বিদ্যুৎ সংকটে পূর্বাঞ্চলের রেলস্টেশন গুলোতে অবৈধ সংযোগ লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর
সত্যবাণী
সিলেট থেকেঃ দেশের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মৌলভীবাজার।এ জেলার বেশিরভাগ রেলস্টেশনেই একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। রেলওয়ের বিদ্যুৎ লাইন থেকে যেসব অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়-সেগুলোর বিল কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ বহন করে। পাশাপাশি সরাসরি মেইন লাইন থেকে হাজার হাজার দোকানপাট ও বাসাবাড়িতেও সংযোগ নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক সরেজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতির এমন ভয়ংকর সব তথ্য। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থেকে সংবাদদাতা জানান, সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কারও কারও ঘরে জ্বলছে বাতি আবার কারও ঘরে এলইডি টিভি, ফ্রিজ, রান্নার জন্য প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে হিটার। এ জন্য তাদের মাসিক বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে মাত্র ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ নির্ভর আরাম-আয়েশে কাটছে তাদের বিলাসী জীবন। তাদের নেই বিদ্যুতের কোনো মিটার, মাসিক বিদ্যুৎ ব্যবহার কত ইউনিট তাও জানার নেই কোনো উপায়। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় মাসের পর মাস অধিক বিদ্যুৎ ব্যবহার করেও নামমাত্র মূল্য দিয়ে থাকেন তারা।
রেলের কর্মচারিরা নিজেদের নামে বিদ্যুৎ মিটার সংযোগ নিয়ে একাধিক ভাড়াটিয়াকে অবৈধভাবে লাইন সংযোগ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। যা চলছে বছরের পর বছর ধরে। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারিরাও এ অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এটা শুধু কুলাউড়া-শ্রীমঙ্গল বা শায়েস্তাগঞ্জে নয়, সিলেট রেলস্টেশনের বিপুলসংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এই অব্যাহত দুর্নীতির সাথে জড়িত।
সুত্র জানায়, সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের কয়েকটি কক্ষ বন্ধ থাকায় সেগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশিরভাগই বহিরাগত পরিবারকে ভাড়া দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করছেন। দিনের পর দিন এভাবেই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে সুবিধা ভোগ করছেন তারা। ফলে বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়ছে রেল কর্তৃপক্ষ।
প্রতিটি রেলওয়ে স্টেশনের পাশে আবাসিক কোয়ার্টার, মার্কেট, কলোনিসহ ছোট-বড় হাজার হাজার স্থাপনা রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ থেকে এসব বাসা ও অফিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। অবৈধভাবে সংযোগ নেয়া এসব মার্কেট ও বাসাবাড়িতে লাইট, ফ্যান, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক আয়রণ, বৈদ্যুতিক চুল্লি, পানি তোলার মটরপাম্পসহ হোটেল, ভাসমান দোকান, ঝুপড়িঘরে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। অবৈধ সংযোগের সঙ্গে সরাসরি রেলওয়ে ও বিদ্যুৎ অফিসের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারি জড়িত।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ৪র্থ শ্রেণীর এক কর্মচারি বলেন, রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এসব ইউনিট নামে-বেনামে বরাদ্দ নিয়ে বহিরাগতদের ভাড়া দিচ্ছেন। ফলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী একাধিক নারী-পুরুষ জানান, আমরা মাস শেষে ১৫শ’ টাকা করে দিচ্ছি।
শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গলের স্থানীয়রা জানান, সমাজে একটা শ্রেণী আছে সবকিছুর মধ্যে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। সিলেট-আখাউড়া সেকশনের রেল স্টেশনগুলোর আশপাশে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ তারই একটি নমুনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এগুলোর বিরুদ্ধে বলিষ্ট পদক্ষেপ না নেয়, তবে দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরা হয়তো সম্ভব হবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কুলাউড়া পৌর তালামীযের সাবেক সভাপতি আবদুল মুবিন জানান, ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী জুয়েল হোসেনসহ তার একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এমন কাজ চলছে। শুধু কুলাউড়া, শমশেরনগর ও শ্রীমঙ্গল নয়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের বিভিন্ন স্টেশনে অবাধে চলছে এমন অবৈধ কর্মকা-। এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জুয়েল হোসেন। তিনি দুর্নীতিবাজ জুয়েলের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানান।এ ব্যাপারে বারবার যোগাযোগ করে ও মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সিলেট-আখাউড়া রেলওয়ে জংশন মৌলভীবাজার এরিয়ার ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) জুয়েল হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, জুয়েল হোসেনের বিরুদ্ধে সরকারি উন্নয়নের তথ্য দিতে টালবাহানাসহ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশন স্টেশনে তিনি যোগদানের পর থেকেই নিজের আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। যোগদানের পর বড় একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এই সিন্ডিকেটের সহায়তায় তিনি নির্বিঘেœ বিভিন্ন অনিয়ম ও আত্মসাত চালিয়ে যাচ্ছেন। এরআগেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়েছে।রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) রথিশ পাল জানান, কুলাউড়া রেলস্টেশনে প্রায় দেড় শ’ বৈধ মিটার রয়েছে। মাঝে মধ্যে স্টেশনে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সর্বশেষ চলতি মাসে কুলাউড়া রেলস্টেশনে অভিযান পরিচালনা করে ১০টি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। রথিশ পালের দাবি, স্টেশন এলাকায় অবৈধ বসবাস রোধ করা গেলে এই সমস্যারও সমাধান হবে।
এ বিষয়ে শমশেরনগর স্টেশন মাস্টারের কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও শ্রীমঙ্গলের স্টেশন মাস্টার বলেন, অবৈধ সংযোগের বিষয়টি তার জানা নেই। ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জুয়েল হোসেনের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নেয়ার কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন।অপরদিকে কুলাউড়া রেল স্টেশন মাস্টার রোমান আহমদ জানান, একটি মিটার থেকে একাধিক সংযোগ দেয়া হলে তা সরকারের ক্ষতি এবং রেলওয়ের নিয়ম বহির্ভূত। স্টেশনে অবৈধ মিটার রয়েছে এ রকম তথ্য পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।কুলাউড়া পৌরসভার মেয়র অধ্যক্ষ সিপার উদ্দিন আহমদ জানান, সরকারের ক্ষতি হউক-এমন কিছু আমরা চাইনা। রেলস্টেশনে অবৈধ সংযোগের তথ্য পাওয়া গেলে পৌর কর্তৃপক্ষ রেলওয়ের পাশে থাকবে।এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির বলেন, যারাই অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সিলেট রেল স্টেশন সংলগ্ন আশপাশের দোকানপাট বা বসতঘরগুলোতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা হবে।