জে আর সি ছিলেন একজন ক্রীড়া উৎসাহীও
উদয় শঙ্কর দাশ
গত মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে আমার ছোটবেলার বন্ধু প্রদীপ দত্ত জানালো জামিল ভাই (জে আর সি) আর নেই। ভোর বেলা ঘুমের মধ্যেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। খবরটা পেয়েই মুষড়ে পড়েছিলাম। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের স্থপতি ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। বিশেষ এক সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। বহু-মেধার এই ব্যক্তিত্বের অভাব কি পূরণ করা সম্ভব হবে? এই প্রশ্নটাই বারবার নিজেকে করছিলাম। খারাপ লাগছিলো এটা ভেবে যে সবসময় হাসিভরা এই লোকটাকে আর কোনোদিন দেখবো না।
তবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল যে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাঁর প্রতি আমার এই শ্রদ্ধাঞ্জলিতে, তাঁর এক বিশেষ আগ্রহ ও উৎসাহের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো, যা অনেকেরই হয়তো অজানা। জামিল ভাই আহসানউল্লাহ প্রকৌশলী কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে সিভিল ইঞ্জিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। আমার ছোটকাকা, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ক্রীড়া ভাষ্যকার নিখিল রঞ্জন দাশ একই কলেজ থেকে মিকানিক্যাল ইঞ্জিয়ারিং-এ পাশ করেন সেই বছরেই। আমার মনে আছে, আহসানউল্লাহ প্রকৌশলী কলেজ ক্রিকেট দল চট্টগ্রাম কলেজের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলতে চট্টগ্রাম এসেছিল। সেই দলের আধিনায়ক ছিলেন আব্দুল আহাদ (আমি আহাদ আঙ্কেল ডাকি), আমার কাকাও ছিলেন সেই দলে। বন্ধু জামিলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্দুল আহাদ বলছিলেন, ‘জামিলের খেলাধূলার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল, সে ছিল একজন ভালো-বাঁ-হাতি স্পিনার’। আহাদ আঙ্কেল এবং নিখিল কাকা দুজনই বলেন, তাঁদের বন্ধু জামিল খুব ভালো টেবিল টেনিস খেলতেন।
আর টেবিল টেনিস খেলার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমাদের ছাত্রকালে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হত। আমি ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের টেবিল টেনিস দলের কনিষ্ঠতম সদস্য। মনে আছে, ১৯৭০ সালে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা হয়েছিল বুয়েট-এ। স্থাপত্য বিভাগের কমন রুমে আমরা প্র্যাক্টিস করতাম। জামিল স্যার আসতেন আমাদের প্র্যাক্টিস দেখতে, মাঝেমাঝে খেলতেনও আমাদের সঙ্গে। কেমন ক’রে যেন তাঁর সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জামিল স্যার হয়ে গেলেন জামিল ভাই। তাঁর ছোটো ভাই মাহবুব ছিল বুয়েট দলের সদস্য। বুয়েটের সঙ্গেই ছিল আমাদের বিশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বাংলাদেশ ওপেন টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা। এর আয়োজনে জামিল ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। খেলা হয় বুয়েট-এ। চট্টগ্রাম থেকে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম খেলতে। পুরুষদের সিঙ্গলসে আমি (একজন অ-বাছাই খেলোয়াড়) পৌঁছে গিয়েছিলাম ফাইনালে। প্রতিপক্ষ বুয়েটের চ্যাম্পিয়ন নাসিরুদ্দিন (আলিম নামে পরিচিত)। প্রধান অতিথি ছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।আমি প্রথম দু’টো গেইম জিতি, চ্যাম্পিয়ন হতে বাকী তিনটি গেইমের একটি জিততে হবে। তখন হঠাৎ আলিমের পক্ষে শুরু হল দর্শকদের শ্লোগান। সেটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে বেশ অবমাননাকর শ্লোগানও। জামিল ভাই বেশ অশ্বস্তি বোধ করছিলেন, কয়েকবার দর্শকদের শান্ত করারও চেষ্টা করেন তিনি। আমি পরপর তিনটা গেইম হারলাম, আলিম হল চ্যাম্পিয়ন। মনে আছে, জামিল ভাই আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন ভালো খেলার জন্য, বলেছিলেন আমি যেন হতাশ না হই। তারপর বললেন, ‘আগামী বছরটা হবে তোমার’।
জামিল ভাইয়ের কথা সত্যি হল পরের বছর। পুরুষদের সিঙ্গলসে সেমি-ফাইনালে হেরে গেলেও, চট্টগ্রামের একজন জেষ্ঠ খেলোয়াড় স্বপন দাশের সঙ্গে জুটি বেঁধে পুরুষদের ডাবলস শিরোপা জিতেছিলাম। জামিল ভাই যথারীতি আমাকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে এলে আমি তাঁকে তাঁর আগের বছরে দেওয়া উৎসাহের কথা মনে করিয়ে দিলাম।
অনেক বছর জামিল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। শেষ দেখা, বছর কয়েক আগে চট্টগ্রামে। এসেছিলেন রোটারী ইন্টান্যাশনেলের একটি কনফারেন্সে অতিথি বক্তা হয়ে। তাঁকে অভিবাদন জানাতেই বলে উঠলেন,’কেমন আছো উদয়? কত বছর তোমাকে দেখিনি!’ তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। কারো চেহারা বা নাম তিনি ভুলতেননা।
জামিলুর রেজা চৌধুরীর মত বিরল একজন লোক পেয়ে বাংলাদেশ ধন্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কৃতজ্ঞতাভরে মনে রাখবে দেশ।
তাঁর চলে যাওয়ায় যে শুন্যতা তৈরী হল তা কি পূরণ হবে? বাংলাদেশ কি আরেকজন জে আর সি পাবে?
জামিল ভাই আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আপনার সঙ্গ আমাদের নিঃসন্দেহে ঋদ্ধ করেছে। সেই ঋণ শোধ করা যাবে না।
উদয় শঙ্কর দাশ: বিবিসি বাংলার প্রাক্তন সাংবাদিক, ক্রীড়া সমালোচক ও সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।