ছোটলেখা চা বাগানের যুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল
হামিদ মোহাম্মদ
অতিথি প্রতিবেদক, সত্যবাণী
লন্ডন: গত দুসপ্তাহ আগে লন্ডনে বালাগঞ্জ এলাকার একটি কমিউনিটি সংগঠনের সভায় বালাগঞ্জের একজন চেয়ারম্যান তাঁর বক্তব্য প্রদানের এক পর্যায়ে বললেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। সভায় আজিজুল কামাল স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। আজিজুল কামাল এ কথা শুনে শিহরিত হয়ে ওঠেন। আমাকে বললেন,এ কথাটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে বলতে অনেকটা আন্দোলিত হয়ে। আরও বললেন, এরকম মূল্যায়নের কথা এই প্রথম তিনি শুনলেন। তিনি নিজেও ভাবেননি নিজেকে নিয়ে এভাবে। তাঁর চোখে তখন আনন্দের ঢেউ, মুখে বিজয়ের হাসি। তিনি একটু থেমে আমাকে বললেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তারা অনেকেই আলোচনার বাইরে রয়ে গেছেন। আমার চেয়ে আরও সাহসী বীরযোদ্ধার কাহিনি শুনুন। তিনি বলতে লাগলেন ছোটলেখা চাবাগানের যুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ কাহিনি। ছোট লেখা চাবাগানে দু‘
দফা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মাত্র একদিনের ব্যবধানে। তারিখ মনে করতে পারলেন না। একাত্তর সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ঘটেছিল এ অভিযানের বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। তুমুল যুদ্ধের পর চাবাগান দখল করলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আজিজুল কামাল এ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন মাত্র ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে।এ যুদ্ধে দুজন পাক সেনা নিহত এবং বহু পাকসেনা আহত হয়। বাকীরা পালিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায়।যুদ্ধে মেশিনগানসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়েছিল। এর পর একদিন একরাত পরেই পাকসেনারা দ্বিগুণ শক্তি বৃদ্ধি করে পাল্টা আক্রমণ চালায়। তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যুদ্ধের ট্র্যটেজি ছিল ‘হিট এ- রান‘ কিন্তু অক্টোবর থেকে পলেসি ঠিক করা হয় ‘হিট এন্ড এডভান্স‘। সুতরাং চাবাগান দখলের পর মুক্তিবাহিনি দখলকৃত এলাকায় অবস্থান করছিল। এ অর্থে দখল টিকিয়ে রাখতে মুক্তিবাহিনিও শক্তিবৃদ্ধি করে। কমান্ডার সালামের নেতৃত্বে ২২ জনের অপর দলটি তাদের সাথে যোগ দেয়। তবে সালাম তাঁর দলকে নিয়ে মূল দলের বাম পাশে অবস্থান নেন। ভোর ৫টা হবে তখন। পাকবাহিনি আক্রমণ চালায় মর্টারসহ ভারি অস্ত্রের সাহায্যে। তারাও দু দিক থেকে আক্রমণ রচনা করেন।এক পর্যায়ে সকাল প্রায় ৭টার দিকে দেখা গেল পেছন থেকে গুলি আসছে। আজিজুল কামাল ও তার দল মনে করলেন বোধ হয় তাদের অপর দল অর্থাৎ সালামের দল হয়তো ভুলক্রমে তাদের পেছনে এসে পড়েছে। ওয়ারলেসে যোগাযোগ করে জানা গেল-না তারা ওদের পেছনে আসেনি। ওরাও পাল্টা জানালো যে তাদেরও পেছন থেকে গুলি আসছে। এতে আর সন্দেহ রইল না যে, তারা উভয় গ্রুপই পাক সেনা দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। এদিকে পেছনে পাক সেনা চলে আসায় নিজেদের অস্ত্র যোগানও বন্ধ হয়ে পড়ে। দুটি গ্রুপের একই অবস্থা। হাতের মজুদ গোলা-বারুদ শেষ হলেই নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তাদের পড়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা রইল না। এসময় আজিজুল কামালের দলের মজির উদ্দিন উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, তিনি ও তার সহযোগী আমান উদ্দিন ক্রলিং করে পাক সেনার পেছনে গিয়ে তাদের আক্রমণ করবেন। এটা বুদ্ধির কথা শুধু নয়-নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকি।
অনুমতি নিয়ে মজির উদ্দিন ও আমান উদ্দিন তাদের এ সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। মজির উদ্দিনের বর্ণনানুযায়ী আজিজুল কামাল বললেন, ক্রলিং করে তারা দুজন পাক সেনাদের পেছনে বাংকারের চার পাঁচ হাত দূরে পৌঁছে যান। তখন দুজনে চুড়ান্ত অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। মজির উদ্দিন তাদের প্রস্তুতি অনুযায়ী ইশারা দিলেন পাকসেনার মটারের সেল সাপ্লায়ার অপর সহযোগী সেনাকে গুলি করার।আমানউদ্দিন পলকেই পাকসেনার মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করেন। সঙ্গে সঙ্গেই মজির উদ্দিন জাম্প দিয়ে ঝাপটে ধরেন মর্টারের গুলি ছোড়ারত অপর পাক সেনাকে। বিশালদেহী পাক সেনাকে কাবু করতে মজির উদ্দিনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। দস্তাদস্তির ফাঁকেই আমান উদ্দিন এই পাক সেনার মাথায় পিস্তল ধরে সারেন্ডার করার আহবান জানান। পাক সেনা আর উপায়ন্তর না দেখে দুহাত তুলে সারেন্ডার করে। এই পাক সেনার নাম লেফটেন্যান্ট এম এইচ আনসারি। সারেন্ডারের পরে দখলকৃত পাক সেনারই ব্যবহৃত মর্টার দিয়ে পেছনে থাকা মূল পাক বাহিনির দিকেই পাল্টা আক্রমণ চালায় মজির উদ্দিন।মর্টার আক্রমণের ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকবাহিনি ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে থাকে। পাক সেনাদের মূল মর্টার ইউনিট হাতছাড়া হওয়ায় টিকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্রসহ কনভয় ফেলে অবশিষ্ট পাক সেনারা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। মজির উদ্দিন ও আমান উদ্দিন জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে উল্লাস করতে থাকলে আজিজুল কামাল নিজের দল নিয়ে এবং সালাম কমান্ডার তার দলকে নিয়ে অগ্রসর হয়ে পাক সেনাদের ধাওয়া করেন। অতি অল্প সময়ের মধেই ছোটলেখা চাবাগান পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের। পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র তাদেরই ফেলে যাওয়া বড় লরি বোঝাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।পাক সেনা সদস্য আনসারিকে বন্দী করে ক্যাম্পে সোপর্দ করেন অধিনায়ক আজিজুল কামাল। অধিনায়ক আজিজুল কামালের নেতৃত্বে এ বিজয়ে উল্লসিত হয়ে ক্যাম্পের সকল মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে মেতে ওঠেন এবং আনন্দ উচ্ছ্বাসে আপ্লুত অনেকেই মজির উদ্দিন ও আমান উদ্দিনকে তাদের বীরত্বে জড়িয়ে কাঁন্নায় ভেঙে পড়েন। মজির উদ্দিন ও আমান যে সাহসী কাজটি করেছেন তা শুধু বীরত্বপূর্ণ নয়Ñআজিজুল কামালসহ তাদের দলের ১১ জন এবং সালাম কমান্ডারের দলের ২২ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছেন জান বাজি রেখে। আর তা সম্ভব হয়েছে সাহসিকতার দেদীপ্যমান তীব্রতা দিয়ে। দুটি বিষয়ই বীরত্ব ও কৃতিত্বপূর্ণ। আজিজুল কামাল কথা বলতে বলতে আক্ষেপ করে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পর এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা মজির ও আমান কোন খেতাব পাননি বা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হননি। এরকম শত শত মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ একচল্লিশ বছর ধরে অবহেলার শিকার ও হত দরিদ্র্র অবস্থায় পরিবার পরিজনকে নিয়ে কষ্টে স্বাধীন দেশেই দিনযাপন করছে। তাদের সন্তানরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বেঁচে থাকার প্রকৃত অধিকার হারা, অবহেলিত এখন।এই বীরদের চোখে যে স্বপ্ন ও বুকে যে সাহস ছিল তা আর নেই। তাদের সেই অসীম সাহসী নদী যেন শুকিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদেও এখন একটাই প্রধান দাবী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি প্রদান। যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি পেলে মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। বিজয়ের মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল এই কথাগুলো বলতে বলতে নিজেকে দৃঢ় করে বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম দেশকে গড়ে তুলবেই, আমি আশাবাদী এরা মেধাবী ও সাহসী এবং রক্তের ঋণ তারা শোধ করবেই।
১০ ডিসেম্বর ২০১৩.লেখক: কবি ও সাংবাদিক