অহংকারের ৫০ বছর


নিলুফা ইয়াসমিন হাসান

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সবাইকে শুভেচ্ছা!
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই–ই সর্বাত্মক এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল সমানভাবে। কৃতজ্ঞভরা চিত্তে সবার অবদানকে স্মরণ করি।
পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বাছবিচারহীনভাবে।একদিকে নারীরা ধর্ষণের শিকার, অত্যাচারিত হয়েছেন। অন্যদিকে, রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বিপুল বিক্রমে লড়েছেন নারীরা। সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও নারীসমাজ লড়াই করেছে, দেশের ভেতরেও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে ধাপে ধাপে, যেখানে নারীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বিদ্যমান। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীরা ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে।
একাত্তরের উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘোষণা দিলেন, ‘…আর যদি একটি গুলি চলে… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, সেই সময়েও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র কাজে উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন নারীরা।
পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বহুমাত্রিকভাবে নারীরা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও।
কলকাতায় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩০০ তরুণীকে গোবরা ও ‘বিএলএফ’ ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এঁদের মধ্যে গীতা মজুমদার, গীতা কর, শিরিন বানু মিতিল, ডা. লাইলী পারভীন অস্ত্রচালনা শেখার পরও প্রথমে তাঁদের সম্মুখসমরে যেতে দেওয়া হয়নি।
তারপরও আলমতাজ বেগম ছবি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম।
এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথাও বলা দরকার। শহীদ রুমীর মা জাহানা ইমাম বা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মা–ই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। তাঁদের এই ত্যাগও ইতিহাসের অংশ। মূলত, এভাবেই নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অদম্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যাঁরা, তাঁরা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাঁদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা—রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ।
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন—১৯৭২ সালে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম; এরপর তারামন বিবি ১৯৭৩ সালে ও ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন এবং দুজনই অনেককাল ছিলেন বিস্মৃতির অন্ধকারে।

‘শহীদ বুদ্ধিজীবী লুতফুন্নাহার হেলেন’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে মাগুরা গার্লস স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন।
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহন করেন। মুক্তি বাহিনীর সাথে মাগুরার মোহাম্মদপুর থানার একটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করে সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রুপান্তর করেন।এলাকার লোকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উৎসাহিত করেন।মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এই বুদ্ধিজীবী গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেন।
৭১এর আগস্টে তাঁকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁকে চলন্ত জীপের পিছনে বেঁধে সমগ্র শহরে টেনে হিচড়ে নিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে শহরের পাশে নবগংগা নদীতে ফেলে দেয়। আজ সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সাথে তাঁর প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

নিলুফা ইয়াসমিন হাসান: সাংবাদিক, সত্যবাণীর বার্তা সম্পাদক

 

You might also like