পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে –সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥ষোল॥
চিন্ময় ললিতকলা একাডেমীর নতুন শিক্ষার্থী আমি। কলেজের ক্লাশ, নাচের ক্লাশ চলে দৌঁড়ের উপর। কলেজের ক্লাশ সেরেই নাচের ক্লাশে টাস করে চলে আসা। দূরত্বটাও বেশি নয়। কখনো হেঁটে, কখনো রিকশা জুটলে উড়ে আসা।
এই ছুটে যাওয়ার মাঝে একদিন গেলাম নাইমুর রাজার সাথে তার মডেলিং ফার্মে। নাম ‘কবিতার স্বর্গ’। এই অদ্ভুত নাম আমাকে এমন আকর্ষণ করলো, প্রথমেই অভিভূত হয়ে পড়ি। বড় কোন সাইন বোর্ড নেই, শুধু দরজার উপরে যেন স্বর্ণখচিত নামটি পিতল দিয়ে গড়া। চকচক করছে, চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠা মায়াময় সাইনবোর্ডটি আমাকে দেখে হেসে ওঠে। আসলে হেসে ওঠেনি, আমি টের পেলাম এরকম একটি ঝিলিক আমার চোখ থেকে বুকে নেমে এলো।
নাইমুরকে যদি পেতাম না, বা পরিচয় হতো না, তবে এমন স্বপ্নময় জগতের সন্ধান পেতাম না। অল্প সময়েই মনে হল নাইমুর আমার জীবনের সিঁড়ি। সিঁড়ি মানে অবলম্বন। মুহূর্তে মনে হল আমার চারদিকে আমাদের কলেজের সদ্য-করা বাগানের নানা রঙের সমুদয় ফুল ডানা মেলে প্রজাপতির মত ভিড় করেছে। ফুলও কি প্রজাপতি হয়! কী ভয়ানক এক আবেশে আমি ডুবে রইলাম অনেকক্ষণ। কৃষ্ণের বাঁশি বেজে ওঠার সুর শুনতে পেলাম। আমি রাধা হয়ে গেলাম। জীবনটা বদলে দেয়ার প্রতীজ্ঞায় ভেসে যেতে যেতে যে তীরে দাঁড়ালাম, সেটি মডেলিংয়ে যোগ দেয়া।
কিন্তু রায়হান! রায়হান কী মনে করবে, এমন ভাবনায় স্থির না-হয়ে আবার ছুটে চলা। রায়হানের কথা মনে হতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। রায়হান যে গেল লক্ষীপুর–গ্রামের বাড়িতে, আর খবর নেই। দুর্গাপুজো শেষ। খবর যেদিন এলো, সেদিন জানা গেল, সে জেলে। পাড়ার দুর্গাপুজোর মণ্ডপে দুর্গার মূর্তির কাছে কুরআন শরীফ রেখে দিয়েছে কে বা কারা।
ঘটনাটি ঘটেছে রাত্রে। সকাল থেকেই মিছিল আর মিছিল। কাঠমোল্লাদের ভিড়। কুরআন শরীফ অবমাননা।প্রতিবাদের ঝড়। ইটপাটকেলের স্তুপে আর ভাঙচুরের বিশালতায় দুর্গামূতি মাটিচাপা। কাঠমোল্লাদের কেউ ক্ষেপিয়ে দিয়েছে। পুজোমণ্ডপের স্থানটি একটি মন্দিরের নিকটে। পুজোমণ্ডপে আক্রমণ ও ভাঙচুরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রায়হান আহত, পরে পুলিশ হেফাজতে। এখন কারাগার প্রকোষ্টে দিন গুনছে। জায়গাটি মন্দিরের। এটি দখল নিতে হয়তো কোন মহলের কারসাজি। কারসাজি অতীতেও হয়েছে। রায়হানের মুখেই এই ধরণের কাহিনি শুনেছি। আবার নতুন করে হাঙ্গামা।
রায়হান যদি শুনতো আমি মডেলিংয়ে যোগ দিয়েছি, হয়তো খুশি হতো অথবা ভাল লাগতো-না তার। নতুন উত্তাপে আমার দৌঁড়ঝাঁপ সে হয়তো মেনে নিতো। মেনে না-নিলেও আমি কী থামতাম? হয়তো থামতাম না। অথবা রায়হানই অনুপ্রেরণা দিতো।
মডেলিং থেকে অল্প দিনেই টাকা আসতে লাগল হাতে। এতো বেশি টাকা তো আর হাতে নেয়ার মতো নয়, একাউন্টে জমা হওয়া শুরু।
নানা সোলেমান গাজিকে আমার সোনার হরিণ লাভের গল্প একদিন বললাম। এতো দিন গোপন রেখেছিলাম। নানাকে বললাম, এই টিনের ঘরে থাকা যাবে না। একটি ফ্লাট নিতে হবে। থাকার জায়গাটা একটু ঝাকঝমকে তো হতেই হবে। এছাড়া এখন ব্যবসাটির কারণেও একটি মানসম্মত বাসস্থান জরুরি। নানা তো প্রথমে বিচলিত। তন্ন তন্ন করে জেনে নিয়ে সায় দিলেন বটে। কিন্তু বেঁকে বসলেন নানি। তিনি অসুস্থ। সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত নড়বেন না।
বাচ্চাদের মত নানির কোলে উঠে একটা ঝাঁকি দিলাম। ঝাঁকিতে নানি তো মরি মরি অবস্থা। আমার বগলের নীচে হাত ঢুকিয়ে কাতুকুতু দিয়ে বললেন, রে পাগলি ছাড় আমারে।
আমি কমলালেবুর কোষের মত হেসে বললাম, আগে বল–রাজি।
রাজি হলেন, তবে শর্ত দিলেন, বিষয়টা তো আমার পাগলামি মনে হচ্ছে। ভরসা পাচ্ছি না। তোর জীবনের ওপর দিয়ে এতো এতো ঝড় গেল, পাঁজিটা–কী থেকে কি হয় জানি। আমাকে মরতে দে।
আমি বললাম, মরা কি শর্ত?
বললেন, অয়।
–ধুর, নানি তুমি তো আস্ত পাগলি। তোমাকে মরতে দিব না। ডাক্তার দেখাবো। কত বড় ডাক্তার দেখাতে চাও, আমি টাকা যত লাগে দেব। তুমি ভেবেছো আমি টাট্টা করছি। টাট্টাও না, ন্যাকামিও না। ধ্রুব সত্য। তোমার এই মর মর অবস্থা আর থাকবে না। দেখে নিও।
আমি এখন ধনী। এমন ধনী, টাকা এতো বেশি পাই, ঘরের কোথাও তোমার এতে জায়গা নেই। তাই, ব্যাঙ্কে রাখি। ব্যাঙ্ক! ব্যাঙ্ক!! টাকায় ব্যাঙ্ক ভরা আমার। কোন ব্যাঙ্কে টাকা রাখবো, ব্যাঙ্কওয়ালাদের মাঝে এখন প্রতিযোগিতা। আমি সেলিব্রেটি! সেলিব্রেটি!!
অল্পদিনেই বেশ ক’টি বিজ্ঞাপন চিত্র পোঁজ দেয়া। তারপর, বিজ্ঞাপন চিত্রে অভিনয়। কোনটাই ফ্লপ করেনি। একটি শাড়ির বিজ্ঞাপন চিত্র ২ মিনিটের। সেটি যে কী পরিমাণ জনপ্রিয় হল, অনেকে টেলিভিশন খুলতোই খবরের আগে বিজ্ঞাপনটি দেখার জন্য। আমি যেন উড়তে শুরু করলাম। আমি আর মানুষ নয়, পাখি, বাজপঙ্খি! (চলবে)