‘সেইভ দ্য ব্রিক লেইন’ এর সংবাদ সম্মেলন: স্থানীয়দের বসতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

লন্ডনঃ স্থানীয় কমিউনিটির মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলা টাউন এলাকার ব্রিক লেইনে বড় বাণিজ্যক শপিং মল এবং অফিস কমপ্লেক্স করার যে অনুমতি দিয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল তার বিরুদ্ধে এবার আইনী পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। গত ২৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সেইভ দ্য ব্রিক লেইন’ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এমন পদক্ষেপের কথা জানান। লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব কর্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলা টাউন থেকে স্থানীয় বসতি উচ্ছেদের প্রধান শিকার হবেন বাঙালিরা। তাই কাউন্সিলের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত রুখে দিতে কমিউনিটির সকলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোট চাইতে আসা প্রার্থীদের ব্রিক লেইন রক্ষায় তাঁদের ভূমিকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার জন্যও আহবান জানান। তাঁরা বলেন, স্থানীয় রাজনীতিকরা সুন্দর সুন্দর কথা বলে ভোট চাইতে আসেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা কাউন্সিলে কমিউনিটির স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিবাদ করেন না।

ব্রিক লেইনের ‘ট্রুম্যান ব্রিউরি’ ভবনে বিশাল শপিং মল এবং অফিস কমপ্লেক্স করার অনুমোদন দিয়েছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এই পরিকল্পনা নিয়ে কাউন্সিল পরিচালিত মতামত যাচাইয়ে সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ প্রকল্পটির বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছিলেন। বিপরীতে মাত্র ৮২ জন ব্যক্তি প্রকল্পটির পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অথচ বিপুল সংখ্যাক স্থানীয় বাসিন্দার আপত্তি ও মতামত উপেক্ষা করে গত ১৪ সেপ্টেম্বর কাউন্সিললের প্ল্যানিং কমিটি প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। প্ল্যানিং কমিটিতে ছিলেন মাত্র তিনজন। ওই তিনজনের মধ্যে কাউন্সিলর আব্দুল মুকিত চু্ন্নু প্রকল্পটির বিপক্ষে ভোট দেন। আর বাকী দুজন কাউন্সিলর কাহার চৌধুরী ও ক্যারেন ব্রাডি প্রকল্পটির পক্ষে ভোট দেন। এই দুজনের ভোটেই সাড়ে সাত হাজার বাসিন্দার মতামত নাকচ হয়ে যায়। প্রকল্পটি পাশের এই প্রক্রিয়া কতটা যৌক্তিক সেই প্রশ্নও তোলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

ক্যাম্পেইনাররা বলছেন, এমন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ব্রিক লেইনে জায়গা দেয়ার কারণে এ এলাকায় ঘর-বাড়ির দাম ও ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বাড়বে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে স্থানীয় লোকজনের ছোটখাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। ভাড়া পোষাতে না পেরে স্থানীয় গরিব বাসিন্দারা দ্রুত এই এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন। বছরের পর বছর ধরে কমিউনিটি গড়ে তোলা স্থানীয়দের হটিয়ে বড় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও ধনিদের জায়গা করে দেয়ার এই প্রক্রিয়া সোশ্যাল ক্লিনজিং বা উচ্ছেদের সামিল।সেইভ দ্য ব্রিক লেইন’ ক্যাম্পেইনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলো হলো- বেঙ্গলি ইস্ট অ্যান্ড হেরিটেইজ সোসাইটি, ইস্ট অ্যান্ড প্রিজারভেশন সোসাইটি, নিজর মানুষ এবং স্পিটালফিল্ডস ট্রাস্ট।লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘ট্রুম্যান ব্রিউরি’ একটি পারিবারিক সম্পত্তি। কাউন্সিল থেকে শপিং মল ও অফিস করার অনুমোদন আদায়ের মাধ্যমে পরিবারটি বিলিয়ন পাউন্ডের বেশি লাভবান হবে। কিন্তু এর বিপরীতে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসা গ্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্ছেদের শিকার হতে হবে। কাউন্সিল এই প্রকল্পের অনুমোদন দিতে গিয়ে স্থানীয় বসতির ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি। কেবল কাউন্সিলের আয় বাড়ানোর অজুহাতে স্থানীয় কমিউনিটির এত বিশাল ক্ষতি অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য।

বেঙ্গলি ইস্ট অ্যান্ড হেরিটেইজ সোসাইটির সাইফ ওসমানি বলেন, ক্যাম্পেইনারদের পক্ষ থেকে কাউন্সিলকে বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে ‘ট্র্যুম্যান ব্রিউরি’র স্থানে ফ্ল্যাট তৈরির (আবাসন প্রকল্প) পরামর্শ দেয়া হয়। যেখানে স্থানীয়দের জন্য ৫০ শতাংশ ফ্ল্যাট বরাদ্দ থাকবে। তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসে প্রায় ২০ হাজার মানুষ কাউন্সিল ঘরের জন্য অপেক্ষা করছে। এখানে ঘর নির্মান হলে স্থানীয়দের সেই চাহিদা পূরণে কাজে আসবে। এতে ঐতিহ্যবাহী ব্রিক লেইন ও বাংলা টাউনের ঐতিহ্যও সুরক্ষিত থাকবে। কাউকে ব্যবসা বা এলাকা ছেড়ে যেতে হবে না।ইস্ট অ্যান্ড প্রিজারভেশন সোসাইটির জনাথন মোবারলি বলেন, কাউন্সিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাঁদের সামনে এখন বিকল্প তিনটি। এক. লন্ডন মেয়র অফিস দ্বারা সিদ্ধান্ত বাতিল করা। দুই. সেক্রেটারি অব স্টেইটকে দিয়ে সিদ্ধান্ত বাতিল করা। তিন. জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদন করে আইনী লড়াই। তিনি বলেন, জুডিশিয়াল রিভিউর জন্য ইতিমধ্যে তাঁরা গত এক মাসে ১০ হাজার পাউন্ডের তহবিল গঠন করেছেন। রিচার্ড হারউড কিউসিকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন। তবে তিনি বলেন, সবকিছুর আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। জনগণ রুখে দাঁড়ালে কাউন্সিল বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাতিলে বাধ্য হবে।

লেবার কাউন্সিলর পুরো মিয়া বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসকে বলা হয় তৃতীয় বাংলা। এখানে ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সূচনা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের এই সময়ে বাংলা টাউনে বাঙালিদের ভবিষ্যৎ বিশাল হুমকির মুখে। তিনি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালিদের যেন শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে কোনো ইস্যুতে বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে একটা লোক দেখানো প্রলোভন দেখিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়। যেমন- বাংলা লেখা গেইট, বাঙালির ঐহিত্যের ওয়াল, বা বাংলা সাইনবোর্ড করা হবে বলে খুশি করে দেয়া হয়। এর বিনিময়ে কৌশলে বাঙালিদের অস্তিত্বে একের পর এক আঘাত করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ‘বাংলা ভাষা’ শিক্ষার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ব্রিক লেইন ও বাংলা টাউন এলাকা ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসী, শরনার্থী ও দরিদ্র মানুষের আবাসস্থল ছিলো। সেটি রক্ষা করতে হলে কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত রুখে দাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

‘নিজর মানুষ’ সংগঠনের ড. ফাতেমা রেজিনা বলেন, ব্রিক লেইন ও বাংলা টাউন এলাকায় ডাস, ফ্রেঞ্চ, ইহুদি সহ অনেক জাতির মানুষের বসতি ছিলো। এক সময় আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে তাঁরা নিজেদের পছন্দে এই এলাকা ছেড়ে গেছে। কিন্তু বাঙালিরা নিজেদের ইচ্ছায় এ এলাকা ছাড়ছেন না। বরং পদ্ধতিগত উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন। ভাড়া বৃ্দ্ধিসহ জীবন যাপন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বাঙালিরা এখন বার্কিং, ডেগেনহাম কিংবা রেডব্রিজ এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

ব্রিক লেইনের ঐতিহ্য রক্ষায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন ক্যাম্পেইনাররা। ইতিমধ্যে তাঁরা কফিন মিছিল সহ কয়েকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে একটি গণসমাবেশ করবেন। পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের জন্য তহবিল গঠন চালিয়ে যাবেন। ব্রিক লেইনের ঐতিহ্য রক্ষা এবং কাউন্সিলের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আসন্ন নির্বাচনের আলোচনায় প্রভাব বিস্তার করবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

You might also like