একাত্তর বন্ধু সায়মন ড্রিং এর জীবনাবসান

নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী

লন্ডন: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু, খ্যাতিমান ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং আর নেই।

গত শুক্রবার রুমানিয়ার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে নিশ্চিত করেছেন প্রয়াত মি. ড্রিং এর আত্মীয়, ফ্রান্সে বসবাসরত ক্রিস বার্লাস। তিনি জানান, কিছুদিন ধরে সাইমন হার্নিয়ার সমস্যায় ভুগছিলেন, সে কারণেই রোমানিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেখানে অস্ত্রোপচারের সময় তার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তাররা তাকে আর বাঁচাতে পারেননি। তবে গত শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হলেও এবং বি বি সি কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেলি তা জানলেও মৃত্যু খবর প্রকাশ হতে কেন ৫দিন বিলম্ব হলো সে বিষয়ে কোন তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মৃত্যুকালে সায়মন ড্রিংয়ের বয়স হয়েছিলো ৭৬ বছর। ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারী জন্মেছিলেন এই কিংবদন্তী সাংবাদিক। মৃত্যুকালে তিনি তাঁর পার্টনার এবং দুই সন্তান আবা ও ইন্ডিয়াকে রেখে গেছেন।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালী গণহত্যার  খবর বিবিসি’র মাধ্যমে সর্ব প্রথম বিশ্বেরবাসীর কাছে পৌছে দিয়েছিলেন  সাংবাদিক সায়মন ড্রিং।

সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের জনগনের কাছে হিরো। তিনি একমাত্র সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের ভয়াবহতা এবং নৃশংসতা শুরু থেকেই কভার করেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতে মার্ক টালি যেমন, সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের কাছে ছিলেন সেরকমই একজন।

ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ছিলেন অকুতোভয় এবং মেধাবী সাংবাদিক। গুণী এ সাংবাদিক বিশ্বের সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিবিসি, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্টে কাজ করেছেন। সাফল্যর স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন।  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার-১৯৭১।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ তুলে ধরেন বিশ্ব দরবারে। তিনি বিশ্বকে জানান কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, অবিচার করছে এবং নির্বিচারে গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ঢাকা আসেন সাইমন ড্রিং। তবে ১৯৬৮ সালে তার ঢাকায় আসার একটি খবরও রয়েছে। তিনি সে সময় কেন এসেছিলেন তা অজানা। দ্বিতীয় দফায় ঢাকায় আসার পরদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার সুযোগ হয় তার। মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়ে পুরো ভাষণ শুনেছিলেন সাইমন। এরপর ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করছিলেন। এভাবেই পাড় হয়ে যায় দুই সপ্তাহ। এসে যায় ২৫ মার্চ। তিনি জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতা ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করছেন।  পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে সাইমন ধারণা করেন ঢাকায় ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিদেশি সকল সাংবাদিকদের একসঙ্গে করে রাখা হয় ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাদের গার্ড দেয় পাকিস্তানের মিলিটারি বাহিনী। তার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এরই মধ্যে উপস্থিত সকল সাংবাদিক জানতে পারেন ঢাকায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্তানের সৈন্যরা। রাতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী নিরাপত্তার অজুহাতে সকল বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিজ ইচ্ছায় বাংলাদেশে থেকে যান সাইমন। কীভাবে? হোটেলে বাঙালি কর্মচারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে হোটেলেই লুকিয়ে পড়েন সাইমন। ৩২ ঘণ্টা সময় কাটান হোটেলের লবি, ছাদ, বার এবং কিচেনে। বাঙালি হোটেল বয়ের সাহায্যে হোটেল ছেড়ে বের হয়ে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (আগে নাম ছিল ইকবাল হক) যান সাইমন। সেখানে গিয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়ের মুখোমুখি হন তিনি। ছাত্রদের মৃতদেহ পুড়ছিল, অনেক মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। চারুকলা গিয়ে জানতে পারেন সেখানেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে চিত্র এবং তথ্য জোগাড় করতে থাকেন সাইমন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখেন পাকিস্তানি সেনারা পতাকা উড়িয়ে রেখেছে এবং শত শত মৃহদেহ ট্রাকে তুলে নিচ্ছে। একদিন পর ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। উলঙ্গ করে চেক করা হয় সাথে কী নিয়ে যাচ্ছেন! তার ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান গেলে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন না। তাই ব্যাংকক চলে যাওয়া স্থির করেন। ব্যাংকক থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠান ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’শিরোনামে। ৩০ মার্চ তা প্রকাশিত হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বহির্বিশ্বে প্রচারিত প্রথম সংবাদ। এই খবরটি ছাপা হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিদেশীদের টনক নড়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরে অবশিষ্ট আর কিছু নেই।’ তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের একটি চিত্র সবার সামনে উঠে আসে এবং এরপরই পাকিস্তানকে চাপ দিতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তার সাহসী ভূমিকায় পুরো বাংলাদেশ আজও তার কাছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন সাইমন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী তার সঙ্গে আবার দেখা করেন। তিনি জানতে চান, ২৫ মার্চ রাতে যদি তাকে পেত তাহলে কী করা হতো? সালেক সিদ্দিকী জানান, ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হতো। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকা ফিরে আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেদিন তার জন্মদিন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কেক কেটে জন্মদিন উদযাপনের ব্যবস্থা করেন।

 

 

You might also like