দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনঃ নৌকা পাবেন না এলাকাবিচ্ছিন্ন এমপি-মন্ত্রীরা

নিউজ ডেক্স
সত্যবাণীঃ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গত সাড়ে ৪ বছরে নিজ এলাকায় কেউ গেছেন একবার। কেউ গেছেন দু-চারবার। দলীয় নেতা-কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ রাজধানীতে এসেও খুঁজে পাননি জনপ্রতিনিধিকে। কেউ সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নিতে বছরে একবার কিংবা দু’বার গেছেন। জেলা সার্কিট হাউস বা উপজেলা ডাকবাংলোতে কর্মসূচি শেষ করেই ঢাকায় চলে এসেছেন-এমন এমপি-মন্ত্রীরা এবার নৌকা পাবেন না।
আবার কারও ‘গডফাদার বনে যাওয়া, আ’লীগকে মাইনাস করে ‘এমপি লীগ’, ‘ভাই লীগ’ বা ‘ভাবি লীগ’, ‘আত্মীয় লীগ’ এবং সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তোলা এমপিদের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা দেবেন না আ’লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে আ’লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী সংসদ সদস্যদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। একাধিক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার কাছে সার্ভে রিপোর্ট রয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী যারা ভালো কাজ করেছেন, যারা জনগণের কাছে যান, আ’লীগের উন্নয়নের কথা বলেন, ভোট চান, জনগণের সুযোগ-সুবিধা দেখেন এবং জনগণ যাদের চায় তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে। যারা জনবিচ্ছিন্ন, এলাকার লোকজনের সঙ্গে যাদের সুসম্পর্ক নেই, এলাকায় যান না-তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না।’
আ’লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতাও এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেছেন, আ’লীগ সভানেত্রী এবার দলীয় মনোনয়নে হার্ডলাইনে থাকবেন। বিতর্কিত কাউকে মনোনয়ন দেবেন না। দীর্ঘদিন এমপি থেকে যারা এলাকায় যাননি, দলীয় নেতা-কর্মীদের সুখ-দুঃখের খবর নেননি-তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না।
নভেম্বরে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে ভোট হওয়ার কথা। সে কারণে আ’লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে চলছে প্রার্থী বাছাইয়ে জরিপের কাজ। কয়েক দফা জরিপ কাজ শেষ হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমান সংসদে আ’লীগের বেশ কিছু এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তারা বছরে একবারও এলাকায় যাননি। কেউ কেউ গত সাড়ে ৪ বছরে একবার এলাকায় গেছেন। কিন্তু জনগণ সেই এমপি’র ডাকে সাড়া দেননি। অনেক এমপি সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি উদ্বোধন করতেই শুধু এলাকায় গেছেন। সদরের এমপিরা সার্কিট হাউস, সদরের বাইরের এমপিরা উপজেলা ডাকবাংলো কিংবা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসে বসেই কাজ শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন। এমপির ঘনিষ্ঠ দু-একজন নেতা সাক্ষাৎ পেলেও অধিকাংশ নেতা-কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষ এমপির ধারেকাছে ভিড়তে পারেননি। এসব এলাকাবিচ্ছিন্ন এমপি’র তালিকা তৈরি হয়েছে। যা দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার টেবিলে রয়েছে।
আ’লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, যে কোনো নির্বাচনে আ’লীগ সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দিয়ে থাকে। এলাকায় যাদের মানুষের সঙ্গে, দলীয় নেতা-কর্মীর সঙ্গে সম্পৃক্তা নেই এমন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয় না। সংসদ নির্বাচনেও তাই হবে। কর্মীবান্ধব, জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো ব্যক্তিকেই নৌকা দেয়া হবে।’
আ’লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসবে-সেই নির্বাচন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং হবে-এটা ধরেই পরিকল্পনা করছে আ’লীগের হাইকমান্ড। সেই কারণে এলাকায় যাদের ভালো ইমেজ রয়েছে, শিক্ষিত, মার্জিত ও মানুষের আপদ-বিপদে এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে থেকেই এবার বেশি মনোনয়ন দেয়া হবে।
আ’লীগের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি সংসদে থাকা দলীয় এমপিদের মধ্যে কমপক্ষে ১০০ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে টেন্ডার-চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, ‘গডফাদার’ ও ‘জনবিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। ভাই, ভাগিনাদের দিয়ে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ, হাটবাজার দখল, পুকুর দখল, স্কুল-কলেজের সভাপতি বানিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। দলীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এবার শতাধিক আসনে নতুন নেতা মনোনয়ন পাবেন। কারণ যারা সংসদ সদস্য রয়েছেন, তাদের প্রতি এলাকার মানুষের বিভিন্ন কারণে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। এই ক্ষোভ যাদের বিরুদ্ধে বেশি, তাদের বাদ দিয়ে সেখানে নতুন মুখ মনোনয়ন দেয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে লাভবান হবে দল। কারণ নতুনের প্রতি আকর্ষণ থাকে সবার। এ আকর্ষণকে পুঁজি করে সুফল ঘরে তোলা যাবে। পাশাপাশি বিতর্কিতদের শাস্তিও দেয়া হবে।
আ’লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত সংসদ নির্বাচনেও একাধিক ক্লিন ইমেজ সম্পন্ন ব্যক্তি, পুরনো ত্যাগী নেতাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় বিতর্কিত হয়েছেন ইতোমধ্যে। এসব এমপির চারপাশে টাউট-বাটপারদের জয়-জয়কার। দলীয় নেতা-কর্মীরা উপেক্ষিত ও বঞ্চিত।
এ প্রসঙ্গে আ’লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নির্বাচন নিয়ে বারবার জরিপ করছেন। জরিপের ভিত্তিতেই নৌকা দেয়া হবে। যারা জনবিচ্ছিন্ন, বিতর্কিত তারা দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। একই সঙ্গে যারা এমপি থাকা অবস্থায় দলীয় নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করেছেন, নির্বাচনী এলাকায় থাকেননি, দল বাদ দিয়ে ‘ভাই লীগ’, ‘এমপি লীগ’, আত্মীয় লীগ গড়ে তুলেছেন তাদের কপাল পুড়বে। কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যা কোনো জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে নৌকা দেবেন না।’

You might also like