স্মরণ: সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, পয়েট অফ পার্লামেন্ট

 সৈয়দ আনাস পাশা

৪ঠা ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের পার্লামেন্টারী রাজনীতির প্রাণপুরুষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চতুর্থ মৃত্যবার্ষিকী। ২০১৭ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী ইহলোক ত্যাগ করেন বাগ্মি এ রাজনীতিবিদ।

সুরঞ্জিত দা ছিলেন আমার নেতা। আমরা তাঁকে সেন দা বলেই ডাকতাম। তারুণ্যের সময়ে রাজনীতির সেই উত্তাল দিনগুলোতে তাঁর সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে বলেই আজকের এই স্মৃতিচারণ।
সুরঞ্জিত দা কে চিনতাম সেই শৈশব থেকেই। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে পারিবারিক সম্পৃক্ততাই এই চেনার সুযোগ করে দিয়েছিলো। অবশ্য ঘনিষ্ঠতা হয় আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে।
১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন। আমার বয়স তখন আর কতইবা হবে। ৭/৮ বছর। আমাদের এলাকায় (জগন্নাথপুর-দক্ষিন সুনামগঞ্জ) ন্যাপের প্রার্থী ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা গুলজার আহমদ। ন্যাপ নেতা বাবা সৈয়দ আহবাব আলী নির্বাচনী প্রচারণায় খুবই ব্যস্থ। এসময় মাঝে মাঝেই শুনতাম ন্যাপের তরুণ বাগ্মি নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম। তিনি নির্বাচন করছেন পাশের আসন দিরাই-শাল্লা থেকে। গুলজার আহমদ ছিলেন সুরঞ্জিত দা’রও নেতা। পাশের আসন থাকায় গুলজার আহমদের ২/১টি নির্বাচনী সভায় যেমন সুরঞ্জিত দা বক্তব্য রাখতেন,
ঠিক তেমনি সুরঞ্জিত দা’র ২/১টি সভায়ও বক্তব্য রেখেছেন গুলজার আহমদ। নির্বাচনী সভাগুলোতে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বিমোহিত করে ফেলতেন সেন দা।
এইতো গেলো শৈশবে চেনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
কলেজ জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ি। অনেকটা পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করেই ন্যাপ এর ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমিতির সাথে ঘটে সম্পৃক্ততা। ন্যাপ তখন তিন ভাগে বিভক্ত। ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (হারুন-পঙ্কজ) ও একতা পার্টি। ছাত্র সমিতি ছিলো ন্যাপ মোজাফফরের অঙ্গ সংগঠন। সুরন্জিত দা তখন একতা পার্টির নেতা। ন্যাপ মোজাফফরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন জননেতা পীর হবিবুর রহমান। সম্ভবত ১৯৭৭ বা ৭৮ সালেই ঐক্যবদ্ধ ন্যাপে প্রথম ভাঙ্গন দেখা দেয়। মতিয়া চৌধুরীসহ বিরাট একটি গ্রুপ যোগ দেন আওয়ামী লীগে। বাকিরা বিভক্ত হন ন্যাপ মোজাফ্ফর, ন্যাপ হারুন-পঙ্কজ ও একতা পার্টি নামে।
রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর থেকেই দেখতাম ঐক্যবদ্ধ ন্যাপের এই ভাঙ্গনে সবচেয়ে হতাশ ছিলেন জননেতা পীর হবিবুর রহমান। মোজাফফর ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক থেকেও ত্রিধাবিভক্ত ন্যাপকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস ছিলো তাঁর নিত্যদিনের কর্মকান্ডের একটা অংশ। অবশেষে পীর হবিবুর রহমানের সেই প্রচেষ্ঠা কিছুটা হলেও সফল হয়। তাঁর নেতৃত্বে মোজাফফর ন্যাপের বড় একটি গ্রুপ, ন্যাপ হারুন ও একতা পার্টি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা স্লোগান তুললাম ‘দুই ন্যাপ একতা, এগিয়ে চলো জনতা’। ঐক্য প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। অবশ্য বছর খানেক পর এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় মোজাফফর আহমদও শরিক হন। ১৯৮৫ সালের মধ্য বা শেষ ভাগে পীর হবিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিভক্ত তিন গ্রুপের নেতারা গঠন করেন দুই ন্যাপ ও একতা পার্টির ঐক্য মহা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। পীর হবিবুর রহমানকে দেয়া হয় কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব। ৮৬ সালের জানুয়ারীতে ঢাকার রমনাগ্রীনে ঐতিহাসিক ঐক্য মহা সম্মলনের মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত হয় ন্যাপ। যেহেতু অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তখনও ন্যাপের একটি গ্রুপ নিয়ে বাইরে, সেহেতু মিডিয়া নতুন পুনর্গঠিত ন্যাপের নাম দেয় ঐক্য ন্যাপ, প্রবীন রাজনীতিক আহমেদুল কবিরের সম্পাদনায় প্রকাশিত দেশের প্রাচীনতম জাতীয় দৈনিক সংবাদ পুনর্গঠিত ন্যাপের সংক্ষিপ্ত নাম উল্লেখ করতে গিয়ে লিখে এনএপি (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)।৮৬ সালের মধ্যভাগেই অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে পুনর্গঠিত ন্যাপ। সংগঠনের তিন আহবায়ক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পীর হবিবুর রহমান, চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং সুরন্জিত সেনগুপ্ত ও কামাল হায়দার, এই ৫জন বিজয়ী হন ঐ নির্বাচনে। সংসদে ন্যাপের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন সুরন্জিত দা।
এর আগে দুই ন্যাপ ও একতা পার্টির ঐক্য মহা সম্মেলন সামনে রেখে সারা দেশের ন্যায় সিলেটেও ন্যাপের সক্রিয়-নিস্ক্রিয় নেতাকর্মীদের মধ্যে পড়ে ব্যাপক সাড়া।
৮৬ সালের জানুয়ারীতে ঢাকায় ঐক্য মহা সম্মেলনে যোগদানের প্রস্তুতি গ্রহনের লক্ষ্যে সিলেটে পূর্ব জিন্দা বাজারে জেলা ন্যাপের কার্যালয়ের ছাদের উপর আয়োজিত সিলেট জেলা ঐক্য মহা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির এক সভায় ঐসময় উপস্থিত হন সুরন্জিত দা। একজন ছাত্রকর্মী
হিসেবে ঐ সভায় বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হয় আমারও। পরদিন সুনামগঞ্জে প্রোগ্রাম। সিলেট থেকে কে কে যাবেন, ঐ
কর্মীসভায়ই ঠিক হচ্ছে। সিলেট জেলা ঐক্য মহা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক জননেতা আব্দুল হামিদ ছাত্রদের মধ্য থেকেও ২/১ জনকে নিতে বললে সুরন্জিত দা বললেন, ‘বাবুল ( রুহুল কুদ্দুস বাবুল, জেলা ছাত্র সমিতির সভাপতি) ও আনাসকে লও, ভালো বক্তৃতা দেয় তারা।’
ভালো বক্তা হিসেবে সুরন্জিত দা’র ঐদিনের স্বীকৃতির কথা মনে হলে এখনও পুলকিত হই। পরদিন এক সাথে সুনামগঞ্জ যাওয়া ও স্থানীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে একই মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে সুরন্জিত দা’র সাথে সেই যে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় সেটি অটুট ছিলো তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। অবশ্য ১৯৯৫ সালে ব্রিটেন প্রবাসী হওয়ার পর এই ঘনিষ্ঠতায় ছেদ পড়লেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইনি কখনও।
সুরন্জিত দা’র সাথে একসাথে রাজনীতি, আবার রাজনৈতিক মতবিরোধ দুটোই উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে আমার।
ন্যাপ, পরবর্তীতে গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতিতে যেমন একসাথে ছিলাম তাঁর নেতৃত্বে, ঠিক তেমনি ৯৪ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠিত হলে সুরন্জিত দা’দের রেখেই চলে আসি সেই দলে। গণতন্ত্রী পার্টি ত্যাগ করার সময় বিবৃতি দেই, একটি ব্যাপকভিত্তিক আস্থাভাজন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন সুরন্জিত সেনগুপ্তসহ গণতন্ত্রী পার্টির নেতারা। গণফোরামে যোগদানের আগে গণতন্ত্রী পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সর্বশেষ বর্ধিত সভায় উপস্থিত ছিলাম। ঐ সভায় পীর হবিবুর রহমান গণতন্ত্রী পার্টিকে গণফোরামের সাথে সম্পৃক্ত করার পক্ষে অবস্থান নিলেও সুরন্জিত দা অবস্থান নেন এর বিপরিতে। তাঁর যুক্তি ছিলো ড. কামাল হোসেনের দ্বারা রাজনীতি হবেনা, গণফোরাম গঠনের তাঁর এ উদ্যোগ দেশের প্রগতিশীল শক্তিতেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে। সুরন্জিত দাকে সমর্থন করলেন সিলেটের জননেতা আব্দুল হামিদ। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বন্ধু আব্দুল হামিদ বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় পীর হবিবুর রহমান অভিমানে সভা ছেড়ে পার্টির ছিদ্দিক বাজারস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দোতলায় নিজের রুমে গিয়ে বসে থাকলেন। সুরন্জিত দা আমাকে ডেকে বললেন, পীরভাইকে নিয়ে আয় নিচে। রাজনীতিতে অভিমান করলেতো চলবেনা। তাঁর (পীর হবিবুর রহমান) কথাতো কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বলতে হবে, অনুমোদন করাতে হবে’।
আমি ও বন্ধু রুহুল কুদ্দুস বাবুল তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে একটি বিকল্প রাজনৈতিক দলের স্বপ্নে বিভোর। আমরা পক্ষ নিলাম জননেতা পীর হবিবুর রহমানের। সুরন্জিত দা কে বললাম, না, আপনাদের দ্বারা আর হবেনা, আমরা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি চাই। কামাল হোসেনের নেতৃত্বেই এটি সম্ভব।
তিনি বললেন, ‘রাজনীতিতে নেতা নয়, নিজের চিন্তাকেই প্রাধান্য দেয়া ভালো। আমি শ্রদ্ধা করি তোদের সিদ্ধান্তকে। যা, এক পার্টিতে না থাকলেও তোদের জন্য আমার শুভ কামনা সব সময়’। আসলে এক পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও সুরন্জিত দা’র অভিভাবকত্ব থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হইনি।
পরবর্তীতে সেন দা যোগ দিলেন আওয়ামী লীগে।
সুরন্জিত দা’র সাথের স্মৃতিগুলো নিয়মিতই নাড়া দেয়। ৮৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথমবার হেরে উপ নির্বাচনেও জগন্নাথপুরে প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ। তাঁর এই নির্বাচনী প্রচারণায় ভাটি অঞ্চলে নৌকায় করে সুরন্জিত দা’র সাথে ঘুরেছি কয়েকদিন। দেখেছি গ্রাম্য বাজারগুলোর ছোট ছোট পথসভা সুরন্জিত দা’র উপস্থিতিতে কিভাবে জন সভায় রূপ নিয়েছে।
১৯৯৫ সালে ব্রিটেনে আসার পর ৯৬ সালের মধ্যভাগে প্রথম দেশে যাই। সুরন্জিত দা তখন প্রধান মন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্ঠা। সংসদ ভবনে আমার স্ত্রীসহ তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমার স্ত্রীকে ওয়েলকাম করে বলেছিলেন, ‘আও গো, তুমিতো আমরার কুটুম ওখন, আমার নেতার বউ’। সেন দা ছিলেন এমনই একজন রসিক মানুষ। জাতীয় নেতা হলেও কর্মীদের সাথে ছিলো তাঁর বন্ধুর মত সম্পর্ক। মনে আছে, আমার বিয়ের আকদ পরবর্তী সময়ে সিলেটে এসে সার্কিট হাউসে আমাকে ডেকে নিয়ে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি ফুফাতো বোন বিয়ে করছি শুনে বলেছিলেন, ‘আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে, রোমান্সটা পুরোপুরি হয়নারে। এরপরও এটি তোরা তৈরি করে নিস’।
লন্ডনে আসলে দেখা হতো সুরন্জিত দা’র সাথে। সর্বশেষ রাজনীতি নিয়ে হোটেলে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন একান্তে। এই কথাগুলো কিছু থাকতো অফ দ্যা রেকর্ড আবার কিছু অন দ্যা রেকর্ড।
লন্ডনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে আমার শেষ কথা হয় তাঁর মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে। ২০১৬ সালের ১১-১৭ ডিসেম্বর কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের (সিপিএ) কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছেন তিনি। উঠেছেন ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের পার্ক প্লাজা হোটেলে, কনফারেন্সও অনুষ্ঠিত হচ্ছে এখানে। সিপিএ চেয়ারম্যান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিনসহ কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশের এমপিদের উপস্থিতিতে সরগরম পার্ক প্লাজা। এমনি এক সময় কনফারেন্সের বিরতিতে কথা হয় তাঁর সাথে। চেহারায় মরণব্যাধির আক্রমণের ছায়া। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে তাঁর রুমে বিছানায় বসেই তিনি কথা বলছিলেন।
সমসাময়িক রাজনীতি, চীনের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ইন্টারভিউ করতে চাইলে বললেন, ‘না কোন ইন্টারভিউ নয়, এমনিই কতক্ষণ গল্প করি তোর সাথে’। এই আলাপচারিতা নিয়ে কোন স্টোরি করতে নিষেধ করলেন। কথা দিলাম, করবো না। আলাপচারিতায় নিউজ আইটেম হওয়ার মত প্রচুর রসদ থাকার পরও তাঁর ইচ্ছের প্রতি সম্মান দিতে গিয়ে কোন স্টোরি ঐ সময় করিনি। ব্যক্তিগত ঐ আলোচনায় সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনেক কিছুই বলেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বলেছিলেন শেখ হাসিনার প্রতি তার আস্থার কথা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি প্রচণ্ড ভরসা ছিল প্রয়াত কিংবদন্তি এই রাজনীতিকের। এই ভরসা বা আস্থা শুধু তার একার নয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে শেখ হাসিনা পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই আস্থার জায়গা, এই আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প নেই, এমনটিই মনে করতেন তিনি। চীনের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সতর্কভাবে আগানো উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন ঐসময় সুরন্জিত দা। এতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে। বলেছিলেন, ভারত আমাদের অন্যতম ঘনিষ্ট প্রতিবেশী, তাদের আস্থায় রেখেই চীনসহ অন্য প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বলেছিলেন, ‘ভারতকে রেখে আমরা চীনের সাথে কতটুকু যেতে পারবো, সেই সীমানা চীনকেও বুঝতে হবে’। আপনি বা আপনার অন্য প্রবীণ সহকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে এই পরামর্শগুলো দেন কি না, এমনটি জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তারকা রাজনীতিক সুরন্জিত দা’র মন্তব্য ছিলো, ‘পরামর্শের এখন আর প্রয়োজন পড়ে না শেখ হাসিনা’র। পুড়ে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, রাজনীতিতে পোড় খেতে খেতে শেখ হাসিনাও এখন ঝুনা হয়ে উঠেছেন’।
তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনা যতটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতিটিতেই সফল হয়েছেন, এমনটি দেখার পর আমরা এখন আর কোন পরামর্শ দিতে যাই না। তাছাড়া দেশ ও দলের স্বার্থে বিভিন্ন সময় তিনি যে ঝুঁকি নিয়েছেন, তাতো আমরা অনেকেই নিতে পারিনি। সুতরাং ঝুঁকি নিচ্ছেন তিনি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ারও তার, বিষয়টি এভাবেই দেখা উচিত’।
তবে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শেখ হাসিনার আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করতেন সুরঞ্জিত সেন। তাঁর মন্তব্য ছিলো, ‘দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য শেখ হাসিনাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে’। ‘গ্লোবাল টেরোরিজম মোকাবেলায় শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিশ্ব নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে’ এমন মন্তব্য করে উপমহাদেশের প্রবীণ এই পার্লামেন্টারিয়ান বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা যে এখন দক্ষিণ এশিয়ার এসেট এটি এই অঞ্চলের মানুষ বুঝতে শুরু করেছে’।
একান্ত ঐ কথোপকথনে আরও অনেক কথা বলতে চেয়েছিলেন সুরঞ্জিত দা। কিন্তু খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো তাকে। এক পর্যায়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথা বলতে থাকেন। বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের কাতারে সামিল হতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দৌড়াচ্ছে বাংলাদেশ। এই দৌড়ে যোগ দিতে গিয়ে গণতন্ত্র, আইনের শাষন, মানবাধিকারের মত বিষয়গুলো গুরুত্বহীন হয়ে যেন না পড়ে’। দলীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশের কাছে শেখ হাসিনার ভিশনের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভালাভ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি, আলাপচারিতায় এমন অভিযোগও করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। বলেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নেতাকর্মীরা যে সময় ব্যয় করছেন, শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের খবর তৃণমূলে পৌঁছে দিতে সেই সময় ব্যয় করলে উন্নত দেশ হতে ২০৪১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না বাংলাদেশকে।

পার্লামেন্টারী রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে আমার সুরন্জিত দা’রকাছ থেকে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালীন সময়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন সুরন্জিত দা। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি।

ঐসময় পার্লামেন্টে সরকারের সমালোচনায় মাঝে মাঝে যখন মূখর হতেন, স্বাভাবিক ভাবেই তা ব্যাপক মিডিয়া আকর্ষন পেতো। তরুণ বিরোধী দলীয় সদস্য হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের স্নেহধন্য ছিলেন। পার্লামেন্টে তাঁর যুক্তিপূর্ণ রসালো বক্তব্য, সংবিধানের ধারা উপধারার ব্যাখ্যা প্রদানের ক্যারিসমেটিক যোগ্যতা বিষয়ে একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার দল ন্যাপের সবেধন নিলিমনি একজন মাত্র সদস্য হয়েও পার্লামেন্টারী রাজনীতি এত আয়ত্ব করলেন কিভাবে?’। উত্তরে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের নাম উচ্চারণ করে। বলেছিলেন, পার্লামেন্টারী রাজনীতি পাঠে ক্ষনজন্মা রাজনীতিক তাজউদ্দিন আহমেদের অনুপ্রেরণা, শিক্ষা ও সহযোগিতা আমার আজকের ‘পার্লামেন্টারিয়ান’ হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে’। ঐদিন তাজউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করেছিলেন সুরন্জিত দা। বললেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধান রচনাকালীন সময়ে বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে কথা বলতাম। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে আমি তখন পাঠশালার ছাত্র। অধিবেশন বিরতীকালীন সময়ে তাজউদ্দিন ভাইয়ের পাশে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। স্নেহ করে পাশে বসিয়ে সময় দিতেন, একজন বিরোধী দলীয় সাংসদ হিসেবে কিভাবে কথা বলবো শিখিয়ে দিতেন। তাগিদ দিতেন পড়াশোনার। সারা বিশ্বের পার্লামেন্টারী রাজনীতি স্টাডি করার পরামর্শ দিয়ে বলতেন সংবিধান আয়ত্বে না আনলে পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে অগ্রসর হতে পারবেনা।’
তাজউদ্দিন আহমেদের উপদেশ অনুসরণ করেছিলেন সেনগুপ্ত। বিশ্ব পার্লামেন্টারী রাজনীতি স্টাডি করে করেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সংবিধান পন্ডিত, সংসদের কবি। এই কবি যখন সংসদে দাড়াতেন, কথা বলতেন, সব সদস্য তন্ময় হয়ে শুনতো তাঁর সেই কথা। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী। অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মানুষের মাঝে বেশি পরিচিত ছিলেন সংসদে তার চাতুর্যপূর্ণ এবং রসাত্মক বক্তব্যের জন্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে বিপক্ষের নেতাদেরও সমীহ পেয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে পয়েট অফ পার্লামেন্ট সুরন্জিত সেনগুপ্তের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন দাদা। ইতিহাসে নায়ক হয়েই থাকবেন আপনি চিরকাল। সুরন্জিত সেনগুপ্তের ভক্তদের কবির ভাষায় বলি, ‘’অতএব দৃঢ় চিত্তে বলি শোন, সূর্য অস্তমিত হয় না কখনও’’।উপমহাদেশের পার্লামেন্টারী রাজনীতির ইতিহাসে সুরন্জিত সেনগুপ্ত নামের এই সূর্য আলো ছড়াবে অনন্তকাল।

(লেখক: সাংবাদিক, সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক)

You might also like