সিলেটে দূর্গন্ধ দুর্ভোগ চরমে

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ বন্যায় ভাসছিল নগরের গোটা উপশহর। কয়েক হাজার বাসাবাড়িতে ছিল পানি।রাস্তাঘাট ছিল পানির নিচে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ ছিল না। বসবাস করাই ছিল দায়।এ কারণে উপশহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হাজার হাজার বাসিন্দা। প্রায় দু’সপ্তাহ পর পানি নেমেছে উপশহরের। ২/১টি সড়ক ছাড়া সব ভেসে উঠছে। ঘরে ফিরছে মানুষ। গোটা উপশহরজুড়ে এখন ফের জেগে ওঠার লড়াই চলছে।গতকাল পাঁচ তারকা হোটেল রোজভিউ’র সামনের গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে নাকে ভেসে এলো উৎকট গন্ধ। দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। টিকে থাকা দায়। ভেতরে যতই ঢোকা হলো গন্ধ ততই আরও তীব্র হলো। পঁচা গন্ধ। বাসা, বাড়ি, ড্রেন সবখান থেকেই বাতাসে ভেসে আসছে গন্ধ। উপশহরজুড়ে দুর্গন্ধ এখন নতুন সমস্যা। যারা বাড়ি ফিরছেন, তারা বাসা বাড়ি পরিষ্কার করছেন। রোদে শুকাচ্ছেন ভিজে যাওয়া জিনিসপত্র। সেখান থেকেও আসছে গন্ধ। স্থানীয় কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিম। তার বাসার নিচতলায় ছিল বুক সমান পানি। গতকাল থেকে বাসার নিচতলা ধোয়া-মোছার কাজ শুরু করেছেন। অফিসেও ছিল পানি। আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যা। অনেক মালপত্রও ভিজে গেছে।

কাউন্সিলর সেলিম জানালেন, এ দৃশ্য কেবল আমার নয়। গোটা উপশহরের সব মানুষের। শতকরা ৯৮ ভাগ বাসার নিচ তলা পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। এসব জিনিসপত্র পচে এখন গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখনো ৩টি রোডে পানি। রোববার থেকে সিটি কর্পোরেশনের দু’টি গাড়ি পরিষ্কার শুরু করেছে। একটু সময় লাগবে; পরিষ্কার হয়ে গেলে দুর্গন্ধ কমে যাবে।তিনি জানান, ইতোমধ্যে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে; যাদের ময়লা আছে, তারা যেন বাসার সামনে রাখেন। সিটির কর্মীরা সেগুলো পরিষ্কার করবেন। বন্যায় মানুষ ছিলেন এক ধরণের দুর্ভোগে। এখন নতুন করে আরেক ধরণের দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বলে জানান তিনি।বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় টানা দুই সপ্তাহ বাড়ির বাইরে ছিলেন রাজনীতিবিদ মালেক খান। সকালে ডি ব্লকের বাসায় ফিরেন। বন্যায় নিচতলার পুরোটাই তছনছ হয়ে গেছে। পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল আসবাসপত্র। সবকিছু ভিজে পঁচে গেছে। পানিতে ভিজে গেছে বইপত্র। তিনি জানালেন, নিচতলার সব ভিজে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে কোনো দুঃখ নেই। তার সংগ্রহে মুক্তিযুদ্ধের অনেক বই ছিল। সেগুলো পানিতে ভেসে গেছে। অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলোর জন্য আফসোস করছেন তিনি।
এফ-ব্লকের বাসিন্দা কামাল আহমদ জানালেন, বৃদ্ধ মাকে নিয়ে তিনতলায় ছিলেন। ১৩ দিন পর নিচ তলা খুললেন। সব নষ্ট হয়ে গেছে। চারদিক থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এভাবে দুর্গন্ধ থাকলে উপশহরে বসবাস করা দায় হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।
শুধু উপশহরই নয়, এবারের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় নগরীর প্রায় অর্ধেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তালতলা এলাকা। ১৩ দিন পর গতকাল পানি নেমেছে। গোটা তালতলা জুড়ে এখন দুর্গন্ধে ভরা। পাশের ছড়ার পানি থেকে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। ব্যবসায়ীরা মুখে কাপড় গুঁজে ব্যবসা করছেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, তালতলায় সবার আগে পানি উঠে। সবার পরে নামে। এ কারণে যত ময়লা-আবর্জনা আছে সব এখানে এসে জমা হয়েছে। এখন গোটা এলাকা দুর্গন্ধময়। পার্শ্ববর্তী জামতলার অবস্থাও একই। কাজিরবাজার-তোপখানায়ও ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। পচা গন্ধে মানুষ পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুকিতে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটও তীব্র হয়েছে। ফলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে ঘরে ফেরা ওই এলাকার মানুষজন পড়েছেন নতুন সংকটে।স্থানীয় রুবেল আহমদ জানিয়েছেন, তোপখানা এলাকার হাজারো ঘরবাড়ি ছিল পানির নিচে। পানি নেমে যাওয়ার কারণে এখন ড্রেন, খাল ময়লার ভাগাড়। পানিতে ভেসে যাওয়া জিনিসপত্র এখন জমা হচ্ছে ড্রেন ও খালে। এ কারণে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই গন্ধের কারণে এখন বাসা বাড়িতে বসবাস শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।স্থানীয় কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সন্তুও জানিয়েছেন দুর্গন্ধের কথা। তিনি জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে ৮জন কর্মী দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তোপখানার এসিল্যান্ড গলি পরিস্কার করা হয়েছে। মির্জাজাঙ্গালের আশ্রয়কেন্দ্রও পরিষ্কার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব এলাকা পরিস্কার করা হচ্ছে। নগরীর ১২ ও ১০ নং ওয়ার্ডের কয়েকটি এলাকা থেকে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, পানিতে স্যুয়ারেজ লাইন, ড্রেনের ময়লা সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে পানি কমার সঙ্গে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে করে মানুষের মধ্যে নতুন করে দুর্ভোগ চরমে পৌঁছে বলে জানান তারা।সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে শহরকে ময়লামুক্ত করতে অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখনো অনেক স্থানে পানি থাকায় ময়লা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। এরপরও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে যতটুকু সম্ভব দুর্গন্ধ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।এদিকে, গ্রামের মানুষজনও রয়েছেন দুর্ভোগে। বন্যার পানি নামতে শুরু করায় ভেসে উঠছে ক্ষত। একই সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থাও তছনছ হয়ে গেছে।জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমাসহ কয়েকটি উপজেলার রাস্তাগুলোর বেহাল দশা। অনেক স্থানে রাস্তা ভেঙে ঢলের পানি প্রবাহিত হয়েছে। যোগাযোগের অভাবে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ। এছাড়া পানিতে কয়েক হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগস্ত হয়েছে।এখনো অনেক এলাকার রাস্তাঘাটে পানি। সিলেট-জকিগঞ্জ, সিলেট-বিয়ানীবাজার ও সিলেট-বালাগঞ্জ সড়ক, সিলেট-ঢাকা হাইওয়ের বঙ্গবীর রোড-চন্ডিপুল সড়ক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। সড়কের ওপর পানি থাকার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

You might also like