আজিজ আহমদ সেলিমঃ বিদায় বন্ধু
নূরুজ্জামান মনি
কিভাবে লেখাটা শুরু করবো, তাই ভাবছি। আজিজ আহমদ সেলিম আমার বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের পরিধি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরেরও বেশি। আমি তখন আম্বরখানা বড় বাজারে একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেলিমদের নিজস্ব বাসা ছিল আম্বরখানার উত্তরে কলোনির বিপরীতে। সেই তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালে আমাদের দেখা হতো যুগভেরী অফিসে। দেখা থেকে পরিচয় ঘনিষ্ঠতা-বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব দিনে দিনে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো। বাসায়ও যাতায়াত শুরু হলো। সেলিমদের বাসার নাম ছিল “রীতা কুঠির”। তার আম্মার ডাকনাম ছিল রীতা। ঐ নামেই বাসার নাম। প্রথমেই নামের বানানটা আমার চোখে পড়লো। বানানটা ভুল। হয়তো “কুঠি” হবে, নয়তো “কুটির”। সেলিমকে আমি বানানটি ধরিয়ে দিলাম। এরপর তারা ভুলটা শুধরে লিখলো রীতা কুটির।
যুগভেরীর তখনকার আড্ডায় আমরা যে ক’জন বন্ধুত্বে জড়িয়েছিলাম, তাদের মধ্যে আবুল কাশেম মিলু (মিলু কাশেম), সৈয়দ নাহাস পাশা, হামিদ মোহাম্মদ, আজিজ আহমদ সেলিম, আবু বকর মোহাম্মদ হানিফ অন্যতম। যুগভেরী অফিসেই পরিচিত হই কবি দিলওয়ার, শামসুল করিম কয়েস, মাহমুদ হক, বুদ্ধদেব চৌধুরী, মাহবুবুর রহমান, কাদের নওয়াজ খান প্রমুখের সাথে।
সেলিম ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট-গুরুগম্ভীর স্বভাবের। আমরা যখন লেখালেখি কিংবা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তুমুল হৈ হল্লা-তর্কাতর্কিতে মেতে উঠতাম, সে তখন বসে বসে মুচকি মুচকি হাসতো। গায়ে গতরে তাকে আমাদের চেয়ে বড় দেখালেও স্বভাবে সে ছিল এক কেতাদুরস্থ ভদ্রলোক। কোনো প্রকার তর্কাতর্কি বাদানুবাদে কখনো তাকে জড়াতে দেখিনি। রাজনীতিতেও সে খুব উচ্চকণ্ঠ ছিল না। আজন্মই সে ছিল আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির নিরব পথিক।
আমরা শহরে নিয়মিত কবিতা পাঠের আসরে যোগ দিতাম। শহরের শারদা হল, শহীদ সোলেমান হল, মুসলিম সাহিত্য সংসদের আঙিনা, যুগভেরী অফিস প্রভৃতি স্থানে আসর বসতো। সেই আসরগুলোতে কবি দিলওয়ার, মাহমুদ হক, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, তুষার কর, মহিউদ্দিন শীরু, লাভলী চৌধুরী, অজয় পাল প্রমুখেরা আসতেন। এছাড়া হামিদা খাতুন শেফালী, জোবেদা খাতুন শিউলী, রোকেয়া খাতুন রুবি, লুৎফুন নেছা লিলি, শাহেদা জেবু, হোসনে আরা হেনা, হীরা শামীম, শামসাদ হুসাম, ভীষ্মদেব চৌধুরী, গোবিন্দ পাল, হামিদ মোহাম্মদ, আজিজ আহমদ সেলিম, আবুল কাশেম মিলু, সেলু বাসিত, সৈয়দ নাহাস পাশা প্রমুখ ছড়া কবিতা পড়তেন।
একসময় নাহাস, মিলু, সেলিম ও আমি এই চারজন বন্ধুত্বের গভীরতায় ডুবে গেলাম। সাহিত্যের গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানে ওখানে ছুটোছুটি। সিলেট ছাড়াও ঢাকার নামি দামি পত্রিকায়ও আমাদের লেখা ছাপা হতে লাগলো। ঠিক তখনই সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের দেশ বিলেতে নাহাসের ডাক পড়ে গেল। আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধন ছিঁড়ে সে পাড়ি জমালো। এরপর সেলিম, হামিদ ও আমি তৃরত্নের জোট বাঁধলাম। হামিদ যুগভেরীতে স্টাফ রিপোর্টারের চাকরি নিয়ে আম্বরখানা বড় বাজারে ভাড়া বাসায় চলে এলো। বাসাটি ছিল সেলিমের বাসার ঠিক পেছনে। তখন সিলেট শহরে সকল বাসায় টেলিভিশন ছিল না।
আমরা সন্ধ্যা হলেই টেলিভিশনে ফুটবল দেখতে তাদের বাসার পেছনের চোরা পথ গলিয়ে ঢুকে যেতাম। রাত দশটা এগারোটা নাগাদ খালাম্মার আপ্যায়নের মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসতাম। আশি একাশি সাল পর্যন্ত আমরা হরিহর আত্মা হয়ে কাটিয়েছি। এরপর আমি চলে গেলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। হামিদ বসে গেল ব্যবসা নিয়ে। আর আগের মতো যখন তখন আমাদের যোগাযোগ রক্ষিত হয়নি এদিকে আবু বকর মোহাম্মদ হানিফও পড়তে চলে গেল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেলিম রয়ে গেল তার সাংবাদিকতা নিয়েই।
আমাদের সেই বোহেমিয়ান সময়ের একটি দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমরা তখন উদ্ভ্রান্ত যুবক। রাতে আড্ডা দিতে দিতে “যেখানে রাত সেখানে কাৎ” অবস্থা। সেলিম কিন্তু সেরকম ছিল না। রাত দশটা বাজলেই তাকে আর বেঁধে রাখা যেতো না। সে বাসায় ফিরে যেতো। একদিন রাতে আড্ডা সেরে ফাতেমা টি স্টলে চায়ের পর্ব সেরে যখন বের হই, তখন রাত অনেক হয়ে যায়। এগারোটার কাছাকাছি। হঠাৎ হামিদ ও আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এসে টোকা দিল। ভাবলাম কোথাও চলে যাবো। সিলেট সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডটি তখন ছিল আম্বরখানা পয়েন্টের কাছাকাছি। ওদিকে এগোতেই দেখি শেষ বাসটি ছাড়ছে। বললাম, চলো, বাসে চড়ে বসি। কোথাও চলে যাই। সেলিম রাজি হয় না। শেষে অনেকটা জোর করে বাসে উঠিয়ে সুনামগঞ্জে রওনা হয়ে গেলাম। সে ভীষণ বিরক্ত। সেলিম ছিল আজন্ম অধূমপায়ী। আমাদের মাথায় এলো আজ তাকে সিগারেট টানাবো। হামিদ অনেক চেষ্টা করে তাকে দু’তিনটে টান দিতে বাধ্য করলো। কিন্তু ফলটা ভালো হয়নি। একে তো তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি। বারবার বলছে বাসায় খুব চিন্তা করবে। ওদিকে সিগারেটের ধোঁয়ায় তার বমি বমি ভাব হচ্ছে। মাথা ধরেছে। তবুও সে তার ভদ্র স্বভাবের কারণে বন্ধুদের এই উৎপাত মেনে নেয়।
অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। কোনটা ফেলে কোনটা লিখি। এই নাতি দীর্ঘ লেখা দিয়ে আমি আমার প্রিয় বন্ধু আজিজ আহমদ সেলিমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম।
নূরুজ্জামান মনি: কবি ও সাংবাদিক