জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভার্চুযাল সভা অনুষ্ঠিত
বিশেষ প্রতিবেদক
সত্যবাণী
লন্ডন: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে প্রবাসীদের যথাযথ ভুমিকা রাখার আহবান জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এই আহবান জানানো হয়।
গত ২৯ জানুয়ারি এ ভার্চুয়াল সভায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগঠনের নেতাকর্মী ও গুণীজন বক্তব্য রাখেন ও অংশগ্রহন করেন। নির্মূল কমিটি যুক্তরাজ্য শাখার কার্যকরি সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও বাচিকশিল্পী সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মুনিরা পারভীনের অনবদ্য সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে যুক্ত হন অতিথিবৃন্দ।
সৈয়দ এনামূল ইসলাম তার সূচনা বক্তব্যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সংগ্রামী সভাপতি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও সংগ্রামের সারথি কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান, কবির চৌধুরী ও প্রথিতযশা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা স্মরণ করেন ও শ্রদ্ধা জানান। সূচনা বক্তব্যের পর সভায় বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও যুক্তরাজ্য কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহ। এর পর বক্তব্য রাখেন অতিথি বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনীম। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, ইউরোপিয়ান কমিটির সভাপতি তরুন চৌধুরী, যুক্তরাজ্য নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাকালিন সংগঠক স্বাধীন খসরু, স্বাধীনতা ট্রাস্টের সভাপতি ও যুক্তরাজ্য নির্মূল কমিটির সাবেক সভাপতি জুলি বেগম, যুক্তরাজ্য নির্মূল কমিটির সহসভাপতি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, সংগঠনের কার্ডিফ কমিটির সভাপতি সাংবাদিক মকিস মনসুর, যুক্তরাজ্য কমিটির কার্যকরি সদস্য জেসমিন চৌধুরী ও জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী গৌরী চৌধুরী।
ভার্চুয়াল সভায় দেশাত্মকবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন খ্যাতিমান শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী ও কলকাতা থেকে জনপ্রিয় শিল্পী মহুয়া চৌধুরী। আবৃত্তিতে অশগ্রহণ করেন সংগঠনের যুক্তরাজ্য কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক সেলিনা আকতার জোসনা। জুম প্লাটফর্মে আয়োজিত সভায় এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক ড. নুরুন্নবী, কানাডা থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ, যুক্তরাজ্য কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক যুবনেতা জামাল খান, সিনিয়র সহ সভাপতি মতিয়ার চৌধুরী, সংস্কৃতিকর্মী শেখ নূরুল ইসলাম, নাজমা হোসেইন, জোস্না পারভিন, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ বেলাল রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান, শহীদ সন্তান প্রশান্ত পুরকায়স্থ, মোহাম্মদ আব্দুর রাকিব, ইজলিংটন বারার কাউন্সিলর তালাল আজিজ, ভারত থেকে অধ্যাপক সোমনাথ চট্টপাধ্যায় ও অধ্যাপক অক্ষয় পাল, শাহিনা বেগম, অস্ট্রেলিয়া থেকে অধ্যাপক ফিরোজ আলম, বাংলাদেশ থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক সেলিম সামাদ এবং রাজনীতিবিদ আয়ুব করম আলীসহ অর্ধশতেরও বেশী বিশিষ্ট ব্যক্তি। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্য নির্মূলকমিটির ফেইসবুক পেইজ, এ আর নেটওয়ার্ক টিভি ও ইউকে বিডিটিভিতে একযোগে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি সার্বক্ষণিকভাবে দেখেন হাজারেরও বেশী দর্শক।
ভার্চুয়াল সভার শুরুতে সংগঠনের সংগ্রামী নেত্রী প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে লেখা বিপ্লবের আহবান জানানো তেজদীপ্ত ঐতিহাসিক চিঠি পাঠ করে শোনান সঞ্চালক মুনিরা পারভীন।
বক্তারা দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হতো-না ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জন্ম না-হলে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বলিষ্ট নেতৃত্বই ঘাতকদের বিচারকে ত্বরান্বিত করেছে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে প্রবল প্রতিকূল অবস্থায় শুরু করা এই আন্দোলন ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জের। তখনকার সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা কর্মীদের ওপর দেশদ্রোহী মামলা দিয়ে গ্রেফতার ও হয়রানি করেছে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রবল সমর্থন তখন ছিল চ্যালেঞ্জের অন্যতম শক্তি।
কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, বাংলাদেশের বাইরে প্রথম যুক্তরাজ্যে সংগঠন গড়ে তোলেন আজকের সভায় উপস্থিত আনসার আহমদ উল্লাহ ও স্বাধীন খসরুসহ অন্যান্যরা, এরপরে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে। আমি তাদের সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাই। তিনি বলেন, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেই ছাড়বো। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতায় এসেই এদের বিচার সম্পন্ন করে। জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ। শাহরিয়ার কবির বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের অনুসারীদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে রয়েছে, যারা অব্যাহতভাবে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। নানা চ্যারিটির নামে বাংলাদেশে জংগি কার্যক্রমে কিভাবে অর্থ প্রদান করছে তা সকলেই জানেন। এদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদেরও তারা বর্তমানে জঙ্গীবাদে মদদ দিচ্ছে, নানাভাবে অর্থ সহায়তা করছে। মানবধিকারে বিশ্বাস করে না এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। যুক্তরাজ্যে এই মৌলবাদীদের উত্থান রোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের পদক্ষেপ নিতে এখন যুক্তরাজ্য নির্মূল কমিটির উদ্যোগী হওয়া জরুরী।
হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনীম বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী অপরাধী ঘাতক দালালদের বিচার সম্পন্ন করেছেন। এ সাফল্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ফল। তিনি বলেন, প্রবাসী বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনই জাতির পিতার আদর্শ ধর্মনিরেপক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তিনি বলেন, আমি অবগত করতে চাই, প্রবাসে প্রগতিশীল যে ব্যক্তিত্বরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন, তাদের মূল্যায়ন করার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর হলেও বাংলাদেশ সরকার থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী যুক্তরাজ্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাই। এটা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। কুচক্রীমহল দ্বারা বঙ্গবন্ধু হত্যার শিকার হলেও তাঁর সুযোগ্য কন্যা আবার দেশের হাল ধরেছেন। প্রবাসীরা মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের সাথে ছিলেন, এখনো আছেন, আপনাদের সহযোগিতায় এদেশ মানবিক প্রগতিশীল উন্নত দেশ হবে অবশ্যই।
সবশেষে বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী ‘আমার পরিচয়’ কবিতার শেষাংশ আবৃত্তি করেন। এ কবিতাটি উজ্জীবিত করে সকলেকে। অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা, অসাম্প্রদায়িক ও জঙ্গীবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান এবং সভায় অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভার্চুয়াল সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, ভার্চুয়াল সভার তত্বাবধান ও কারিগরী নির্দেশনায় ছিলেন এআর টিভির কর্নধার জয়দীপ রায় ও কেন্দ্রীয় নির্মূল কমিটির সাইফউদ্দিন রুবেল।