাট্যের পাশাপাশি আলোচনা ও প্রদর্শণীর মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব ও নানা সংগ্রামের কথা।
কুইনমেরি ইউনিভার্সিটির ‘আর্টস ওয়ান, পিন্টার স্টুডিও’তে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. সেলিম জাহান।এতে ‘বাংলা ভাষার মূল্যায়ন’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন বিবিসি বাংলার সাবেক প্রযোজক উদয় শঙ্কর দাশ।
ড. সেলিম জাহান বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন জরুরি। এই স্বাধীনতা চর্চার সীমারেখা বুঝতে পারা এবং সেটি রক্ষা করাও জরুরি। কারণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অ্ন্যায় আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মত প্রকাশের নামে নারী বিদ্বেষ, ধর্মের অবমাননা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
সেলিম জাহান বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের নিজস্ব ভাষায় কথা বলা এবং তথ্যের অধিকারও জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাভাষী মানুষের ওপর জোর করে উর্দূ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার কারণেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো। ১৯৪৮ সালের দিকে ওই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো উল্লেখ করে সেলিম জানান বলেন, ১৯৫২ সালের আন্দোলনকে কেবল বাংলা ভাষার আন্দোলন হিসেবে চিন্তা করলে এর সঠিক মূল্যায়ন হয় না। ওই আন্দোলন ছিলো বাংলার মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের বৃহত্তর সংগ্রামের সূচনা।
বর্তমানে নানাদিক থেকে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুক্ষিণ বলে মন্তব্য করেন ড. জাহান। বানান বিকৃতি, ভাষার ইসলামীকরণ এবং হালের টেলিভিশন-রেডিওতে বাংলা-ইংরেজির মিশেলে কথা বলার প্রবণতার বেশকিছু উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। শিক্ষা ব্যবস্থার গলদের কথা উল্লেখ করে সেলিম জাহান বলেন, বাংলাদেশে উচ্চবিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। তারা বাংলা জানে না। একদল সাধারণ মাধ্যমে পড়াশোনা করছে। আরেক দল মাদ্রায়।ত্রিমুখী এই শিক্ষা বাংলার জন্য হুমকি বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, বাংলা থেকে হিন্দুয়ানী শব্দ বাদ দিয়ে আরবী শব্দ জোড়া দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম বা মুসলমানের কোনো উপকার হয় না। কিন্তু এতে বাংলা ভাষার ক্ষতি হয়।
সাংবাদিক উদয় শঙ্কর দাশ বাংলা গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার ভুল ব্যবহার ও বানান বিকৃতির বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম ও প্রকাশনার মাধ্যমে ভাষা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু গণমাধ্যম ও প্রকাশনায় যতি বাংলার বিকৃতি ঘটে তাহলে নতুন প্রজন্ম কি করে সঠিক বাংলা শিখবে! তিনি সাংবাদিকদের বাংলা বানান ও ভাষার সম্পর্কে জানার ও যত্নবান হওয়ার আহবান জানান।
বক্তারা বলেন, যিনি নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে, তিনি চাইলে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও দ্রুত শিখতে পারেন। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অজ্ঞতা মানুষকে কখনো সম্মানিত করে না। বরং আত্মপরিচয়হীন করে তোলে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী। সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি তারেক চৌধুরী ও কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমদ।
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক যাবত বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল নভেম্বর মাসব্যাপী ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা’র আয়োজন করে আসছে। টাওয়ার হ্যামলেটসে ২০০৩ সালে শুরু হওয়া বাংলা নাট্যোৎসবের এটি ১৯তম আয়োজন।