হিমালয়ের ‘বাস অযোগ্য’ উপত্যকা নিয়ে কেন বারবার লড়ছে চীন-ভারত?

আন্তজার্তিক ডেস্ক
সত্যবাণী

চীন-ভারত: ভারত ও চীনের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ নতুন কিছু নয়। কিন্তু ১৯৬২ সালের পর সীমান্তে উভয় দেশের মধ্যে কোনও সংঘাত এতোটা প্রাণঘাতী হয়নি, যা ঘটেছে সোমবার রাতে (১৫ জুন) । ওই সময় এলাকাটি নিয়ে ভারত ও চীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষেরই বিপুল প্রাণহানি হয়েছিল। কিন্তু সোমবার কোনও গুলি বিনিময় ছাড়াই কিল-ঘুষি, পাথর, ব্যাটন ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রায় চার ঘণ্টার সংঘর্ষে অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা নিহত ও ৭৬ জন আহত হয়েছে। অথচ হিমালয়ের বিরোধপূর্ণ এলাকাটি অবস্থান ও তাপমাত্রার নিরিখে মানুষের বসবাস উপযোগী নয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে আকসাই চীন এলাকাটি কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ- তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।

চার দশকেরও বেশি সময় পর সোমবার (১৫ জুন) থেকে আবারও প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে ভারত-চীন সীমান্ত বিবাদ। সোমবার রাতে চীন নিয়ন্ত্রিত কিন্তু ভারতের দাবিকৃত আকসাই চীনের কাছাকাছি গালওয়ান উপত্যকায় উভয় দেশের সেনাদের সংঘাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। চীনের কোনও বা কতজন সেনা নিহত হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। উভয় দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অতিক্রম করার অভিযোগ তুলছে। সংঘর্ষের বিস্তারিত যেটুকু জানা গেছে তা এখনও বিভ্রান্তিকর এবং হয়ত কখনোই পুরোপুরি স্পষ্ট হবে না।

পারমাণবিক শক্তিধর দুটি প্রতিবেশী এখন দ্রুত উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে। যদিও উভয় দেশেরই পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কট্টর জাতীয়তাবাদী ও যুদ্ধবাজ কণ্ঠস্বরের কিছু মানুষ বৃহত্তর দ্বন্দ্ব ও আগ্রাসনের আহ্বান জানাচ্ছে। এক্ষেত্রে চীন ওই এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে এবং ভারতও নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে। যদিও ওখানকার সামরিক শক্তি নিয়ে নয়া দিল্লির কণ্ঠে তেমন জোর নেই।

আকসাই চীন এলাকাটিকে জিনজিয়াং এর অংশ বলে দাবি করে থাকে চীন। আর ভারত দাবি করে এটি লাদাখের অংশ। এলাকাটি ঠাণ্ডা ও সেখানে বসবাস করা কঠিন। এমন কী গ্রীষ্মকালেও এলাকাটি তুষারে ঢাকা থাকে। তাছাড়া এটি হিমালয় অঞ্চলের অত্যন্ত উঁচুতে অবস্থিত, এর গড় উচ্চতা ১ হাজার ৪০০ ফুট। যে উচ্চতায় বসবাস করতে গেলে মানুষ অসুস্থ হতে পারে অর্থাৎ প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, বমিভাব কিংবা অবসাদ দেখা দিতে পারে তার চেয়েও দ্বিগুণ উচ্চতায় অবস্থিত এই আকসাই চীন।

সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়, এলাকাটির উঁচুতে অবস্থান ও শীতল তাপমাত্রা সোমবারের (১৫ জুন) সংঘর্ষে প্রাণহানির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের তিন সেনা নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছিল। পরে তারা জানায়, অতি উচ্চতায় অবস্থিত ওই এলাকায় হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রার কারণে আহত হওয়া আরও ১৭ সেনার মৃত্যু হয়েছে।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নেভিল ম্যাক্সওয়েল তার লেখা “ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার” নামক বইয়ে আকসাই চীন এলাকাকে উল্লেখ করেছেন, “‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ যেখানে কিছুই উৎপাদিত হয় না, কেউ বসবাস করে না”। বইটিতে ম্যাক্সওয়েল লিখেছেন, আকসাই চীন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব সবসময়ই বিভ্রান্তিমুলক। ১৮০০ শতকের বেশিরভাগ সময় ধরে রাশিয়া, ব্রিটেন ও চীন- এ তিন সাম্রাজ্যের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল হিমালয় অঞ্চল। এ তিন দেশই হিমালয় অঞ্চলের বিভিন্ন অংশের মালিকানা দাবি করে আসছিল। উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর এ এলাকার মালিকানা নিয়ে আরও বেশি করে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ তৈরি হলো; বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর। আকসাই চীন বৃহত্তর কাশ্মিরের অংশ। তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দুই দেশ আলাদা হয়ে গেলেও চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমানার প্রশ্নটি ভালোভাবে মীমাংসিত হয়নি।

ভারত আকসাই চীনকে লাদাখের অংশ বলে দাবি করে থাকে। লাদাখ হলো কাশ্মির উপত্যকার পূর্বে অবস্থিত একটি দুর্গম পার্বত্য গ্রাম। ব্রিটিশ বিশ্লেষক ল্যারি ওর্টজেল মার্কিন সেনাবাহিনীর এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, “ব্রিটিশ উপনিবেশিক কালে নির্ধারণ করে দেওয়া ম্যাকমোহন রেখাকে ভারত স্বীকৃতি দিলেও চীন কখনোই তা আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়নি। বরং একে ‘অভ্যাসের সীমানা’ মনে করে থাকে তারা; এই মনোভাব গত কয়েক দশক ধরে ওই এলাকার সংলগ্ন মানুষদের মধ্যে বিদ্যমান।”

ভারত ও চীন কোনও দেশই সীমান্ত নিয়ে পুরোপুরিভাবে সম্মত হতে পারেনি। দুই পক্ষই নিয়মিত একে অপরের বিরুদ্ধে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া, ভূখণ্ডের সম্প্রসারণ করতে চাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে থাকে।

লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হার্শ ভি. প্যান্ট মনে করেন, বর্তমান সংকটের ভিত্তি রচিত হয়েছে গত বছর ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পর।

হার্শ বলেন, ‘তখন থেকে বেইজিং-এর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, সামনের দিনগুলোতে চীনের জন্য পরিস্থিতি খারাপ করে তুলতে পারে ভারত। কাশ্মির অঞ্চলটি চীনকে পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে, তাদের সেখানে একটি অর্থনৈতিক করিডোর আছে। সেই কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার পাশাপাশি ভারত এখন লাদাখকে কৌশলগতভাবে যেভাবে দেখছে তা নিয়ে তারা (চীন) উদ্বিগ্ন। অবকাঠামো তৈরি নিয়েও উদ্বেগে আছে তারা।’লাদাখ অঞ্চলে সর্বশেষ বড় সংকট দেখা গিয়েছিল ২০১৭ সালে। বিবাদপূর্ণ দোকলাম এলাকা নিয়ে দীর্ঘ এক মাস ধরে তখন যে সংকট দেখা গিয়েছিল সেটিরও উৎপত্তি অবকাঠামো তৈরিকে কেন্দ্র করে।হার্শ হচভব আরও বলেন, ‘শুরুর দিকে চীনের অংশে অবকাঠামো তৈরি করতে দেখা গিয়েছিল, তবে এখন ভারতও তাদের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামো তৈরি করা বাড়িয়ে দিয়েছে।’

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিকস, অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব বলেন, ‘ভারতের কোনও ধরনের সম্প্রসারণ কিংবা অঞ্চলটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুর্গ স্থাপনের ফলে মধ্য এশিয়ায় চীনের ভূ-কৌশলগত লক্ষ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডোরে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং- এর বেল্ট অ্যান্ড রোড নামক বাণিজ্য ও উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

গত বছর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) খুব কাছে একটি নতুন সড়ক তৈরি করেছে ভারত। এ সড়ক স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত সেনাদের রসদ সরবরাহের কাজ সহজ করা। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-এর রাজনৈতিক সহিংসতা ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইডান মিলিফ বলেন, ‘নতুন এ সড়ক নির্মাণের প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রতি চীন অগ্রসর হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ সড়ক নির্মাণকে তারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার মর্যাদা পরিবর্তন বলে মনে করে।’ তবে মিলিফ মনে করেন, মর্যাদার পরিবর্তন নিয়ে তাদের এতো বেশি মাথাব্যথা নেই যে তারা এর জন্য জীবনবাজি রাখতে যাবে। আর সেকারণে সংঘর্ষের ঘটনায় পরিকল্পিত উসকানি ছিল নাকি ভুল করে হয়েছে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আকসাই চীন এলাকায় দুই দেশের সেনাদের গতিবিধি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলেও ওই এলাকায় যেকোনও সংঘাতে জড়ানোই কঠিন। শীতকালে এলাকাটি অনেক ঠান্ডা হয়ে থাকে এবং ভারী তুষার জমে। এতে এলাকাটি দুর্গম হয়ে পড়ে। এমনকি গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার অবস্থা ভালো হওয়ার পরও এলাকাটির উচ্চতা, আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কারণে সবকিছুই কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণ রসদ সরবরাহ করাই কঠিন, আর পুরোদস্তুর সামরিক সংঘাতের কথা তো অনেক দূরের কথা।

সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ হাজার মিটার উঁচুতে যেকোনও কিছু করতে গেলেই ভুগতে হবে। সেখানে ডিজেল ইঞ্জিন চালাতে বেগ পেতে হয়, হেলিকপ্টারগুলোকে কম ওজন নিয়ে উড়তে হয়। সেখানে গুলি করাও কঠিন। অপেক্ষাকৃত হালকা বাতাসের উপযোগী করে গোলা-বারুদ তৈরি করতে হয়।মিলিফ বলেন, উচ্চতা ফ্যাক্টর না হলেও ভারত-চীন সীমান্ত সামরিক অভিযানের জন্য জটিল থাকবেই। হিমালয় মালভূমি ইউরোপের মধ্যাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের মতো সমতল নয়, ইরাকে ট্যাংক চালানোর মতো মরুভূমিও নয় কিংবা পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ পাকিস্তানের সীমান্তের মতো নয়।উভয় দেশ যখন তাদের আহত সেনাদের জখম সারিয়ে তুলছে এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রটোকল চালু করেছে তখন দিল্লি ও বেইজিংয়ের নেতাদের দিকেই সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হবে। তাদের সিদ্ধান্তেই নির্ভর করছে চলমান বিবাদ কঠিন ও ব্যয়বহুল সংঘাতে গড়াবে কিনা।

You might also like