পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে। –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥চৌদ্দ॥
আমি আর রায়হান কলেজ ক্যাম্পাসের বাগানে, গাছের জড়ে পানি দিই। আসলে দেখার করার ওছিলা। অফ প্রিয়ডে অন্যরাও পানি দেয়। টিফিনের সময়টা বাড়িয়ে দিয়ে সব ক্লাশের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজটি এক ধরণের বন্টন করে দেয়া হয়। শিক্ষকরাও কোমর বেঁধেলাগেন পরিচর্যায়। বাগানের জন্য বিভিন্ন নার্সারী থেকে ফুলের চারা সংগ্রহ আর বনবিভাগ থেকে নানাজাতের ফলমূলসহ কৃষ্ণচূড়া, ঝাউগাছ, শালগাছের চারা নিয়ে আসি। যেখানেই গিয়েছি বিনে পয়সায় এসব দিয়েছেন সকলেই। লম্বা নল দিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়া ছাড়া বালতি দিয়েও পানি দিই। বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক বাগান করায় ওস্তাদ, তিনি ডিজাইন করে দিলেন কিভাবে রোপন করলে দর্শনীয় হয়ে ওঠে। কয়েক মাসে বেশ কিছু গাছে ফুলধরা শুরু হয়েছে। এখন ভাদ্র মাস। এসময়টি গাছগাছালির জন্য উত্তম। অল্পদিনে যে কলেজটি মানুষের দর্শনীয় হয়ে ওঠবে তা আমরা ভাবিনি। শহরের প্রায় মধ্যস্থলে দেয়াল ঘেরা কলেজটি এখন একটি জাদুস্থান। কলেজ ছুটির পর অনেক মানুষ, তরুণতরুণী বেড়াতে আসে। আনন্দে,গল্পে আড্ডায় সময় কাটায়।
শরৎকাল। দুর্গা পূজা সামনে। রায়হান বললো, সে দুর্গাপূজা ও স্বরসতি পূজায় বাড়ি যায়। তাদের বাড়ির পাশেই পূজামণ্ডপ। সাতদিন ব্যাপী পূজায় নানা আরতি, কীর্তন গানবাজনার ধুম লেগে থাকে। প্রসাদ খাওয়ার শেষ নেই।
আমি বললাম, তুমি পূজায় গেলে আমি কি করবো, আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো। কলেজেও তো পূজা হবে।
সে বললো, শুধু প্রসাদ খাওয়া আর কীর্তন শোনা আসল বিষয় নয়, মণ্ডপ পাহারাও দেয় তার বন্ধুরা মিলে। কয়েক বছর যাবৎ হল, আমাদের চৌমোহনীতে ভূমি খেকোদের দৌরাত্ম বেড়েছে। তারা দরিদ্র সনাতন ধর্মালম্বীদের বাড়িঘর দখলের ধান্ধায় থাকে। গভীর রাতে মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর করতে একটি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে। তারা দিনে সনাতন ধর্মালম্বীদের মেয়েদের সাথে প্রেম করে, রাতে বাড়ি লুটপাটে যায়। দিনে চা স্টলে চা খায় সনাতন বন্ধুদের নিয়ে। রাতে প্রতিমা ভাঙে।
–বলো কি?
–হ্যা।
আমি রায়হানের মুখ ঝাপসা হয়ে উঠতে দেখতে পাই। সে একটু থেমে বললো, দেখোনা, নাসিরনগর, ব্রাম্মণবাড়িয়া, রামু, উত্তরবঙ্গের রংপুর দিনাজপুর গত ক’বছর ধরে সনাতনদের কী দশা যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের শাল্লায় কত বাড়িঘর লুট হল। আগুন দেয়া হল। জেলে গেল প্রতিবাদকারি ঝুমন দাস। কিন্তু যারা লুট করলো তারা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইন কাদের পক্ষে, লুটপাটকারির, না নিযার্তিতদের!
একদিন বাংলার টিচার অমূল্যধর আমাদের ডেকে বললেন, এখন প্রেম করার সময় নয়,পড়ার সময়। ডিগ্রি পড়া শেষে প্রেম করো, সংসার পাতো।
আমাদের প্রেম প্রেম সময়কে তিনি এভাবেই আমাদের কাছে ধরিয়ে দিলেন হেসে হেসে। মাথা নত করে সরে পড়ি। কিন্তু জানেনা হাতিরঝিল রাতে ফুটে ওঠে আমাদের হাত ধরাধরিতে, আলিঙ্গনে। চুম্বনে কেঁপে ওঠে বাতাস। রায়হান যখন নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ গান ধরে যখন আমি ‘নাই হয়ে যাই’। এটা কে বুঝবে! আমি বুঝি আর রায়হান বুঝে। হাতিরঝিলের এক ইঞ্চি ভূমিও বাকী নেই আমাদের পা পড়েনি। আর অমূল্য স্যার বলছেন, ‘প্রেম করার সময় আছে সামনে। আগে ডিগ্রি শেষ করো।’
আমরা কি এসব বুঝি। (চলবে)