ড. ছদরুদ্দিন চৌধুরীকে স্মরণ: ‘প্রত্যাশা আর প্রাপ্তীর হিসেব কষতে শিখেছিলাম নানার কাছে’

 সাতিয়া আহমেদ সৌতি

 

বৃহস্পতিবার, ২৩ শে জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য  ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিবসটিতে তাঁকে স্মরণ করছেন প্রয়াত মি: চৌধুরীর নাতনী (বড় মেয়ের কন্যা) সাতিয়া আহমেদ সৌতি।

 

নানার সাথে আমার সবচেয়ে ছোটবেলার স্মৃতি রাজশাহীর বাসায়, নীল রঙের প্লেটে মাছ ভাত মাখিয়ে নানা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। তখন আমার বয়স ৩ অথবা ৪ হবে। নানা আমাকে খাওয়াতে ভালবাসতেন, নিজেও খেতে ভালবাসতেন। ছোটবেলায় নানার হাতে খাবার খাওয়ার প্রচুর স্মৃতি।

ইউনিভার্সিটি ওফ এসিয়া প্যাসিফিকে যখন নানা কাজ শুরু করেন, তখন আমি ক্লাস ৫/৬ এ পড়ি। আমার স্কুল বাস, নানার অফিস বিল্ডিং এর সামনে আমাকে নামিয়ে দিত। আমি আর নানা এক সাথে বাসায় ফিরতাম। দুপুরে খাবার টেবিলে দুইজন মজা করে দুপুরের খাবার খেতাম। নানা আমাকে ঝাল খাওয়ার মজা শিখিয়েছেন। তখন থেকে ভাতের সাথে আমার কাঁচা মরিচ খাওয়ার অভ্যাস হয়। নানা খুব ভাল রান্নাও করতেন। উনার রান্না করা ঝাল ভুনা গরুর মাংস ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়।

নান ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সাথে ছোট্ট সৌতি

 

নানা আদর করে আমাকে ডাকতেন মজি। হঠাৎ হঠাৎ করে ডেকে উঠতেন, মজি কই? দৌড়ে কাছে গেলে বলতেন “মজি একটা নাখই দিলাও”। নাখই হল নাক ঘসে আদর দেয়া।

আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি হল নানার সাথে ট্রেনে করে সিলেট যাওয়া। রোজার বন্ধে এক মাসের জন্য ঢাকা থেকে সিলেটে যেতাম। ট্রেনে পুরোটা সময় আমি আর নানা হকারদের কাছ থেকে খাবার কিনতাম আর খেতে খেতে গল্পের বই পড়তাম।

নানাকে খুব ছোটবেলা থেকে অনেক বেশী কাছে পেয়েছি। ছোট বেলায় নানাকে আমার মনের কথা যা ইচ্ছা বলতাম। এর অনেক কিছুই আমার মনে নেই। আমার বিয়ের পর এক দিন আমার সহধর্মী গল্পে গল্পে জানাল, নানা নাকি তাকে বলেছেন যে আমার স্বপ্ন ছিল আমি নাকি নাসা সাইন্টিস্ট হতে চাই। এটা ১২ বছর বয়সি, সাইন্স ফিকশনের পোকা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম নানা এত বছর পরও আমার এই হাস্যকর ইচ্ছা মনে রেখেছেন।

আমার ১২ গ্রেডের বোর্ডের পরীক্ষার সময় একটা ছোট অঘটন ঘটে। এমন বড় কিছু না কিন্তু ওই সময় আমার জন্য ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আমি পরীক্ষা উপলক্ষে মা-বাবার কাছ থেকে একটা ঘড়ি উপহার পাই। আমি সেই ঘড়িটা পরে প্রথম পরীক্ষা দিতে যাই। এটাতে ১২,৩,৬ আর ৯ ঘন্টা সংখ্যায়, আর বাকি সব বিন্দু বিন্দু দাগ কাটা ছিল। আমার প্রথম পরীক্ষা ছিল ফিজিক্স। আমার প্রিয় বিষয়। পরীক্ষার প্রশ্ন খুবই ভাল। কিন্তু কোন এক সময় ঘড়ি দেখার সময় আমি সময় ভুল দেখি। ফলে আমি অনেক সময় আছে মনে করে ধীরে ধীরে রিভাইস দিয়ে উত্তর লিখতে থাকি। ফলাফল পুরো ১০০ মার্কের উত্তর লিখে শেষ করতে পারি নি। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আমার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। নানাকে ফোন করে কান্না কিছুতেই বন্ধ করতে পারছি না। এই পরিস্তিতিতে নানা আমাকে কিছু বাস্তবতার জ্ঞান দিলেন। নানা বল্লেন, পরিক্ষায় কত নাম্বর পেলাম সেটার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, আমার হিসাবে আমি কত নম্বর পাব, আর আসলে কত নম্বর পেলাম। আমার জীবনে আজ পর্যন্ত শেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এটা। কতটুকু প্রত্যাশা করছি, আর কতটুকু অর্জন হচ্ছে।

নানার সাথে নব পরিণীতা সৌতি

সেই বার ফিজিক্স পরীক্ষায়, আমি ৭৫ নম্বরের উত্তর লিখেছিলাম, হিসাব করেছিলাম ৭২ পাব, পেয়েছি ৭১। ১৫ বছর পর এখনো এই স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয়। আমি জীবনে প্রথম শিখেছিলাম কিভাবে অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজেকে appreciate করতে হয়।
এরপর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় চাইলাম ফিজিক্স পড়তে এবং সবার প্রথমেই নানার কাছে ফোন করলাম আলোচনা করতে। আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে নানা ফিজিক্স পড়তে মানা করলেন। উনার উপদেষ মত আমি চোখ বন্ধ করে ইন্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করলাম। নানা অনেক দূরদর্শী জ্ঞানী মানুষ। আমেরিকায় এসে ২০০৯ সালে রিসেশন দেখে বুঝলাম ইন্জিনিয়ারিং ডিগ্রীর জন্য বেঁচে গেছি। এখন আবার এই ২০২০ সালের মহামারির তান্ডবে টেক লাইনের মানুষরা তুলনা মুলক ভাবে চাকরি হারানোর দুষ্চিন্তা থেকে মুক্ত।
নানা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মানুষের সাহায্য করে গেছেন। আমি নানার বিশাল কোমল হৃদয় আর নিঃসার্থতা কে ভালবাসি। নানার মত মেধা, বুদ্ধিদ্বীপ্ততা ও সর্বদিকে দক্ষতা আমার নেই। কিন্তু আমি নানার মত নিঃসার্থ ও হৃদয়বান হয়ে, নানার ছোট একটি অংশ নিজের মধ্যে বহন করে নিয়ে যেতে চাই।

(সাতিয়া আহমেদ সৌতি: ডাটাবেজ প্রশাসক,  ক্যালিফোর্নিয়া এয়ার রিসোর্স বোর্ড।)

You might also like