সিসিক নির্বাচন:লড়াই করেছেন বাবুল-শাহজাহান

চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী

সিলেট থেকেঃ শেষ হলো সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছিল বিভিন্ন প্রার্থী এবং সচেতন মহলের। এরমধ্যে ইভিএম জটিলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে শেষ পর্যন্ত এসব আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে নির্বাচন হয়েছে উৎসবমুখর। না ছিল প্রকৃতির বৈরিতা, না ছিল ইভিএমএ’র বিরক্তিকর বিলম্ব। নির্বাচনে সরকারি দল আ’লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জয় পেয়েছেন প্রত্যাশিত বিশাল ব্যবধানে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধীর সাথে ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় সাড়ে ৬৮ হাজার! বাস্তবে নৌকা ছিল অপ্রতিদ্বন্ধী। মূলতঃ প্রতিদ্বন্ধিতা হয়েছে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে। জাতীয় পার্টির বিত্তশালী প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুলের সাথে ভোটের লড়াইয়ে বাজিমাত করেছেন শাহজাহান মাস্টার নামক এক অখ্যাত প্রতিদ্বন্ধী। ২/৩টি কেন্দ্রের বেশী কোথাও যিনি নির্বাচনী এজেন্টই দিতে পারেন নি।
এবারের সিসিক নির্বাচন নিয়ে আ’লীগের ঐক্য ছিল ইস্পাত কঠিন। যথারীতি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল সরকারি দলটি। বিএনপি বা বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীবিহীন এবারের নির্বাচনে নৌকার জয় প্রায় নিশ্চিত, জানা সত্ত্বেও প্রচারণায় কোন গাফিলতি ছিলনা আ’লীগের। জেলা ও মহানগর শাখার নেতৃবৃন্দের সাথে প্রচারণা চালিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দও। দলটির অন্য অঙ্গ-সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাও শেষপর্যন্ত মাঠে ছিলেন। আর তাই তারা তাদের প্রত্যাশিত জয় নিয়েই ঘরে ফিরেছে।

এর বিপরীতে জাতীয় পার্টি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত ছিল। নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরুতে দলের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে যাওয়ায় দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ দু’নেতার কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনে নিস্ক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। আরও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকায় ভোট টানতে পারেন এমন কোন কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় নেতাকে নজরুল ইসলাম বাবুলের সাথে দেখা যায়নি। তিনি অনেক কেন্দ্রে এজেন্টও দিতে পারেন নি। আর প্রচারণার জন্য সেন্টার কমিটি গঠনেরও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি তার।
সাংগঠনিক বা দলীয় এসব দুর্বলতার বাইরে আরও সমস্যা ছিল তাদের। ব্যক্তিগত ইমেজেও তিনি নৌকার প্রার্থীর অনেক পেছনে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ‘মুন্নি বিষয়ক’ ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি আনোয়ারুজ্জামান ও ছাত্রলীগ যুবলীগকে দায়ী করে যে বক্তব্য রেখেছেন, মানুষ তা ভালোভাবে নেয়নি। সেটা যে ‘উদর পি-ি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর অপচেষ্টা, তা খুব সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছেন। তাছাড়া তিনি, আনোয়ারুজ্জামান ও আ’লীগকে প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে না গোনার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়েও হাসাহাসি হয়েছে প্রচুর।আ’লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, সবার মতো বাবুলও ফলাফল আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই বারবার তার লোকজনকে হয়রানি, এজেন্ট না হতে হুমকি, শহরের বাইরে থেকে প্রচুর লোক জড়ো করা হচ্ছে, ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশে গিয়ে কোন জিডি বা মামলা দায়েরের খবর পাওয়া যায়নি।

এমনকি নির্বাচনের দিনেও তিনি বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্ট বের করে দেয়ার কাল্পনিক গল্প ফাঁদলেও কোথাও থেকে এমন কোন সংবাদ কোন গণমাধ্যম কর্মী দেননি। বরং তার প্রচার সেল থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, জাপা প্রার্থী বাবুল বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ করলেও নির্দিষ্ট করে তিনি কেন্দ্রগুলোর নাম বলতে পারেন নি।নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর নগর জাতীয় পার্টির সদস্যসচিব আব্দুস শহীদ লস্কর বশির গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাবুল নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিবেন। এখন অসুস্থ। সুস্থ হলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনী পদক্ষেপ নিবেন। এটাকেও একটা মুখরক্ষার চেষ্টা বলেই মুখ টিপে হাসাহাসি চলছে সচেতন মহলে। কিন্তু তবু যে তিনি ৫০ হাজারের বেশী ভোট পেয়েছেন, এটাকেই চমক হিসাবে দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে আওয়ামী নেতাকর্মী থেকে সমর্থকরাও।এরচে বরং কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তৃতীয় স্থান লাভ করা মো. শাহজাহান মিয়া বা শাহজাহান মাস্টার। প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়ে তিনি জাপা প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী। দু’জনের ভোটের ব্যবধান ২০ হাজারের। আর নৌকার সঙ্গে লাঙলের ভোটের ব্যবধান অর্ধেকেরও বেশী, ৬৮ হাজারের উপরে। নজরুল ইসলাম বাবুলের মতো তার টাকা ছিলনা। নিজেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। তাই সবগুলো কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারেননি। প্রচারণা চালাতে পারেননি মোটেও। নিজের বাইসাইকেল নিয়ে চেষ্টা করেছেন মানুষের কাছে যাওয়ার। তাও আবার একা একা। এই করে করে বলতে গেলে জাপা প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল ও তার নেতাকর্মীদের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। কেউ কেউ বলছেন, সব কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে পারলে বা আরেকটু ভালো প্রচারণা চালাতে পারলে তিনি হয়ত এবারের নির্বাচনে নৌকার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে আবির্ভূত হতেন।অন্য প্রার্থীদের মধ্যে শেষ মূহুর্তে নির্বাচন বয়কট করা ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মাহমুদুল হাসান হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ১২,৭৯৪, জাকের পার্টির জহিরুল আলম গোলাপফুল প্রতীকে পেয়েছেন ৩,৪০৫, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্রিকেট ব্যাট প্রতীকে পেয়েছেন ২,৬৪৮, মো. আব্দুল হানিফ কুটু ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ৪,২১৬, মোশতাক আহমদ রউফ মোস্তফা হরিণ প্রতীকে পেয়েছেন ২,৯৫৯ ভোট।বৃষ্টির বাগড়া থাকবে বলে শঙ্কা ছিল। কিন্তু না, সিসিক নির্বাচনের দিন প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল অনুকূল। আবার ইভিএম-এ ধীর গতির বিরক্তিতে ভোট কম কাস্ট হওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, তাও তেমন একটা সত্যি হয়নি। ভালোই ভোট হয়েছে। অনেক ভোটারই ইভিএম-এ তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আর স্থানীয় নির্বাচনে প্রায় ৪৭ ভাগ ভোট পড়াটাও মোটামুটি সন্তোষজনকই বটে।

You might also like