শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ আজ অনুপ্রেরণার কাহিনী


অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ

 

ইউক্রেনে যুদ্ধ হচ্ছে। যুদ্ধে সাধারণ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আহত হচ্ছে পথে ঘটে নিজ বাড়িতে। এক নিমিষে উদ্বাস্তু হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর বড় দেশগুলোর চাপে ধ্বংসযজ্ঞ কমে আসার কোনো লক্ষণ নেই। ঠিক সেই সময় ইউক্রেনের লবইব শহরের একটি হাসপাতালে সেবা দিচ্ছে আমেরিকা থেকে যাওয়া একটি মেডিকেল টিম। আহতদের সেবা দেয়া এবং সরঞ্জাম নিয়ে হাসপাতালটিকে বেশি করে সেবার দিবার উপযোগ্য করার জন্য দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে দলটি। এ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ডা. নাহরীন আহমেদ। মাঝে মাঝেই আসন্ন বিমান হামলার সাইরেন বাজে। হাসপাতলের সব জানালায় বালুর বেগ দিয়ে বোমা থেকে সংরক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে। যদিও শহরটি পোল্যান্ড বর্ডার থেকে ২০ মাইল দূরে। তবুও দুইবার রাশিয়ান মিসাইল হামলা হয়েছে।

যে কোনো সময় যুদ্ধের গতি বদলে যেতে পারে। অবাক হয়ে হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা জিজ্ঞেস করে ডা. নাহরীন আহমেদকে, কে তুমি? কোথায় পেলে এমন সাহস? আমাদের এই বিপদে তুমি কেন নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাও? ডা. নাহরীন তাদের শোনালো তার দাদুর গল্প। অসীম সাহসী এক ডাক্তারের গল্প। স্বাধীনতাকামী আহত মানুষের জন্য আত্মোৎসর্গিত একজন সার্জনের গল্প। যে রক্ত তার দেহে প্রবাহিত। তাই তার ভয় নেই। সে না দেখা তাঁর দাদুর দ্বারা অনুপ্রাণিত। আর কিছু নয়। ইউক্রেনিয়ান সার্জনরা অবাক হয়ে শুনল ডা. নাহরীন আহমেদের কথা। তারা বলে উঠল, আমরাও তোমার দাদুর মতো সেই মহান মৃত্যু চাই। আমরাও পালিয়ে যাব না। প্রাণ দিয়ে হলেও আঁকড়ে থাকব এই হাসপাতাল।

৯ এপ্রিল নাহরীনের দাদুর ৫১তম মৃত্যু দিবস। এইদিনেই নাহরীন ইউক্রেন থেকে জানালো তার দাদুর আত্মত্যাগের কাহিনী। এ গল্প বিশ্বের আরেকপ্রান্তে আরেক জাতিকে যুদ্ধের ময়দানে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। মনে হলো, আজকে লিখব আমার বাবার কিছু কথা। নাহরিনের সাহসী দাদুর কিছু কথা। যেটা তাকেও বিশদভাবে বলা হয়নি কোনোদিন। প্রায়ই মনে হতো কি হবে লিখে। কারইবা এসব জানার উৎসাহ আছে। এখন মনে হচ্ছে, অনুপ্রেরণা নিতে প্রজন্মরা হয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের পূর্বসুরির ঐতিহ্য গাঁথা কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আমার বাবা ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের মৃত্যবার্ষিকীর দিনটি আসলেই গত ৫১ বছর ধরে একইভাবে আমাদের পরিবারের সবার বুকে রক্তক্ষরণ হয়। সব শহীদ পরিবারকে নিশ্চয় একই অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করল হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা।

নির্বাচনে বিজয় বাঙালির গণতন্ত্রের অধিকার তো দিলেই না, নির্বিচারে শুরু করলে হত্যাযজ্ঞ। শুরু হলো বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর দুই সপ্তাহ পরই ৯ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করে। সেখানে যুদ্ধাহত মানুষের সেবা দানে ব্যস্ত ছিলেন ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ ও তাঁর সহকারি ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমানকে হাসপাতালের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। তাদের অপরাধ ছিল, মানবতা সেবা করার জন্য জনশূন্য যুদ্ধক্ষেত্র সিলেটে থেকে পালিয়ে যাননি। সহকর্মীরা ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে বললেন, স্যার আপনি থাকলে আমারও থাকব। প্রাণের ভয় তাদের যুদ্ধাহত মুমুর্ষ রোগীদের সেবা থেকে নড়াতে পারেনি। অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন ছিলেন সার্জারির প্রধান। সবচেয়ে প্রবীণ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব অধ্যাপকের থেকে বয়োজোষ্ঠ। শুধু তাই নয়, ঢাকায় থাকার সময় তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। চিকিৎসা বিজ্ঞান, শিক্ষাব্যবস্থা, গরিবের সুচিকিৎস্য এবং উন্নত মানের রোগীদের সেবা দেয়াই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য।

চিকিৎস্য ব্যবস্থা এবং জাতির উন্নতির জন্য তাঁর তেজস্বী ভূমিকা বহুবার পাকিস্তানি সরকারকে বিপদে ফেলেছে। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন যখন স্থিমিত হতে চলেছে, তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সময় অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে কাছ থেকে গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মুমুর্ষ ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসলে তাঁকে বাঁচাবার প্রানপণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন সেখানে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। সামরিক শাসনের ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানি কর্নেল এসে তাঁকে ভুয়া রিপোর্ট লিখতে বলে। জোর করে এমন রিপোর্ট লেখাতে চায়। ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ শুধু তা প্রত্যাখ্যানই করেননি, রাজশাহী মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ নিজের সভাপতিত্বে প্রথম প্রতিবাদ সভা করেন। সেখানে তিনি প্রেস রিলিজে বলেন ড. জোহাকে একটি গুলি নয়। কাছে থেকে শুধু বহু গুলিই মারা হয়নি, তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে অন্যায় ও অমানবিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। একজন শিক্ষক হত্যার এই খবর দাবালনের মোট সমস্ত পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে।

তুমুল আন্দোলনে সামরিক সরকার জেনারেল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। তারপরই ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে সিলেটে বদলি করা হয়। শুরু হলো নির্বাচনপরবর্তী আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের ৩ মার্চ থেকে তিনি সবাইকে আসন্ন গণহত্যার জন্য তৈরি হতে বললেন। ইমার্জেন্সি স্কয়াড, ব্লাড ব্যাংক তৈরি করলেন, কিন্তু অনেকেই তা অনুধাবণ করতে পারলেন না। ২৫ মার্চে যখন সবাই ভীতসন্ত্রস্ত আর পলাতক তখন যেন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল তাঁর মনোবল, আহত মানুষের ভিড়ে ডাক্তারশূন্য হাসপাতাল মহাব্যস্ত। পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞ বাড়তে লাগল বিপদের আশংকায় তাঁর চাচাসহ অনেকেই তাঁকে সিলেট থেকে সরে যেতে অনুরোধ করলেন। নিজের মা এবং ছেলেমেয়েদের রণকেলী গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। ছোট ছেলে তখন মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। স্ত্রী সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা এক বাসায় থাকতে বললেন যদি নার্সের কাজে লাগতে হয়।

২৩ মার্চ ক্যাপ্টেন (অব) মুত্তালিব আর বাসায় এসেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্রের আসামি করে চাকরিচ্যুত, জেলে থাকার সময় অত্যাচারের ব্যথার চিকিৎসা জন্য তাঁর কাছে আসতেন। মুত্তালিব বললেন খাদিম নগর পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে একজন বাঙালি সৈনিক তাঁর কাছে একটি নামের লিস্ট নিয়ে এসেছে আর তাতে ওপরের দিকে ডা. শামসুদ্দিনের নাম। মুত্তালিব তাঁর পর এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজীর বাসার দিকে ছুটলেন খবর দিতে। মনে হলো আরও অনেক কিছুর সাথে রাজশাহীর ড. জোহা হত্যার ঘটনায় হত্যা করার লিস্টে তাঁর নাম উঠেছে। যুদ্ধ শুরু হলে নিজের জন্য চিন্তা করার সময় নেই ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের। অনবরত অপারেশন করতে হচ্ছিল। রক্ত লাগবে, ওষুধ লাগবে, নার্সদের নিরাপদ জায়গায় পাঠাতে হবে। এরমধ্যে ২ এপ্রিল পাকিস্তানিরা তাদের ব্যাটালিয়নের দুজন বাঙালি অফিসারকে গুলি করে হাসপাতলে ফেলে গেল। ক্যাপ্টেন মাহবুবের অবস্থা খুব খারাপ। অনেক চেষ্টা করে বাঁচানো গেল না। লেফটেন্যান্ট ডা. সৈয়দ মাইনুদ্দিন আহমেদ কম আহত হওয়ায় বেঁচে গেলেন। ডা. শামসুদ্দিন তাঁকে একজন লোক দিয়ে হাসপাতাল থেকে দূরে গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। লেফটেন্যান্ট ডা. মাইনুদ্দিন বার বার তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলেন। যখন ডা. শামসুদ্দিন তাঁকে আশ্বাস দিতে চাইলেন, তখন ডা.মাইনুদ্দিন আকুল কণ্ঠে বললেন, স্যার আমি তাদের ডাক্তার ছিলাম এতদিন। আমাকেই যদি তারা গুলি করতে পারে তবে আপনাকে সবার আগেই হত্যা করবে। চুপ করে ছিলেন ডা. শামসুদ্দিন। অতঃপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, তুমি এখনই যাও, নাহলে দেরি হয়ে যাবে। আমার হাসপাতাল আর রোগীদের ফেলে কোথাও যাওয়া যাবে না।

আজো ডা. সায়ীদ, ডা. মাইনুদ্দিন সেদিনের কথা অক্ষেপের সাথে মনে করে শিউরে ওঠেন। আজকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবার জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান শহীদ অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের কথা, জাতির জনকের কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা আমাদের জানতে হবে। জানাতে হবে, আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য যতই আমরা জানতে পারবে ততই গর্বিত আর অনুপ্রাণিত হবে আমাদের প্রজন্ম।

সৌজন্যে: প্রথম আলো নর্থ আমেরিকা

You might also like