সঙ্গীতশিল্পী গৌরি চৌধুরীর ক্যারিয়ার ও কিছু না জানা কথা

সৈয়দ হিলাল সাইফ
সত্যবাণী

লন্ডন:  সঙ্গীত হলো মনের ভাষা। সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনায় মানবচিত্তের অন্তর্নিহিত ভাবগুলো যেভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তা অন্য কোন মাধ্যমে ততটা সম্ভব নয়। শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম সুর-রস-সুধা অবগাহন। এ সুধার সাগরে অবগাহন করার সৌভাগ্য সবার হয় না। যে মানুষ মৌলিক গানের সুর ধারায় অবগাহনে চেষ্টা করেন তারাই সৌভাগ্যবান।
এমনি একজন শিল্পী গৌরি চৌধুরী। তিনি সঙ্গীত জগতের এক নিবেদিত প্রাণ । একজন চমৎকার সুরেলা মোহমায়ার কন্ঠশিল্পী। বিলেতে বাঙালি কমিউনিটিতে সঙ্গীতজ্ঞ হিশেবে ব্যাপক পরিচিত। এদেশে হাতে গুনা যে ক’জন সঙ্গীতশিল্পী নিজের নাম ও খ্যাতির পাশাপাশি বাংলাদেশের গানকে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছেন, নিঃসন্দেহে গৌরি চৌধুরী তার একজন। গৌরি চৌধুরীর গান শুনে এমন কেউ নেই যে, বিমোহিত হননি। সুরের ঐশ্বরিক জগতে যে কেউ হারিয়ে যেথে পারেন তার কন্ঠের যাদুকরি মাধুর্যে।

স্বপরিবারে গৌরি চৌধুরী

কিন্তু, আমরা যারা সঙ্গীত ভালোবাসী, তারা শিল্পীদের সম্পর্কে  কতটুকু জানি! তাদের সুখ দুঃখের কথা কখনো জানার চেষ্টা কী করেছি?
তাদের কন্ঠসুধা আমরা পান করি বটে, কিন্তু বুকের ভেতরের ক্ষতটা যখন দুচোখের নোনাজল হয়ে ঝড়ে পড়ে, তখন আমরা যারা শ্রোতা তারা তা বুঝে ওঠতে পারিনা।

রাধা রমন দত্তের গান “ভ্রমর কইও গিয়া”। যারা সঙ্গীত শুনেন এবং ভালোবাসেন তারা সবাই এই গান যে শুনেছেন তা দৃঢ়ভাবে বল্লে অত্যুক্তি হবেনা। একই সাথে গানটির মৌলিক শিল্পী হিশেবে দিলরুবা খানের নামও সবাই জানেন এখন পর্যন্ত। কিন্তু কঠিন সত্য হচ্ছে, এই গানের প্রথম রেকর্ড যিনি স্বকন্ঠে করেন, তিনি হলেন শিল্পী গৌরি চৌধুরী। বহু বছর পর আজ একটি লাইভ অনুষ্ঠানে শিল্পী গৌরি চৌধুরী তার সেই কষ্ট ওআক্ষেপের কথাগুলো শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললেন।  যখন কথা বলছিলেন, তখন  ঐসময় অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠেন গৌরি চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘আজকে আমারা বিলেতে বাঙালি শ্রোতাদের কাছে অনেকটাই জায়গা করে নিয়েছি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি একজন সঙ্গীত শিল্পী হিশেবে। শাহ আব্দুল করিম, রাধারমন, দূর্বীণশাহকে নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। লন্ডনের রয়েল লন্ডন ফেস্টিভ হলে বার’শো, তের’শো বাচ্ছা নিয়ে ইংলিশদের দিয়ে গান করাচ্ছি। বাংলা সংস্কৃতিকে আমরা প্রমোট করে যাচ্ছি। কিন্তু আক্ষেপটা থেকেই যায় ! আমার বাড়ির মানুষ, অঞ্চলের মানুষরা (মূলত তিনি সারাদেশের মানুষের কথা বুঝাতে চেয়েছেন) আমাকে সেভাবে চেনেনা। আমি নিজেকে তাদের মাঝে চেনাতে পারিনি’। ‘ভ্রমর কইও গিয়া’  গানটি আমি নিজে সংগ্রহ করি। আমার বোনের শ্বাশুড়ীর দাদু ছিলেন রাধারমন দত্ত।
আমি আমার মাওই মা’র কাছ থেকে গানটি আনি এবং প্রচলিত সুরে ১৯৮৪ সালে সিলেট রেডিওতে গানটি রেকর্ড করি। তখন প্রায় সবকটি অনুরোধের আসরে আমার এই গানটি বাজানো হতো। জামাল উদ্দীন হাসান বান্না ভাই, হিমাংশু দা (হিমাংশু বিশ্বাস) কে জিঞ্জেস করে দেখতে পারেন’। এরপর গৌরি  যা বললেন তা সত্যিই  ছিলো খুবই পীড়াদায়ক!
গৌরি জানান, ১৯৮৭ সালে বিটিভিতে তিনি আবারো গানটি রেকর্ড করেন। মোস্তফা জামান আব্বাসীর উপস্থাপনায়, মুসা আহমেদের প্রযোজনায় একটি অনুষ্ঠান হতো তখন, নামছিলো ‘আপন ঠিকানা’। রেকর্ডিং শেষে সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। তবে অজ্ঞাত কোন একজনের হস্তক্ষেপে আমার রেকর্ড করা গানটি বিটিভিতে আর প্রচার হয়নি।’

আমরা জানি “ভ্রমর কইও গিয়া” গানটি গেয়ে দিলরুবা খান রাতারাতি তারকা বনে যান। দর্শক শ্রোতারা খুব পছন্দ করেন, রাধারমন দত্তের’ কালজয়ী এই গানটি। ১৯৮৯ সালের দিকে সম্ভবত দিলরুবা খান, গানটি রেকর্ড করেছিলেন। একজন গৌরি চৌধুরীর গাওয়া, ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ গানটি দেশের শ্রোতারা হয়তো গ্রহণ করতো অথবা করতোনা। কিন্তু, আতুড়ঘরে তাঁকে রুখে দিয়ে আমরা কখনোই সেটা বলতে পারিনা। জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার কাছ থেকেই গানটি সংগ্রহ করেছিলেন দিলরুবা খান। গৌরি চৌধুরীর গান যারা শুনেছেন, তারা নিশ্চই বিশ্বাস করে থাকবেন, “ভ্রমর কইও গিয়া” গানটি, আজো গৌরির কন্ঠে এক অন্যরকম আবেদন, আবেগ ও অনুভূতির সৃস্টি করে । সেদিন যদি বিটিভিতে গৌরির গান পরিবেশন করা হতো, আজকে হয়তো সারাদেশের মানুষ গৌরি চোধুরীকে এক নামে চিনতো। গৌরিকে কয়েক যুগ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আক্ষেপ করে এইসব কথা বলতে হতোনা। বোম্বের নায়ক সুসান্ত রাজপুতের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার তুলনা করে গৌরি বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক আর্টিস্টের সাথে এরকম আচরণ করা হচ্ছে। আমি নিজেও এর শিকার হয়েছি।’

You might also like