আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ‘..সূর্য অস্তমিত হয় না কখনো’

 সৈয়দ আনাস পাশা

 

অন্তরে ছিলো বাংলা মা
হাতে কলম বিরতিহীন,
অপশক্তির বিরুদ্ধে
ছিলেন তিনি আপোষহীন॥

 

গাফ্ফার ভাই প্রয়াত হয়েছেন আজ বৃহস্পতিবার এক সপ্তাহ হলো। বিদায়ী জার্নি তাঁর এখনও শেষ হয়নি। জন্মমাটিতে ফিরে যাওয়ার আশায় বাক্সবন্দী হয়ে অপেক্ষায় আছেন লন্ডনের হীমঘরে। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, ‘গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে আপনি কিছু লিখলেন না?’ কি লিখবো, কোনটা লিখবো, কোথা থেকে লিখবো? কলম যে আগায় না। অনুজপ্রতিম বন্ধু সাংবাদিক বুলবুল হাসান ঠিকই বলেছেন, অতি প্রিয়জন নিয়ে লেখা বড় কঠিন। বারবার কলম আটকে যায়।

বাঙালির অন্যতম সূর্যসন্তান আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যাকে বুকে ধারন করে ইতিহাস নিজেই হয়েছে সমৃদ্ধ। ইতিহাসে স্থান পেতে হলে দীর্ঘ সাধনা যেখানে প্রয়োজন, সেখানে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ইতিহাসে নিজের স্থান করে নেবেন, গাফ্ফার চৌধুরী নিজেও তা কখনও কল্পনা করেননি। দীর্ঘ কোন সাধনা নয়, নয় কোন পরিকল্পনা, মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ সহযোদ্ধার রক্তাক্ত মরদেহ দেখে মনের তাৎক্ষনিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছিলো যে কবিতার পংতিতে, সেটিই তাকে নিয়ে গিয়েছে  ইতিহাসের এক অনন্য উচ্চতায়। এক কথায় একটি কবিতা দিয়েই তাঁর  ইতিহাস দখল। একুশের সেই কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো..’ তাঁকে প্রথম ইতিহাসের অংশ করেছে এটি যেমন ঠিক, তেমনি এটিও টিক যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কলম থেকে বেরিয়ে আসা লেখাগুলোর মাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর প্রগতিশীল সমাজ চিন্তা প্রতিদিনই ইতিহাসে তার অবস্থান সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধই করেছে। তাঁর এই লেখাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই ইতিহাসে সংরক্ষিত থাকবে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ৩/৪ টি জাতীয় দৈনিকে বিরামহীনভাবে লিখে যাওয়া আর ক’জন লেখক করতে পেরেছেন আমার জানা নেই। বাংলা ও বাঙালীকে হৃদয়ে রেখে আমৃত্যু গাফ্ফার চৌধুরী লিখে গেছেন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও কুপমন্ডকতার বিরুদ্ধে। 

লন্ডনে দৈনিক সমকাল আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকে সমকালের তৎকালিন সম্পাদক আবেদ খান ও লেখকের সাথে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

 

এমন একজন ক্ষনজন্মা মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর অবিচুয়ারী লেখার দুঃসাহস আমার নেই। বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটির স্নেহ সান্নিধ্য পাওয়া একজন হিসেবে নিজের মানষিক শান্তির জন্যই শুধু কিবোর্ড বাটন টিপতে হচ্ছে। ইতিহাসের সম্পদ এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে লেখার শিরোনাম খুঁজতে গিয়ে তাই দ্বারস্থ হতে হলো রবি ঠাকুরের। ঠিকই তো সূর্য কখনও অস্তমিত হয় না, পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে উদিতই থাকে। গাফ্ফার চৌধুরীর মতো সূর্যরাও কখনও অস্তমিত হননা। ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এদের সব কালেই উদীত রাখে। 

আমি বাঙালির বাতিঘর খ্যাত এই কিংবদন্তী সাংবাদিকের স্নেহধন্য ছিলাম, এটি আমার জীবনের অন্যতম একটি বড় পাওয়া। সেই কিশোর বয়স থেকে একটি গানের সূত্র ধরে এই ক্ষনজন্মা মানুষটির সাথে আমার মত অনেকেরই পরিচয়। কিন্তু সরাসরি তার সান্নিধ্যে আসা ক’জনেরই বা ভাগ্যে জুটেছে। আমি গর্ব করেই বলি আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন। শুধু সান্নিধ্য নয়, গাফ্ফার ভাই আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক, আমার গুরু। সাম্প্রদায়িকতা, কূপমন্ডুকতা ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী বিরোধী  আন্দোলনে গাফ্ফার ভাই ছিলেন আমার নেতা। লন্ডন থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক সিলেটের ডাক-এ গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। সপ্তাহের বুধবার পত্রিকা প্রেসে যেতো। ঐদিন গাফ্ফার ভাই সারাদিন অফিসে আমাদের সাথে থাকতেন। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি শিরোনামেই কিভাবে পুরো খবরের সার সংক্ষেপ বলা যায়, শিখার চেষ্টা করেছি সম্পাদকীয় কিভাবে লিখতে হয়। হাতে কলমে শিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে তাঁর ধমক যেমন খেয়েছি, ঠিক তেমনি কোন কোন নিউজ আইটেমের জন্য অকৃপণ প্রশংসাও পেয়েছি। গাফ্ফার ভাইয়ের ইচ্ছে ছিলো আমি নিয়মিত কলাম লিখি। সম্ভবত ২০০৩/৪ সালের দিকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় নতুন একটি জাতীয় দৈনিক ‘মাতৃভূমি’। আমাকে বলা হলো নিয়মিতই যাতে লন্ডনের কমিউনিটি নিয়ে লিখি। গাফ্ফার ভাই নিজ থেকেই আমার কলামের নাম ঠিক করে দিলেন ‘স্বপ্ত সিন্ধুর ওপার থেকে’। সবাইকে দিয়ে কি আর সবকিছু হয়, গাফ্ফার ভাইকে এটি আমি আর বুঝাতে পারিনা। ২/১ সপ্তাহ লেখার পরই আমার কলামিষ্ট হওয়ার চেষ্টা শেষ। খুব রাগ করলেন গাফ্ফার ভাই। 

২০০৭ সালের দিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখার সম্মেলন হবে। আনসার আহমেদ উল্লাহসহ সংগঠকদের ইচ্ছে আমি সেক্রেটারী হই। কিন্তু আমি কোন দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিলাম না। আনসার ভাই গিয়ে ধরলেন গাফ্ফার ভাই ও শফিক ভাইকে (সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) আমাকে রাজি করানোর জন্য। গাফ্ফার ভাই আমাকে দায়িত্ব নিতে বললে, আমি ব্যস্থতা দেখিয়ে অনিহা প্রকাশ করলাম। একটু রেগে গিয়ে গাফ্ফার ভাই বললেন, ‘কেউ না কেউতো দায়িত্ব নিতে হয়। আন্দোলনের প্রতি জন সম্পৃক্ততার আহবান জানাবে, অথচ দায়িত্ব নেবে না এটি কেমন কথা। এটিতো মানুষের সাথে ভন্ডামী’। গাফ্ফার ভাইয়ের ধমকে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়েছিলাম, যা পালন করেছি ২০১৮ সাল পর্যন্ত।

লন্ডনে সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমানের শোক সভায়  বক্তব্য রাখছেন গাফফার চৌধুরী

 

লন্ডনের সিলেটের ডাক বা নতুন দিনে কাজ করার সময়ই শুধু নয়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে যে সম্পর্ক ছিলো তা অনেকটা আমাদের পরিবার সদস্যের মতই। আমার বাসার আড্ডাগুলোতে প্রায় সময়ই গাফ্ফার ভাই থাকতেন মধ্যমনি। যতদিন তাঁর চলাফেরার শক্তি ছিলো, ততদিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নিজেই আসতেন। চলৎশক্তি হারানোর পর আমি বা আমার স্ত্রী নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসতাম। চলৎশক্তি হারানোর পর নিয়ে আসতেন তাঁর কেয়ারের দায়িত্বে নিয়োজিত রুহুল ভাই। শুধু আমার বাসাই নয়, আমার পরিবার সদস্যদের নিয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় বসেও যে কত আড্ডা দিয়েছি। খুবই ভোজন রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। আমার স্ত্রী কলির রান্না খুব পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে টেলিফোন করে কলির সাথে কথা বলিয়ে দিতেন ভাবীকে। লাই শাক দিয়ে মাছের ভর্তাটা কেমন করে করতে হয়, সাতকরা কোন মাছ দিয়ে ভালো হয় এগুলো ভাবীকে বুঝিয়ে দিতে বলতেন কলিকে। ব্রিটেনে বেড়ে ওঠার পরও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আমার স্ত্রীর দুর্বলতায় খুবই তৃপ্তি পেতেন গাফ্ফার ভাই। একবার আমাদের বাসায় আসার সময় একুশের গানটি নিজ হাতে লিখে এনে কলিকে উপহার দিয়েছিলেন। 

বাংলা, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার দুই ছেলেরও যে যৎসামান্য আকর্ষন, এটির পেছনেও কিন্তু রয়েছে গাফ্ফার ভাইয়ের অনেক অবদান। আমাদের বাসার আড্ডা আলোচনায় তারা তাদের গাফ্ফার আঙ্কেলের কাছ থেকে বাংলা ও বাংলাদেশ নিয়ে অনেক গল্প শোনার সুযোগ পেয়েছে বলেই বাংলার প্রতি তাদের আকর্ষন আরও বেড়েছে বলে আমি মনেকরি। আমার বড় ছেলে মাহাথির তার ৮/৯ বছর বয়সে একবার চ্যানেল এস এর একটি অনুষ্ঠানে শামীম আপার (শামীম আজাদ) এক প্রশ্নের উত্তরে যখন বললো, শহীদ মিনার, একুশে ফেব্রুয়ারি এগুলোর প্রতি তার আকর্ষন বেড়েছে তার গাফ্ফার আঙ্কেলের সান্নিধ্য পেয়ে, গল্প শুনে, তখন কৃতজ্ঞতায় নত হয়েছি গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি।

বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির পায়ের ধূলা গ্রহনের সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের লন্ডনের বাড়িটির। যারাই এসেছেন, সবাই এসেই সাক্ষাত করতে চাইতেন গাফ্ফার ভাই’র সাথে। কখনও তাদের নিয়ে গিয়েছি গাফ্ফার ভাইর বাসায়, কখনও তিনি নিজে চলে এসেছেন আমাদের বাড়ীতে। ঐসব আড্ডায় প্রায় সময়ই উপস্থিত থাকতেন ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রবীন সংগঠক সুলতান ভাই (সুলতান শরীফ),  প্রয়াত ভাবী নোরা শরিফ, মাহমুদ এ রউফ, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক আবু মুসা হাসান, নীলু হাসান, সিপিবি যুক্তরাজ্য শাখার এক সময়ের সংগঠক সৈয়দ রকিব, সৈয়দ এনামুল ইসলামসহ আরও অনেকে। গুনিজনদের ঐসব আড্ডার অংশ হওয়ার সুযোগে গাফ্ফার ভাইয়ের হাত ধরে কত যে ঢুকেছি ইতিহাসের অন্দরে তার হিসেব কি আর রেখেছি।

লন্ডনে লেখকের বাসায়  তিন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের দায়ে একই সাথে কারাবন্দী সাবেক অর্থমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত এএমএ মুহিত, সাবেক সচিব মোকাম্মেল হক ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ অন্যান্যরা ।

 

রসিক মানুষ গাফফার ভাই তাঁর রসালো আলোচনায় সব সময়ই থেকেছেন সব আড্ডার মধ্যমনি। বাংলাদেশের  সাংবাদিকতা জগতের আরেক প্রতিকৃত ‘সংবাদ’ এর তৎকালীন সম্পাদক বজলুর রহমান লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে একবার আমার আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন। এরও আগে একবার এসেছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টি, বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক। পরবর্তীতে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার এই দুজন তারকা ব্যাক্তিই প্রয়াত হন। তো, বজলু ভাইয়ের (সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান) মৃত্যুর পর তার স্মরণে লন্ডনে একটি শোক সভার উদ্যোগ নেই আমরা। শোক সভায় যোগদানের জন্য বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে এসেছেন আরেক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সম্পাদক আবেদ খান। উঠেছেন আমাদের বাড়ীতে। গাফ্ফার ভাই এলেন আড্ডা দিতে। এসেই আবেদ ভাইকে বললেন, ‘আনাসের বাসায় বাংলাদেশ থেকে যারাই এসে উঠেন, তারা দেশে ফিরে যাওয়ার পর আর বেশিদিন বাঁচেন না। সাইফউদ্দিন মানিক ও বজলুর রহমান আতিথ্য নিয়েছিলেন আনাসের, দেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরই তারা মারা যান। আপনারও ঝুঁকি আছে কিন্তু’, বলেই উচ্চস্বরে হেসে উঠেন গাফ্ফার ভাই। 

আরেকবার গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে ড্রাইভ করে কোথাও যাচ্ছি। সঙ্গে আমার ছোট ছেলে নাহিয়ান, বয়স তখন তার ৬/৭ বছর। তো গাড়ীতে পোর্টেবল সেটনেভ সেট করে গন্তব্য ঠিকানা ঢুকিয়েছি। সেটনেভে পুরুষ কন্ঠ চালককে গাইড দিচ্ছে। হঠাৎ নাহিয়ান বলে উঠলো এই ভয়েস বদলে দাও আব্বু। গাফ্ফার ভাই বলে উঠলেন, ‘এই শিশু বয়সেও মেয়ে কন্ঠ শুনতে চায়, এই ছেলেটি যৌবনে কত মেয়ে যে পাগল করবে’।

লং ড্রাইভে একবার কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পাশের সীটে গাফ্ফার ভাই। হঠাৎ গাফ্ফার ভাইয়ের কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত বেজে উঠলো। আমরা তো খুব উপভোগ করছি, গান থামিয়ে গাফ্ফার ভাই বললেন, ‘তুমাদের খুশি করার জন্য নয়, নিজের জীবন ঝুকিমুক্ত রাখতে বিরস কন্ঠে চিৎকার শুরু করে রবী ঠাকুরকে এই অপমান করছি। আমাদের ড্রাইভার আনাসের চোখ থেকে ঘুম তাড়াতেই আমার এই অপচেষ্টা। এই অপচেষ্টা আরেকবার এক লং ড্রাইভে আমেরিকায়ও করেছি আমি’। 

ভোজন রসিক গাফ্ফার ভাই নিষেধ থাকা সত্বেও খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন বাছবিচার করতেন না। একবার তাঁকে এবিষয়ে উপদেশ দিতে গেলে বললেন, ‘কায়েসের (ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের এক সময়ের হাই কমিশনার মিজারুল কায়েস) দেয়া ঐ উপদেশতো আমি লঙ্গন করতে পারিনা। কায়েস বলেছিলো সৃষ্টিকর্তা শত নিয়ামত সাথে দিয়ে আমাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সুস্বাদু খাবারগুলোও এই নিয়ামতের অংশ। এর প্রত্যেকটির স্বাদ যদি গ্রহন করে না যাই, তাহলে পরকালে কি জবাব দেবো সৃষ্টিকর্তার কাছে।’- এই হলেন গাফ্ফার ভাই। যে কোন গম্ভীর আড্ডা আলোচনাই তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তুলতে ছিলেন পারদর্শী।

লেখকের বাসায় আড্ডা

গাফফার ভাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিরামহীন লিখে গেছেন। সমাজে চলমান অসংগতিগুলোর বিরুদ্ধে সদা সক্রিয় ছিলো তাঁর কলম। সমালোচকরা তাঁকে কোন একটি গ্রুপের পক্ষের লেখক বলে অভিযুক্ত করতেন। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, লেখালেখিতে আপনি নিরপেক্ষ নন, আপনার বিরুদ্ধে উত্তাপিত এমন অভিযোগের উত্তরে কি জবাব আছে আপনার? বলেছিলেন, এ অভিযোগতো ঠিকই আছে। আমি শুভ শক্তির পক্ষে লিখি, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক সমাজের পক্ষে আমার কলম চলে। স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও প্রগতি বিরোধী শক্তির বিপক্ষে আমার অবস্থান। সুতরাং আমি নিরপেক্ষ নই, এই অভিযোগ তো তাদের মিথ্যে নয়। আমার এই পক্ষপাতিত্বের জন্য কোন গোষ্ঠি যদি মনক্ষুন্ন হয় তাতে আমার কিছু করার নেই।

বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিষয়ে গাফ্ফার ভাই ছিলেন আপোষহীন। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এই দুটো বিষয়ে তাঁর কাছে ‘নিরপেক্ষ’ নামে কোন শব্দ ছিলো না। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক সমকালের জন্য এক সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়  বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধুর মত মহামানবের সান্নিধ্য আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া’। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় গাফফার চৌধুরীর। জানালেন, ১৯৪৯ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরুতে  বরিশাল বিএম কলেজে এই আন্দোলন উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম দেখা তাঁর। বললেন, রাষ্ট্র ভাষার বিপক্ষে প্রচারণা চালাতে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান (পরবর্তীতে জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী) গিয়েছিলেন বরিশাল। তার এই প্রচারণার জবাব দিতে পরবর্তীতে মাতৃভাষা আন্দোলনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানও যান সেখানে এবং বক্তব্য রাখেন বিএম কলেজের সমাবেশে। জানালেন, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ৭২ জাতী জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে। বললেন, ‘সম্মেলনস্থলের প্রবেশ পথে এসে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়েছিলেন  কিউবার নেতা ফিদেল ক্রাস্ট্রো ও ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ঐসময়ই ক্রাষ্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’। 

এ প্রসঙ্গ আলোচনার ফাঁকেই সদ্য প্রয়াত মেয়ে বিনিতাকে দিয়ে আলজিয়ার্সে তোলা বঙ্গবন্ধুর সাথের সেই ঐতিহাসিক ছবিটি আমাকে দেখান। ৭৩ সালে আলজিয়ার্স কনফারেন্সে তোলা ঐ গ্রুপ ছবিতে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন।

৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারীতে ‘আমার ভায়ের রক্ত রাঙানো..’ কবিতা লিখার মাধ্যমেই কিন্তু গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে প্রথম সম্পৃক্ত হননি। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। বরিশালে ঐ দিবস পালন করতে গিয়ে ৮ম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র গাফফার চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে ১দিন কারাবরণ করেন। আমার সাথে স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘জিন্নার ‘উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা..’ এমন ঘোষণার পর পরই মূলত সারা পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করলে, দিনটি পালন করতে গিয়ে একদিনের জন্য গ্রেফতার হয়েছিলাম’। 

৪৮ সালে একদিনের জন্য কারাবরণ করার পরও মাতৃভাষা আন্দোলনে আরও কারাবরণ করতে হয়েছে গাফ্ফার চৌধুরীকে। ১৯৫৫ সালেও তিনি আরেকবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। ঐসময় প্রায় এক মাস তাকে জেল খাটতে হয়। ঐবছর ২১ শে ফেব্রয়ারী উদযাপন করতে গিয়ে আন্দোলন সহকর্মী আবুল মাল আব্দুল মুহিত (সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থ মন্ত্রী) ও এম মোকাম্মেল হক (সাবেক সচিব)সহ ১৩৫জন ছাত্রকে দীর্ঘ একমাস কারাবরণ করতে হয়। গাফ্ফার চৌধুরী জানান একই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানও (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু) কারাগারে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিষয়েও গাফফার ভাইয়ের মধ্যে একটা দুর্বলতা ছিলো, এই দুর্বলতা বঙ্গবন্ধুর দুই এতিম কন্যা হিসেবে। তাদের নিরাপত্বা নিয়ে যেমন তিনি সদা উদ্বিগ্ন থাকতেন, ঠিক তেমনি অনিয়ম অসঙ্গতি দেখলে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হতেন না। এনিয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় তাঁর উপর অভিমানও করতেন বলে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন গাফ্ফার ভাই। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রতি এত লয়েল থাকার পরও মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করতেও তিনি পিছপা হননি। সাক্ষাতকার নেয়ার সময় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করলে বঙ্গবন্ধু কি আপনার উপর বিরক্ত হতেন না? বলেছিলেন, ‘মোটেই না। মুজিব ভাই এনিয়ে কখনও মনক্ষুন্ন হতেন না। লেখার সাথে একমত হতে না পারলে মাঝে মাঝে হেসে হেসে বলতেন গাফ্ফার, ‘’আমাকে নিয়ে ফাউল গেইম খেলার চেষ্টা করোনা’’।

গাফ্ফার ভাই’র সমালোচনায় যারা পঞ্চমূখ, যারা তাঁকে একটি গ্রুপের পক্ষের কলামিষ্ট বলে অভিযুক্ত করেন, তারাও কিন্ত উদগ্রীব থাকেন কখন গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা প্রকাশ হবে। তাদের অনেকেই কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে একটি ছবি তুলতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করেন। একটি বিষয়তো আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, গাফ্ফার চৌধুরী আর যাইহোক নিজ জনপ্রিয়তা বা তারকাখ্যাতি ব্যবহার করে কিন্তু নিজের আদর্শ কখনও বিক্রি করেননি। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন তো দেখেছি আজকের সময়ের অনেক ‘জনপ্রিয়’ ব্যক্তি নিজের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যুদ্ধাপরাধীদের অর্থের কাছে নিজের আদর্শ বিক্রী করেছেন। এক্ষেত্রে গাফ্ফার চৌধুরীতো ছিলেন অনেক উচ্চমূল্যে বিক্রী হওয়ার মত ‘পণ্য’। কিন্তু এই লোভতো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

লন্ডনে তাঁর  নিজ বাসায় নেয়া এক সাক্ষাতকারে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও আমার সাথে নিজের শৈশবেরও অনেক স্মৃতিচারণ করেছিলেন গাফ্ফার ভাই। 

১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর জন্ম তাঁর। শৈশব কেটেছে বরিশালের উলানিয়ায়। জানালেন, কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সাংবদিকতার শুরু। ৪৬ সালে পিতা হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯৪৭ সালে বাবার বন্ধু দুর্গা মোহন সেনের পরামর্শে তিনি যোগ দেন ‘বরিশাল হিতৈশী’তে। ‘বরিশাল হিতৈশী’ না ‘কংগ্রেস হিতৈশী’? এমন প্রশ্ন করলে অনেকটা হতাশা নিয়ে গাফ্ফার চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বয়সের কারনে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলেও কিছু কিছু ঘটনা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলা যায়না। বাবার মৃত্যুর পর ‘বরিশাল হিতৈশী’র মাধ্যমে সাংবাদিকতায় প্রবেশ আমার সেরকমই একটি স্মৃতিময় ঘটনা। আমি তখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র।’। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি এই পত্রিকাটির নাম ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেন, এমনটি জানালে তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা তাদের সঠিক ইতিহাস জানার শক্তি দিক, এমন প্রার্থনা করা ছাড়া এবিষয়ে আমার আর কিইবা করার আছে?’। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ফেইসবুকে তাঁর নামের একটি পেইজ থেকে তাঁর লেখা আপলোড হচ্ছে এমনটি শুনেছেন জানিয়ে আমাকে বললেন, ‘আমি নিজেই জানিনা এই পেইজ কে চালায় বা এডমিনই বা কে?। আমার লেখাগুলো আপলোড করছে ভালো কথা। কিন্তু কোন এক সময় যদি বিতর্কিত কিছু আপলোড করে আমার নামে চালিয়ে দেয়, এমন শঙ্কায়ও আছি।’

নিজের সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,  ‘দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি। উলানিয়া করনেশন মাধ্যমিক স্কুল ও বরিশাল একে ইন্সিটিউটে (আসমত আলী খান) লেখাপড়া শেষে ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজে এসে ভর্তি হই। ঐবছরই  ঢাকায় ‘দৈনিক ইনসাফ’ এর নিউজ বিভাগে যোগদান করি। পরবর্তীতে ৫১ সালে দৈনিক সংবাদ বের হলে ইনসাফ ছেড়ে তাতে যোগ দেই। দিনে কলেজ, রাতে সাংবাদিকতা এভাবেই ব্যস্থ থাকতাম তখন।’ সংবাদে থাকতেই ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন গাফ্ফার চৌধুরী।  ৫২ সাল পর্যন্ত সংবাদেই ছিলেন তিনি।

১৯৫০ সালেই তাঁর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। এ সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন ‍”দৈনিক ইনসাফ” পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার ভাই সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন ১শ’ টাকা। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এসময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে গাফফার ভাই দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং অণুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দু’বছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে’। ১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র করার তাঁর পরিকল্পনা সম্পর্কেও ঐসময় জানতে চেয়েছিলাম গাফ্ফার ভাইয়ের কাছে। বলেছিলেন, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডী’ তৈরী করার পর দর্শকদের ব্যাপক সাড়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মানে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। প্রাথমিক কিছু কাজও সেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম এমন একটি প্রজেক্টের বিশাল বাজেট সংগ্রহ করা আমার জন্য কঠিন। তাই সম্প্রতি সরকার যখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মানের উদ্যোগ নেয়, তখন আমি ঐ পরিকল্পনা থেকে সরে আসি।’

দেশ ছাড়ার কারন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গাফ্ফার ভাই আমাকে বলেছিলেন, ৭৫ এর ১৫ই আগষ্টে তিনি লন্ডনে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান তিনি। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। ৭৪ সালে অক্টোবরে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডন আসার পর ৯২ সাল পর্যন্ত আর দেশে যাননি গাফ্ফার ভাই। জানালেন, ৭৫ এর জুন মাসে শেষ দেশে গিয়েছিলেন, এরপর যান ১৯৯২ সালে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে তৎকালীন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা গৌস খানের নেতৃত্বে ব্রিটেনে প্রথম ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলেন তিনি।

ব্রিটেনে আসার পর প্রথম দিকে  বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেছেন গাফ্ফার ভাই। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন তিনি। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। 

বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিক্ষিত সমাজ থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষও তার লেখার ভক্ত। নিজেদের এলাকার সরকারী কর্মকর্তার দূর্নীতি, এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড, ইত্যাদি বিষয় তাঁর কলামে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকজন গাফ্ফার ভাইকে চিঠি লিখতো, এমন ২/১টি চিঠি আমি নিজেও দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী প্রবীন এ সাংবাদিকের লেখা তাঁর আদর্শিক শত্রুরাও নিয়মিত পড়ে।

কয়েক বছর আগে স্ত্রী সেলিমা আফরোজ লোকান্তরিত হওয়ার পর শারিরীকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও মানষিকভাবে অনেক শক্ত ছিলেন গাফ্ফার ভাই। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা স্ত্রীকে নিয়ে দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি অনেক কষ্টে কাটিয়েছেন বিশাল মানবিক হৃদয়ের এই মানুষটি। এমন ত্যাগ এ সমাজে ক’জনই বা করতে পারে? জীবনের সর্ব শেষ সময়ে এসে সেই প্রিয় মেয়ে বিনিতাও চীরতরে চলে যায় তাঁকে ছেড়ে, যে মেয়েটি অসুস্থ মা-বাবাকে দেখবে বলে জীবনে ঘর সংসারই করেনি। চলৎশক্তিহীন হয়ে বাসাবন্দী হওয়ার পর বিনিতাই ছিলেন আমাদের সাথে গাফ্ফার ভাইয়ের যোগাযোগের মাধ্যম। প্রয়োজনে ফোন করে, ‘চাচা, আব্বা কথা বলবেন’ বলে বাবার সংযোগ সৃষ্টি করে দিতেন আমাদের সাথে। মাঝে মাঝে কথা বলিয়ে দিতেন স্যোসাল সার্ভিস নিয়োজিত গাফ্ফার ভাইয়ের কেয়ারার ঝর্না আপা।

গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে একটি মহল বারবারই বিতর্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছে। কোন সময় তাঁকে নাস্তিক আখ্যা দেয়া, কোন সময় নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের মানুষকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলা এধরনের অপচেষ্টা বারবারই করেছে অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ঐ মহলটি। এই মানুষটি তাদের ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে জনগনকে সচেতন করতে চান, সাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র গঠনে তাদের চলমান প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জনগনকে সচেতন করতে চান, এটিই তাদের ক্ষোভের কারন। সর্বশেষ মৃত্যুর পরও গাফ্ফার ভাইয়ের চরিত্র হননে এরা ক্ষান্ত দেয়নি। মরদেহ সমাহিত হওয়ার আগেই আবার শুরু করেছে তার ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে অপপ্রচার। এই অপশক্তির অপপ্রচারের বিপরিতে সদ্য প্রয়াত এই মানুষটিকে ধার্মিক প্রমান করতেও যখন দেখি আমাদের বন্ধুরা মাটে নামেন, তখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। যার মেধা ও মননশীলতার উজ্জলতায় আলোকিত হয়েছে বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ, তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেয়াতো দুরের কথা, মৃত্যুর পর তার মরদেহ সমাহিত করার আগেই তাঁর মানবিকতা বা মেধা নয়, তিনি আস্তিক না নাস্তিক ছিলেন তা প্রমানে আমরা মাটে নেমেছি।

কাউকে আস্থিক বা ধর্ম বিশ্বাসি প্রমান করার জন্য ভন্ড ধার্মিকদের কাছে সার্টিফিকেট উপস্থাপনের কি কোন প্রয়োজন আছে? বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সিংহ পুরুষ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে কতিপয় ভন্ড ধার্মিক ও ধর্ম ব্যবসায়ীর সাম্প্রতিক নোংরা অপপ্রচারের বিপরিতে গাফফার চৌধুরীর হজ্ব পালনকালীন পবিত্র কাবা শরিফে উপস্থিতির ছবি দিয়ে তাঁকে ধর্ম বিশ্বাসী প্রমানের চেষ্টা দেখে এই প্রশ্নটিই মনে বার বার উকি দিচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষসহ প্রাণী জগত। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী হওয়ার স্বাধীনতাও তিনি মানুষকে দিয়েছেন। শেষ বিচারে মানুষের আমল নামা পর্যালোচনা করে তাদের পুরস্কৃত বা শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার তিনি রেখেছেন নিজের হাতে। অথচ ধর্মান্ধরা ন্যায় অন্যায় বিচারের সৃষ্টিকর্তার এই এখতিয়ার ছিনিয়ে নিতে চায়। অমুক নাস্তিক, অমুক বিধর্মী এদের কতল করো এমন উন্মাদনা কি প্রমান করে না যে এরা আল্লাহর বিচারের ক্ষমতার উপর আস্থা রাখতে পারছে না। যারা আল্লাহর ক্ষমতায় আস্থা রাখতে পারেনা, তারা নিজেরা আর মুসলমান থাকে কিভাবে? এরাইতো সকল আগে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। আর এই অবিশ্বাসীদের কাছে গাফ্ফার চৌধুরীর মতো আল্লাহর সৃষ্টি একজন ক্ষনজন্মা মেধাবী মানুষকে ধর্ম বিশ্বাসী প্রমান করার জন্য আমরা যারা হজ্ব পালনের ছবি উপস্থাপন করছি, তারা কি এটি টিক করছি। আমি জানি গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই আবেগি হয়ে এটি আমরা করছি। কিন্তু এটি যে গাফফার ভাইয়ের জন্য কতবড় অসম্মানের এটি কি আমরা ভেবে দেখেছি?

দলীয় হাই কমান্ডের নজরে আসা বা সরকারী চাকুরীতে আরও বেশি সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে মৃত্যুর পর নামাজে জানাজা ও শহীদ মিনারে বাঙালির ইতিহাসের অংশ গাফফার চৌধুরীর মরদেহ ঘীরে ব্যক্তি প্রচারের যে উলঙ্গ আস্ফালন দেখেছি, তাতে মানষিকভাবে হয়েছি আহত। জীবিত থাকাকালীন গাফফার চৌধুরীর দুর্দিন দুঃসময়ে যারা সামান্য খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, তাঁরাই যখন মৃত গাফফার চৌধুরীকে নিজেদের ব্যক্তি প্রোফাইল বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবহার করতে মরিয়া উঠেন, তখন অভিমান করে বলতে ইচ্ছে করে এই সমাজে গাফফার চৌধুরীর মতো মানুষের জন্ম না নেয়াই ভালো।

সরি গাফফার ভাই, আপনি শুধু আমাদের দিয়েই গেলেন, বিনিময়ে জীবিত থাকতেতো দুরের কথা, মৃত্যুর পরও প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিতে পারলাম না আপনাকে। ক্ষমা করবেন আমাদের।

লেখক: সাংবাদিক, সত্যবাণীর সম্পাদক

 

You might also like