আমার শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান
কাদের মাহমুদ
১৯৬৫ সাল। উত্তাল ৬ষ্ঠ দশকের মধ্যলগ্ন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ তখন উত্তুঙ্গে উঠছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পাঠের জন্যে ভর্তি হয়েছি। ততদিনে আমি ঢাকার পত্রিকা মহলে এক ক্ষুদে দুঁদে সাংবাদিক হয়ে উঠছিলাম। পেশায় জায়মান হলেও কিন্তু ডিগ্রি অর্জনে কয়েক বছর পেছপা ছিলাম। আমার সহপাঠীরা কেউ কেউ আমাকে ডাকে চাচা বলে। আবার, সার্বক্ষণিক ছাত্র ও সার্বক্ষণিক সাংবাদিক ছিলাম বলেই যেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক মহলে আমার একটা ঠাঁই হয়ে গিয়েছিলো। আমার সহকর্মী ফটোগ্রাফার জহিরুল হকও ছিলো আমার সহপাঠী।
তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছিলো বাঘা বাঘা শিক্ষকে ঠাসা। বাংলা ভাষা ও বাংলার স্বাধীকার বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক মুক্ত চিন্তার প্রবক্তা হিসেবে তাঁরা অনেকে ছিলেন সাহসিক ও আপোসহীন। ধ¦নি বিজ্ঞানী আবদুল হাই ছিলেন বিভাগের প্রধান ছিলেন, পরে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। তাঁর সাথে ছিলেন স্বনামে খ্যাত মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান, নীলিমা ইব্রাহিম, রফিকুল ইসলাম; আর ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, দীন মোহাম্মদ, আনোয়ার পাশা, ওয়াকিল আহমদ, বরীন্দ্র বিজয় বড়ুয়া ও শামসুল আলম চৌধুরী।
বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে তখন তুলনামূলকভাবে কম বয়েসী হলেও, ডক্টর আনিসুজ্জামান নামটি প্রাগ্রসর বাঙালিদের মধ্যে ভালোই চেনা ছিলো। বটে ছাত্র হিসেবে আমি তাঁর নিকটতরো হতেই বুঝতে পারলাম তাঁর মধ্যে অহমিকার লেশমাত্র নেই: আর তাঁর ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকানো ¯সিগ্ধ অটলতা। সবাইকে নিমেষে আপন করে নিতেন তিনি, তাঁর কাছে সামাজিক ভেদ ছিলো না। বিভাগের করিডোর দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সমান লয়ে চলাফেরা করতেন। শাদা লম্বা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে, চটি পায়ে হেঁটে কখন যে তিনি পাঠকক্ষে জনা ষাটেক শিক্ষার্থীর সামনে হাজির হতেন তা আমরা টেরই পেতাম না। তাঁর পাঠভাষণ ছিলো অনুচ্চ ও মিষ্টিমধূর, অথচ কক্ষের সীমান্তে সবার কাছে পৌঁছুতে পারতো। আদপেই তিনি নৈর্ব্যক্তিক ছিলেন না, বরং সকলের প্রতি ছিলো তাঁর নজর। তাঁর প্রতিও থাকতো সকলের নজর। বিমুগ্ধ হয়ে শুনতে হতো তাঁর বিদগ্ধ পাঠ। বড়ই প্রাসঙ্গিক হতো তাঁর পাঠ। আমার মতো যাদের পড়াশুনায় বিপত্তি ছিলো, তাদের পক্ষে মনোযোগ দিয়ে স্যারের ভাষণ শুনলেই যেন চলতো।
একদিন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের কাছে বন্ধু কবি রফিক আজাদের সাথে দেখা। বিস্ময়ে বললেন, আজ না আপনার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা! প্রস্তুতি নেই, বলে আমি মাথা চুলকাই। তিনি তাঁর সাথীদের নিয়ে প্রায় চ্যাঙদোলা ক’রে আমাকে পরীক্ষাকক্ষে তুলে দিলেন। সেই পরীক্ষার ফল বের হলে আমি তো হা। এতো ভালো করলাম কী করে! হাজির হলাম আনিস স্যারের কক্ষে। তিনি মলিন বদনে বললেন, তোমার খাতায় বিষষবন্তু কিচ্ছু ছিলো না। তবে, স্যার! স্যার বললেন, বাঁচিয়েছে তোমার রচনার বাংলা ভাষাটা। ও জন্যেই নম্বর ভালো পেয়েছো। শুনে আমি তো আরো আম্মো!
অনার্স পরীক্ষার মাত্র সতেরো দিন আগে প্রস্তুতির জন্যে দৈনিক আজাদ থেকে ছুটি পাই। এটা কিছুতেই আমার জন্যে যথেষ্ট সময় ছিলো না। কবি হুমায়ুন কবির, শাজহান ফারুক সহ তিনজন সহপাঠীকে নিয়ে হাজির হই আনিস স্যারের বাসার দুয়ারে। তখনকার ইকবাল হলের পশ্চিমে। বৈঠকঘরে আমরা বসবার পরে, এক প্যাকেট সিগারেট টেবিলের উপর রেখে, স্যার নৈব্যাক্তিকভাবে বললেন, খাও! আমার সহপাঠীদের এ অভ্যেস নেই। ওরা সমস্বরে তারকন্ঠে বলে উঠলো, না, না স্যার! স্যার বললেন, কাদের তো খাও। আমি বললাম, আমি শিক্ষকের ছেলে তো! আপনার সামনে সিগারেট টানতে পারবো না, স্যার। স্যার মৃদু হাসলেন।
রেকাবীতে চা বিস্কিট এলো।
পরীক্ষার জন্যে আমার প্রস্তুতির বিবরণ শুনে স্যার মলিন হলেন। তবে বললেন, ফলাফল ভালো যদি করতে চাও তো এ বছর বাদ দাও। ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আগামী বছর পরীক্ষা দিও।
স্যারের এই পরামর্শ আমি রাখতে পারি নি। সহপাঠীদের উৎসাহ, বুদ্ধি ও সক্রিয় সহযোগিতায়, বলা যায়, বিপাকে পড়ে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ৮টি বিষয়ে পরীক্ষায় বসেছিলাম। ফলাফল আহামরি কিছুই হয় নি -ফার্ষ্ট ক্লাস অবশ্যি পাই নি, যা হয়েছিলো তাতেই আমি পুলকিত হয়েছিলাম। আমার সহায়ক সহপাঠীরা তো আরো বেশি, ধৈধৈ!
তারপর এমএ‘র পাঠটা যেন খুব ক্ষীপ্র শেষ হয়ে গিয়েছিলো, সেই সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমার জীবনের সেরা কালের ইতি ঘটিছিলো। এরপর অবিরল ঘটনাপ্রবাহ। বিয়ে করলাম। মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করলো। আমি পত্রিকা ছেড়ে রেডিওতে বেতার সাংবাদিকতা শুরু করলাম। ১৯৭০ সালের সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে লাখো বাঙালির প্রাণহানী হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরল নেতৃত্বে পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের নতুন অধ্যায় রচনা হয়। আসে ১৯৭১। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা। ক্ষীপ্র ঘনিয়ে আসে ২৫শে মার্চের তমিস্র ভয়াল রাত। তারপর ইতিহাস যেন নিজ হাতে তুলে নেয় আপন হাল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস রক্তাক্ত হয়ে কাটে। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও র্ভাত। ১৬ই ডিসেম্বর আত্মবিসর্জন করে পরাভূত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য। বিজয়ী বাঙালি জাতি পায় তার প্রাণের স্বাধীনতা তিরিশ লাখ প্রাণ ও কয়েক লাখ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে। এর ২৫ দিন পরে, বাংলার মাটিতে ফিরে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখানে না বলে কখনোই পারা যায় না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষকদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশাকে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে স্বাধীনতার শত্রুরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো।
বিবিসির বহিঃপ্রচার রেডিওর বাংলা বিভাগে একটি চাকরি পেয়ে ১৯৭৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর আমি লন্ডনে আসি। এ বিভাগে আমি আড়াই বছরের মতো ছিলাম। এ সময়েই অভাবিতভাবে আনিস স্যারের সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। তিনি এখানে উচ্চতর পাঠের জন্যে এসেছিলেন। এবং সময় পেলে বিবিসির বাংলা বিভাগে এসে কিছু অনুবাদের কাজ করে দিতেন। আমি দেখতাম, আমার কোনো কোনো সহকর্মী তাঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে ন্যূনতম পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতেন। দেখে আমার কষ্ট হতো। তবে আমার যখন সুযোগ এসেছিলো তখন আমি আমার শিক্ষকের পূর্ণ মর্যাদাই রক্ষা করেছিলাম।
মনে পড়ে, আরো দু একবার লন্ডনে আনিস স্যারের সাথে দেখা হয়েছিলো। বৃটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিসের লাইব্রেরিয়ান প্রতিভা বিশ্বাস এক সময় আমার পাড়ায় থাকতেন। একবার তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের প্রথম দিককার কিছু দলিলের ফটোকপি সাথে করে আমার বাসায় হাজির হয়েছিলেন। এগুলোর ভাষা বাংলা তো বটেই তবে আরবি ফার্সি শব্দে ভরপুর ছিলো; সে সব ছিলো কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াস কলেজে বাংলা বিভাগ চালু হবার আগেকার। বিস্ময়কর! ফটোকপিগুলো আমি ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আনিস স্যারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আগে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পাঠ ও গবেষণা করবার সময়েই অমায়িক প-িত আনিসুজ্জামান ও সাথে প্রতিভাদি’র দেখা হতো। সে সব দিনের কথা প্রতিভাদি আমার স্ত্রী ঝর্ণা ও আমাকে সানন্দে বলতেন।
২০০৮ সাল থেকে আমি বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশে যাচ্ছিলাম। তখন সবার আগে আনিস স্যারের সাথে দেখা করতাম। ফোন করতাম। কখনো গিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো সেই বাংলা বিভাগে, তাঁর কক্ষে। একবার তাঁর বাসাতেও গিয়েছি বলে মনে পড়ছে। এক কি দু‘বার গিয়েছি মাসিক কালি ও কলম পত্রিকায় তাঁর দফতরে। তখন তিনি এই নন্দিত সাহিত্য পত্রিকাটির সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি। আমার লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এমন কি চিঠিও তাঁর পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছেন।
বাংলা একাডেমির তিনি সভাপতি ছিলেন। বাংলা একাডেমি ২০১১ সালে সর্বপ্রথম আমাকে প্রবাসী লেখক পুরস্কার দেয় (পরে এর নাম করা হয় ওয়ালিউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার)। পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, আমি ধনী দেশে থাকি বলে, পুরস্কারের অর্থমূল্যের সামান্যতা নিয়ে তিনি স্বস্নেহে রসিকতা করেছিলেন। আবার একাডেমির তখনকার মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও আনিস স্যারের এক সাবেক ছাত্র। এক আসরে শামসুজ্জামান খানকে পাশে নিয়ে স্যার বললেন, কাদের কিন্তু আমার ছাত্র ছিলো। ওর দিকে নজর রাখছো তো! মহাপরিচালক বিগলিত হয়ে বললেন, অবশ্যি স্যার।
২০১৯ সালে বাংলা একাডেমি আমার অনূদিত বঙ্গের লোকসাহিত্য বইটি প্রকাশ করে। এটি এর ৯৯ বছর আগে, ১৯২০ সালে, প্রকাশিত বাংলার মণীষী দীনেশচন্দ্র সেনের The Folk Literature of Bengal বইয়ের বাংলা রূপান্তর। অমূল্য এই বইটির বাংলা-অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা, অনুবাদের পা-লিপি সম্পাদনা কাকে দিয়ে করানো যায় এসব নিয়ে নানা প্রশ্নে তিনি আমাকে (প্রধানত টেলিফোনে) বাংলাদেশ থেকে পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এর মুখবন্ধটিও লিখে দেন। এতে তিনি লিখেছেন, “মূল বইটির বঙ্গানুবাদ করে কাদের মাহমুদ একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। এজন্যে আমাদের ধন্যবাদ তাঁর প্রাপ্য। এই অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে শতাধিক বৎসর পূর্বের একটি পান্ডিত্যপূর্ন ও চিত্তাকর্ষক রচনার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাব।” স্যারের এ মন্তব্য আমার কাছে অমূল্য। তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অবধি নেই।
আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান ৮৩ বছর বয়েসে, আমি বলবো, অকালে চলে গেলেন। আমি গুণী ও কীর্তিমানদের মৃত্যুতে শোক করতে চাই না। চাই তাঁদের কীর্তির জয়গান করতে। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে।
আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান না ছিলেন কবি, না গল্পকার, না ঔপন্যাাসিক, না নাট্যকার জনপ্রিয়তার এসব পথ ধরে হাঁটেন নি তিনি। যৌবনে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে অংশ নেন। এরই সুতো ধরে তিনি মুক্তবুদ্ধি, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি মানবতার পথে হেঁটেছিলেন। সাহিত্যের উপর কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থ আর তিন খন্ডের আত্মজীবনী রেখে গেছেন বটে তাঁর পান্ডিত্যের সবচেয়ে বড় একটি অবদান ছিলো, সম্পাদনা তথা অন্যদের সঠিক পথ দেখানো। মঞ্চেও তাঁর বিদগ্ধ কণ্ঠস্বর শিক্ষকতার গন্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তিনি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় অধ্যাপকই ছিলেন না, বাঙালি জাতির অনন্য এক শিক্ষক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য। জাতির প্রথম বাংলা সংবিধান রচনায় ছিলো তাঁর হাত। ঘাতক দালাল নির্মূল প্রয়াস, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সম্পৃক্ত। একেবারে শেষ দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালনের আয়োজনের অগ্রভাগে ছিলেন।
জাতি আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামানের কাছে পেতো সামনে চলার দিশা।
১৮ই মে, ২০২০
নর্থ চিম। সাটন। সারে। ইংল্যান্ড
কাদের মাহমুদ: লেখক, সাহিত্যিকে