সিনহা হত্যা মামলার ৫ম সাক্ষী:লিয়াকত গুলি করেন, জুতা পায়ে গলা টিপে মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওসি প্রদীপ

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

ঢাকাঃ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টের বিপরীতে আমার কর্মস্থল মসজিদে এশার নামাজের পর অপেক্ষা করছিলাম। রাত সাড়ে ৯টার দিকে একটি গুলির আওয়াজ শুনে দৌঁড়ে চেকপোস্ট এলাকায় আসি। দেখি ইন্সপেক্টর লিয়াকত এক লোককে গুলি করেছেন। প্রথম গুলির পর পর আরেকটি গুলি করেন। কাছে গিয়ে লাথি দিলে লোকটি সড়কে নেতিয়ে পড়ে। তখন আরো দুই রাউন্ড গুলি করা হয়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়লেও তখনো তিনি জীবিত ছিলেন। পানি পানি বলে ছটফট করছিলেন। কিন্তু কেউ তাকে পানি দেয়নি। অল্পক্ষণ পর টেকনাফের দিক থেকে আসা গাড়ি থেকে নেমে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি গাড়ি থেকে নেমে ইনসেপেক্টর লিয়াকতের সাথে কথা বলে। পরে গুলিবিদ্ধ লোকটির কাছে আসে প্রদীপ। তখন লোকটি আবারও পানি চায়। কিন্তু, প্রদীপ পানি না দিয়ে তাঁর বুকে লাথি মারেন। জুতা পায়ে লোকটির গলা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওসি প্রদীপ। পরে জানতে পারি মারা যাওয়া লোকটি সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা।

আলোচিত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার দ্বিতীয় দফায় সাক্ষ্যগ্রহণের তৃতীয় দিনে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এমন স্বাক্ষ্য দিয়েছেন পঞ্চম সাক্ষী বাহারছড়ার বায়তুন নুর জামে মসজিদের ইমাম ও হেফজখানার শিক্ষক হাফেজ মো. আমিন। মামলার সাথে জড়িত একাধিক আইনজীবীর সূত্রে এসব কথা জানা যায়।

মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে তিনিই একমাত্র স্বাক্ষ্য দেন। তার জবানবন্দি নেওয়ার পর ১৫ জন আসামীপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেন বলে জানিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌসুলি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।

প্রত্যক্ষদর্শী হাফেজ মো. আমিনের জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) ১০টা ৫ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েছিলেন আমিন। তাই সিনহার সফরসঙ্গী সিফাতের মতোই হাফেজ আমিনের জবানবন্দি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।তবে, হাফেজ আমিনের সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে ওসি প্রদীপের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, হাফেজ আমিন মূলত রোহিঙ্গা। সে নিজেই জানে না, ওই মসজিদের কমিটিতে কারা আছে। যে ব্যক্তি মসজিদ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম জানেন না, কী করে সে মসজিদের ইমাম হয়! তাই আমরা মনে করছি সে সব মিথ্যে বলছে।হাফেজ আমিনকে রোহিঙ্গা দাবি করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, আমিন টেকনাফের শামলাপুরের ২৩ নং ক্যাম্পে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিক। যেখানে ক্যাম্প থেকে বের হতেই অনুমতি লাগে, সেখানে সে কী করে প্রত্যক্ষদর্শী হয়।

কিন্তু এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন তালবাহানায় সময়ক্ষেপন করছেন। অপ্রয়োজনীয় কথা বলছেন যাতে সাক্ষীরা বিভ্রান্তিতে পড়ে।কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, মামলার ৫নং সাক্ষী আদালতকে যথার্থ বলেছেন। তিনি রোহিঙ্গা নাগরিক নন, বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া, তিনি হত্যাকান্ডের দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি যা দেখেছেন তাই আদালতে বর্ণনা করেছেন। তাকে রোহিঙ্গা বলার কোন যৌক্তিকতা নেই। এটি মামলাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার আসামি পক্ষের কৌশল। এতে বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই।এদিকে, মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার ৬ষ্ঠ দিনের বিচারকার্য শুরুতে সরকারি নীতিমালার আলোকে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ একজন প্রথম শ্রেণির অফিসার হিসেবে কারাগারে যে সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবী করেন এডভোকেট রানাদাশ গুপ্ত । সে সময়ে তিনি কারাগারে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে প্রদীপের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের আবেদন করেন তিনি। আদালত কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ দিয়েছেন।

অন্যদিকে, আসামি পক্ষের অপর এক আইনজীবী ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল তা তলবের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে দেন।এসময় সরকারি কৌসুলি তার বিরোধীতা করে বলেন, এটি একটি রাষ্ট্রীয় নথি। এটি এই মামলায় এই মুহূর্তে উপস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। এর পরপরই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাফেজ মো. আমিনের জবানবন্দি রেকর্ড শুরু করেন আদালত।আদালতের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বাপ্পী শর্মা জানান, অন্য দিনের মতো সকাল পৌঁনে ১০টার দিকে মামলার আসামী সাবেক ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১৫ আসামীকে কারাগার হতে আদালতে আনা হয়। দ্বিতীয় দফার ৩য় দিনের জন্য হাফেজ মো. আমিন, শওকত আলী ও সাইফুল আবছার আবুইয়ার সাক্ষ্যের হাজিরা দেওয়া হয়। প্রথম দিন ৬ জনের এবং দ্বিতীয় দিনে ৩ জনের হাজিরা দেওয়া হলেও মাত্র একজন করেই সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এরপরও দ্রুততায় সম্পন্ন হবার আশায় ৬ষ্ঠ দিনেও তিনজনের হাজিরা দেওয়া হয়।

পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা থাকে হাজির সবার সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করার। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীদের অসহযোগিতাই তা সম্ভব হয় না।তারা সাক্ষীকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করেন। আর ১৫ আসামির ১৫ আইনজীবী আলাদাভাবে আধাঘন্টা করে জেরার সময় নিয়ে সাড়ে সাত ঘন্টা সময় লাগে।জবানবন্দী নিতেও সময় লাগে ঘন্টা দেড়েক। এতে আদালতের কর্মঘন্টা ৯ ঘন্টা এবং মধ্যাহ্ন বিরতিসহ দাঁড়ায় ১০ ঘন্টা। ফলে একজনের বেশি সাক্ষীগ্রহণ সম্ভব হয়ে উঠছে না। আসামীপক্ষের আইনজীবিদের অসহযোগীতার কারণে ৬ দিনে মাত্র ৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়েছে।কাঠগড়ায় উপস্থিত আসামিরা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেবনাথ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান।তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নূরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব।২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।অভিযুক্ত আসামিদের মাঝে পুলিশের ৯ সদস্যরা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেবনাথ।অপর আসামিরা হলেন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

You might also like