পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।–সম্পাদক,সত্যবাণী।
॥সতের॥
বাসা নিলাম ঢাকার অভিজাত পল্লী গুলশানে। একটি চার বেডরুমের আলীশান ফ্লাট। ছয়তলা ভবনের তিন তলায়। পূবমুখী বাসা। নীচে শতেক জাতের গাছ। একটি চৌবাচ্চাও আছে। সকালবেলা চৌবাচ্চায় ফোয়ারায় পানি ওড়ে। মাঝে মাঝে আমি সেখানে ফোয়ারায় হাত পেতে রই। কী ভীষণ ভাল্লাগা দৃশ্য। ফুলের টবে সাজালাম বারান্দার কার্নিশ। কিনে আনলাম ফুলের গাছ, চারা এমনকি রঙ বেরঙের পাতাবাহারের টব। বাতাস এলেই দোল খায়। আমিও সেই দোল খাওয়া পাতার সাথে নাচি, দোল খাই।
মডেলিং চলতে থাকা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে-পড়া সময়ে নাইমুর রাজা খবর দিল সিনেমার অফার এসেছে। স্কিপ্ট নিয়ে এসেছিল বড় এক ডাইরেক্টর। আমি সম্মত হলে বড় অংকের মানি দেবে। আমার সাথে বসতে চান এই ডাইরেক্টর। খবরটা শুনে আমার তো দম বন্ধ অবস্থা।সায় দিলাম। দিন তারিখ ঠিক হল স্কিপ্ট নিয়ে বসার।
যতই আমার সাবলীল অবস্থা এখন, কিন্তু সিনেমার কথা শুনতে ঘেমে ওঠি। কীভাবে কথা বলবো, কী কথা বলবো, সে নিয়ে আমি আতঙ্কিত। নাইমুরকে বললাম, ভাই কী কথা, কিভাবে বলবো, একটু বলে দিন না। আমার কাতর কথায় হেসে দিল নাইমুর। বললো, ধুর, এই তো আমার সাথে যেভাবে কথা বলছো, সেরকমই। এটা কি আবার ‘হান্দেসকাটা’। ‘হান্দেসকাটা’ কথাটি শুনে আমি হেসে দিলাম। বললাম, তুমি আবার সিলেটি কবে শিখলে?
সে বললো, তুমিই তো শিখিয়েছো।
না, আসলেই ‘হান্দেসকাটা’ নয়। কথামত লোকটি এলো। সঙ্গে নাইমুর রাজা। তার-ই বন্ধু। স্কিপ্টটা কিছু কিছু বুঝিয়ে দিলেন। আমি মনে করেছিলাম, স্কিপ্টটা, মানে কোন একটা বই হবে। না, বই নয়। নাটকের মত। কোথায় কি করতে হবে, কোন দৃশ্যটা কেমন হবে, এসব বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
সহজই মনে হল। স্কিপ্ট রাখলাম। কেমন লাগলো, কাহিনি ফুটিয়ে তুলতে পারাবো কিনা, সেটা জানাবো, বললাম। ডাইরেক্টর মানুষ, বলতে গেলে ইয়াং। তবে লোকটি জ্ঞান রাখে। দেশবিদেশের সিনেমা সমন্ধে বিষদ আলোচনায় মনে হল, বোঝার ক্ষমতা কম নয়। কথাবার্তা সহজ, জটিল কোন বিষয়ই লোকটার মাঝে আছে, এমন মনে হলো না।
বছর গড়াবার আগেই দশটা সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হলাম। এর মধ্যে প্রথম সাইনকরা সিনেমা ‘মনের মাঝে তুমি’ মুক্তি পেল। আউটডোর-ইনডোরে শুটিং করেছি। কোন কোন সময় ঘেমে যেতাম বিয়য়টি রপ্ত করতে করতে।
এ যেন জাদু নামক এক ‘ঘোর’ আমাকে পেয়ে বসে। জাদু শব্দটির কথা মনে হলেই মনে হয় মা‘র কথা। তিনি বাবাকে কেউ জাদু করেছে, এমন ‘জাদু’র অভিযোগ তুলে কত তাবিজ-টাবিজ কোথায় থেকে, কিভাবে কী যোগাড় করতেন–এখন মনে হলেই হাসি ছোটে। জাদু তো অন্য কিছু নয়, জাদু তো নিজে বেয়ে বেয়ে উপরে ওঠা। মনোবল দিয়ে, মনের শক্তি দিয়ে, সাহস দিয়ে উপরে ওঠার নাম জাদু। পৌরাণিক মিথলজিক্যাল জাদু আর জীবন গড়ার জাদু ভিন্ন। সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্তই জাদু। বসে না-থাকা, এগিয়ে যাওয়ার নাম জাদু।
আমি এক সময় বসে না-থেকে সেলাই শিখেছি, পার্লারে বিউটিশিয়ান হওয়ার কাজ শিখেছি, তারপর ললিতকলায় নাচ শিখেছি–এখন মডেলিং, সিনেমায় অভিনয়। সবটাই, মানে সব শেখাই আমার কাজে লেগেছে। আমি যদি হঠাৎ করে সিনেমায় অভিনয় করতে চাইতাম, তবে কি পারতাম? বুননটা এমনই প্রয়োজন, জীবনটাকে বদলে দিতে সাহস লাগে। অদম্য স্পৃহা লাগে শেখার। আমি স্থবির হয়ে পড়ে থাকিনি। ধন্যবাদ জানাই আমার ভাই বাবলু রহমানকে। যে কিনা আমাকে বাইরে ঠেলে দিয়েছে ঘাড় ধরে। এক ঠেলায় আজ এখানে। যাকে বলে ‘ঠেলার নাম বাবাজি’। আর ধন্যবাদ জানাই ঐ গর্দভটাকে প্রথম স্বামী না না স্বামী নয়, জোঁকটাকে। সে আমাকে আমের বাকলের মত ছুঁড়ে না মারলে আমি কী পরিবানু হতাম?
এখন আমাকে কী ভয়ানক আদর করে, ভালবেসে ‘পরী’ নামে ডাকে সবাই। আমি কী সেই কাগজের ‘মচা রেণু’?- (চলবে)