মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ: সুকুমার রায়কে আকাশের ঠিকানায় খোলা চিঠি
আব্দুল মোনায়েম নেহরু
সুকুমার দেবরায়, আমার প্রিয় সুকুমারদা তুমি বাস্তবে নেই ভাবতেই পারি না, অথচ এটিই সত্য। তোমার সাথে আমার কত স্মৃতি মনে ভেসে বেড়ায়, তাতে খুব কষ্ট পাই। ৬৮- ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় সিলেটে ছাত্র মিছিলের পুরোভাগে অন্যদের সাথে তুমিও। ১৪৪ ধারা মানি না মানব না, লাঠি গুলি টিয়ার গ্যাস ভয় করি না ভয় করি না, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, মনি সিং এর মুক্তি চাই, রাজ বন্দিদের মুক্তি চাই, ছাত্র সমাজের ১১ দফা মেনে নাও মানতে হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক, স্বৈরাচার নিপাত যাক ইত্যাদি স্লোগানে মূখর থাকতে তুমি। ‘৬৮ তে ছাত্র ইউনিয়ন এর তদানীন্তন সিলেট জেলা কমিটির সহ- সাধারণ সম্পাদক ছিলে তুমি। ‘৬৯ এ তোমাকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করতে হলো। সেই সময় সিলেট শহরে ছাত্র ইউনিয়ন এর অফিস না থাকায় বিশেষ করে বিকালে রেজওয়ান ভাই, তবারক ভাই, প্রদীপদা, মীরবখত আনসারি ভাই, খালিক (মায়ন) ভাই সহ আমরা অনেকেই বন্দর বাজারের ওরিয়েন্টাল হোটেলের ভিতরের কক্ষে বসতাম, বৈঠক করতাম। ১ কাপ চা পান করে ক’য়েক ঘন্টা কক্ষটা আমাদের দখলে রাখতাম। অবশ্য হোটেলের মালিক মণিপুরী দাদা (নামটা মনে পড়ছে না) আমাদেরকে স্নেহ করতেন বলেই এ সুযোগটা আমরা পেতাম, এ সব কথা মনে পড়ছে আজ। সেই সময় তোমার বাসস্হান ছিল এম সি কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাসে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এর তদানীন্তন সিলেট জেলা কমিটিতে পরপর তিন বার তুমি আর আমি। মধ্যে রাতে ঘুমের সময় ব্যতীত ছাত্র ইউনিয়ন এর কাজ আর ভাবনা আমাদের। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন করেও কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের কাজে থাকতাম ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধের পর সিলেটের দাঁড়িয়াপাড়ার পার্টির কমিউনে থাকতাম আমরা। হিসাব করা খাবার খেয়ে আমাদের কোন অশান্তি থাকত না। জল্লারপাড়ের ছাত্র ইউনিয়ন এর অফিসটা বিকালে হয় তুমি না হয় আমি খুলতাম। দশম বার্লিন যুব উৎসবে তোমাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা পরিবর্তন করে অন্য এক জনকে পাঠাতে হলো। হাসি মুখে তুমি তা মেনে নিলে। তুমি যে বার জেলা কমিটির সভাপতি সে বার তুমি প্রদীপদা, মীরবখত আনসারি ভাইরা আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কামনা করেছিলে। আগের বার সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমার তৎপরতায় তোমরা সন্তুষ্ট হওয়াতেই এই কামনা করেছিলে। কিন্তু উপরের সিদ্ধান্তে তা হবে না জেনে তোমরা বিষয় নির্বাচনী কমিটির সভায় অনুপস্থিত থাকলে। আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে নির্বাচন করা হলো। আমার কাজে তুমি খুবই সন্তুষ্ট ছিলে। আমার কাজে তোমার পরামর্শ আমায় অনুপ্রাণিত করতো।আরো কত কি। সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে তুমি ছিলে অগ্রণী ছাত্র নেতা। তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছো না ফেরার দেশে। তুমি ছিলে সহজ সরল, কিন্তু সমাজের, রাষ্ট্রের কল্যাণের সংগ্রামে তুমি ছিলে আপোসহীন। অসমতাবিরোধী লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তুমি সেই লড়াইয়ে ছিলে। ঐক্য ন্যাপকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তুমি ছিলে খুবই তৎপর।এই রাজনৈতিক দলটির সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ছিলে তুমি। দলের কোষাধ্যক্ষ এর দায়িত্বটাও আমরা তোমাকে দিয়েছিলাম। দলের তহবিল সৃষ্টিতেও আর্থিক শৃংখলায় তুমি ছিলে তৎপর। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যের ব্যাপারে তোমার কর্মতৎপরতা কর্মীদের উৎসাহিত করতো। স্বজন বন্ধু বান্ধব এর দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে তুমি ছিলে খুবই সচেতন। সংসার জীবনে তোমার সংকটকালেও এ ব্যাপারে তুমি পিছুপা হতে না। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা CCDA এর উপ-নির্বাহী পরিচালক ছিলে তুমি। তুমি ছিলে না কোথায়, ছিলে আরো অনেক জায়গায়। মনি সিং- ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টি বোর্ডের সহযোগী সদস্য, ও যুব ইউনিয়নের সহ- সভাপতিও ছিলে তুমি। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত তুমি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ছিলে। সর্বোপরি তুমি ছিলে এ দেশের এক জন শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৯৭১ সনে জীবন মরণের কথা চিন্তা না করে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে মুক্তিযুদ্ধে, তুমি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘ তোমায় লাল সালাম। শায়েস্তাগঞ্জের বরছর গ্রামের শচীন্দ্র দেবরায় ও লক্ষীরাণী দেবরায় এর ঘর আলো করে ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ খ্রিঃ তোমার আগমন ঘটেছিল এ পৃথিবীতে। মাত্র ৬৯ বছর বয়সে তোমার জীবনদীপ নিবে গেল। নব্বই ঊর্ধ মাসিমা অর্থাৎ তোমার মাকে তোমার শেষকৃত্যানুষ্ঠান দেখতে হলো। এ যে কত বেদনার তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ১৯৮৪ খ্রিঃ তোমার জীবন সাথী হিসাবে গ্রহণ করলে সুনামগঞ্জের প্রগতিশীল পরিবারের সন্তান মিনতি দে শুকলাকে। তোমার চির অনুপস্থিতিতে ওকে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। ওর জন্য তা কত যে বেদনাদায়ক তা প্রকাশের অন্তরালে। তোমার এই চলে যাওয়াকে মেনে নেয়া ছাড়া ওর জন্য আর কোন বিকল্প নেই। ও আমার স্নেহাষ্পদ ছোট বোন তুল্য। সে দিক দিয়েও তুমি আমার খুবই কাছের। ওকেসহ জীবন সংগ্রামে কোন কোন সময় কঠিন সময় অতিবাহিত করেছ তুমি, কিন্তু তোমাদের চেহারা মলিন দেখিনি কখনো। যখন পারিবারিক জীবনে তোমার সচলতা দেখা দিল তখন তুমি চলে গেলে পরপারে। তোমায় আমরা ভুলতে পারব না। তুমি ভালো থেকো। আজ তোমার দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে তোমাকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
আব্দুল মোনায়েম নেহরু: রাজনীতিক, ঐক্যন্যাপের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য
(ফেইসবুক থেকে নেয়া)