ড. রফিকুল ইসলাম: শেষ পর্যন্ত পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলেন অভিমানী মানুষটি
সৈয়দ আনাস পাশা
হঠাৎ করে মোবাইল ফোন বেজে ওঠায় স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম বুলগেরিয়ার নং। ফোন রিসিভ করলে বেশ কয়েক সেকেন্ড শুধুই একজন মেয়ে মানুষের কান্না। কান্না একটু কমে আসলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি মি: পাশা?’ হা সূচক জবাব দিলে বললেন, ‘আমি বুলগেরিয়া থেকে ড. রফিকুল ইসলামের স্ত্রী বলছি। ড. রফিক আজ কিছুক্ষন আগে (৭ই জানিয়ারী, লন্ডন সময় সন্ধ্যা ৭টা) বুলগেরিয়ার একটি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন।’ খবরটি দিয়েই ভদ্রমহিলা কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘রফিকের ডায়রী থেকে তুমার নং নিয়ে ফোনটি করলাম এই কারনে যে, তুমি তাঁর মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশ করলে বাংলাদেশে তাঁর আত্মীয় স্বজন খবরটি জানতে পারবে।’
ড. খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, বুলগেরিয়ার সোফিয়া ন্যাশনাল হার্ট হসপিটালের কার্ডিও থরাসিস সার্জন (CARDIO_THORACIC SURGEON) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর দেয়া তথ্য মতে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৭ বছর।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের সন্তান ড. ইসলামের সাথে আমার ক্ষনিকের পরিচয় ২০১৬ সালে সোফিয়ায়।গ্লোবাল ওমেন্স লিডারস ফোরাম কনফারেন্সের নিউজ কাভার করতে সোফিয়ায় গেলে সেখানেই পরিচয় হয় ড. রফিকের সাথে। কনফারেন্সের অন্যতম আকর্ষন ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
তাঁর প্রিয় ‘বাপু’ বঙ্গবন্ধুর মেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোফিয়া আসছেন স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে আগেই এই খবর পেয়েছিলেন ড. ইসলাম। খবর শোনার পর থেকেই শেখ হাসিনাকে দেখবেন, কথা বলবেন এমন একটি আশা উকি দিচ্ছিলো মনের গহীনে। বুলগেরিয়ান স্ত্রী কষ্টাডিনকা পেনকভা ইভানোভাও বারবার উৎসাহিত করছিলেন শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার জন্যে। কিন্তু কিভাবে? বুলগেরিয়ায় বাংলাদেশের কোন দূতাবাস নেই, কিভাবে যে দেখা করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না খোন্দকার ইসলাম। স্ত্রী পরামর্শ দিলেন, যেহেতু বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক হবে বঙ্গবন্ধু কন্যার, সেহেতু রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ভবনের সামনে গিয়ে দাড়ালে হয়তো দেখা হতে পারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কারো সাথে, এ থেকেই হয়তো সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার। ১৮ই মে’ ২০১৬ গ্লোবাল ওমেন্স লিডারস ফোরাম কনফারেন্সে যোগ দেয়ার আগে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি রোসেন প্লেভনেলিয়েবের সাথে বৈঠক করছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় ভবনের বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীদের ২/১জন। এদের সঙ্গে যখন বাংলায় কথা বলছিলাম, তখনই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন আপনি কি বাঙালি? পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক, সাথে এক তরুণ। তরুণ আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, আপনিতো সাংবাদিক? আপনার রিপোর্ট আমি পড়েছি, লন্ডন ভিত্তিক বাংলা টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আপনাকে প্রায় দেখি। তরুণই পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনি ড. খোন্দকার রফিকুল ইসলাম। বুলগেরিয়ায় আমাদের অভিভাবক, নামকরা হার্ট স্পেশিয়ালিষ্ট। এভাবেই পরিচয় ড. ইসলামের সাথে। রাষ্ট্রপতি ভবণ থেকে গ্লোবাল ওমেন্স লিডারস ফোরাম কনফারেন্সেও ড. ইসলাম গেলেন আমাদের সাথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষেও আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না তিনি। দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা জানতে তার যে বড়ই আগ্রহ।
১৯৭৪ সালে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া প্লেন টিকেট দিয়ে স্কলারশীপ নিয়ে খোন্দকার ইসলাম এসেছিলেন রোমানিয়ায়। আর ফিরে যাননি দেশে। দেশ ছাড়ার মাত্র একবছরের মধ্যেই ঘাতকরা যে তাঁর ‘বাপু’ কে ছিনিয়ে নেবে এটি কখনও ভাবতেই পারেননি বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় বসবাসরত সোফিয়া ন্যাশনাল হার্ট হসপিটালের কার্ডিও থরাসিস সার্জন (CARDIO_THORACIC SURGEON) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম। যে দেশ ঘাতকের হাত থেকে তাঁর জন্মদাতাকে রক্ষা করতে পারেনা, সেই দেশের প্রতি প্রচন্ড অভিমানী হয়ে ওঠেন তিনি। যেখানে তাঁর বাপু নেই, সেখানে গিয়েই বা আর কি করবেন। না, শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ-দু:খে আর দেশেই যাননি ড. ইসলাম। আর তাইতো তাঁর ভাষায় কথা বলা একজন সংবাদকর্মী আমার কাছ থেকে ঐসময় খুটিয়ে খুটিয়ে নিচ্ছিলেন দেশের খবর, দীর্ঘ ৪২ বছর দেশ ছাড়া খোন্দকার ইসলাম। খবর নেয়ার পাশাপাশি নষ্টালজিয়া জগতে ঢুকে বারবার খুজে ফিরছিলেন তাঁর সেই ফেলে আসা স্মৃতি বিজরিত শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। শেখ জামালের সহপাঠি ড. খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে ‘বাপু’ বলে ডাকতেন। জামালের সাথে ৩২ নাম্বারে সব সময়ই ছিলো তাঁর আনাগোনা।
দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা মনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাগব করতে আমার কাছে খোলা মনে তা শেয়ার করছিলেন। বললেন, ‘আমি আপার সাথে দেখা করবোই এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজ থেকে ৩দিনের ছুটি নিয়েছি। কনফারেন্স রিসিপশন ডেস্কে আমার পরিচয় দিয়ে একটি চিঠিও রেখে এসেছি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যে। শেষ পর্যন্ত আপনাদের মাধ্যমে তাঁকে দেখলাম। এখন সামনা সামনি কথা বলতে চাই। ড. ইসলামের চোখ ভিজা আকুতি দেখে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্বা প্রধানকে অনুরোধ করলাম কোনভাবে ড.ইসলামকে কথা বলিয়ে দেয়া যায় কিনা। তিনি কথা দিলেন, হোটেলে নিয়ে আসলে ব্যবস্থা একটা করবেন। কনফারেন্স সেন্টার থেকে ড. ইসলাম প্রধানমন্ত্রী’র হোটেলে চললেন আমাদের সাথে। তাঁর কথার ঝুড়ি যেন আর শেষ হতে চায়না। বঙ্গবন্ধু, সহপাঠি শেখ জামালসহ দেশের বিভিন্ন স্মৃতি রুমন্থন করতে গিয়ে বারবারই তার চোখ ভিজে আসছিলো। হোটেলে এসে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সাইফুজ্জামান শেখরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। অবশেষে পরদিন বুলগেরিয়া প্রবাসী কয়েকজনের সাথে ড. রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী কষ্টাডিনকাকেও প্রধানমন্ত্রী দর্শনের সুযোগ করে দিলেন সাইফুজ্জামান শেখর। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে এসে দারুন তৃপ্ত ড. ইসলাম। বললেন, দীর্ঘ ৪২ বছর পর যেন বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম, পরশ পেলাম আমার সহপাটি জামালের। এবার বাংলাদেশে যাবেন কিনা, এমন প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন, বঙ্গবন্ধু খুনি কজন এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের দন্ড কার্যকর হওয়ার পরই দেশে যেতে চাই। অবশ্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেখার পর এই মুহূর্তেই দেশে যাওয়ার ইচ্ছে করছে, এমনটাও জানালেন খোন্দকার রফিকুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সময় স্মরণ করতে গিয়ে টাঙ্গাইলের সন্তান ড. ইসলাম বলেছিলেন, ৬৯ সালে প্রথম দেখি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৭০ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর টাঙ্গাইল থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলে শেখ জামালকে পাই সহপাঠি হিসেবে। আমরা একই ক্লাশের হলেও ভিন্ন সেকশনে ছিলাম। তখনও তাঁর সাথে পরিচয় হয়নি। একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমন শুরু হলে চলে যাই নিজ এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সান্নিধ্য পাই কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিকীর। সান্নিধ্য থেকে ঘনিষ্টতা। যুদ্ধ শেষে কাদের সিদ্দিকীর জিপে চড়ে ঢাকা থেকে একদিন আসেন শেখ জামাল। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে কাদের সিদ্দিকী জামালকে বললেন এ আমাদের বন্ধু রফিক। এরপর থেকেই জামালের সাথে ঘনিষ্টতা। দুজন একই কলেজে একই ক্লাশে পড়ি, দেখা হয়। ৬৯ এ মধুপুরে প্রথম দেখার পর আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাথে। টাঙ্গাইলেও এসেছেন দুবার। প্রথম কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পনের সময় ও দ্বিতীয় বার ময়মনসিংহ থেকে সন্ধ্যা বেলায় হেলিকপ্টারে করে নতুন সার্কিট হাউসে এসে করেন রাত্রিযাপন। তাকে দেখি, কিন্তু তখনও পরিচয় হয়নি। সময় তাঁর নিজ গতিতেই চলে, প্রকৃতির ধারাকে ধারণ করেই যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে আসি ছাত্রজীবনে। একদিন কলেজের করিডোর দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় শেখ জামালকে বললাম তোর বাবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিবি? জামাল বললো বাবার সাথেতো তোর পরিচয় আছে। টাঙাইল স্টেডিয়ামের সমাবেশে তুইতো মঞ্চে গিয়ে বাবার গলায় নৌকা মার্কা রূপার মালা পড়িয়ে দিয়েছেলি, আমরা টেলিভিশনে তা দেখেছি। আমি বললাম, এটি ঠিক আছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিতি হতে চাই। একটু ইতস্থত করে বললো, ঠিক আছে শনিবার দিন সকালে আসবি। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায়ই আমি ৩২ নং এ গিয়ে হাজির। দোতলা থেকে আমাকে দেখে জামাল নিচে নেমে আসে। ভেতরে নিয়ে গেলো আমাকে। দেখি ছোট্র একটি রুমে বঙ্গবন্ধু বসে আলাপ করছেন আরও কয়জনের সাথে। জামালকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সে বললো বাবা ও আমাদের ঢাকা কলেজের ছাত্র রফিক, তোমার সাথে পরিচিত হতে চায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে বসতে বললেন। আমাকে রেখেই জামাল চলে গেলো। ড. রফিক বলেন, ‘এভাবেই মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু’র সাথে আমার পরিচয়’। তিনি বলেন, এরপর প্রতিমাসেই যেতাম তাঁর কাছে। একদিন ভয় সংকোচ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনার কাছে আমার একটি আবদার আছে। জানতে চাইলেন কি আবদার। বললাম আমি আপনার পাশে বসে মানুষের কথা শুনতে চাই। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন কেন? বললাম, মানুষকে জানতে হলে তাদের সংষ্পর্শে আসার প্রয়োজন আছে। নেতার কাছে এসে তাদের চাওয়া, আবদার, অভাব অভিযোগ বলার ধরণ ইত্যাদি জানতে চাই। মাথায় হাত রেখে হেসে বললেন, ‘মনস্তাত্তিক হতে চাস? আরেকদিন এসে আমার কাছ থেকে চুপচাপ শুনে যাবি মানুষের গল্প’।
সহপাঠি শেখ জামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠেন ড. রফিকুল ইসলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর মনের মধ্যে জমে থাকা এই স্মৃতিগুলো শেয়ার করারও কোন সুযোগ পাইনি। শেখ জামাল নরম স্বভাবের অহংকারহীন একটি ছেলে ছিলো, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, দর্প, হিংসা বা কাউকে আঘাত দিয়ে কখনও কথা বলতে শুনিনি তাকে। আমরা অনেক সময় তাকে টিপ্পনী কেটে কথা বলতাম, কিন্তু রাগ করতো না। বলতো, ‘বল বল এখনতো তোদেরই সময়’। খোন্দকার ইসলামের স্মৃতিরুমন্থন- ‘প্রতি মাসে বৃত্তির টাকা পেয়ে চলে যেতাম গুলিস্তানে বেবি আইসক্রিম অথবা চায়নিজ বা রমনা পার্কের লেকের চা স্টলে চা খেতে। ধানমন্ডির লেকের পাশে বসে কত যে সময় কাটিয়েছি জামালের সাথে তাঁর কোন হিসেব নেই।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছেলে বলে তাঁর কোন বড়াই ছিলোনা। বলতো, ‘আমি নিজ পরিচয়ে দাড়াতে চাই, আগে আমাকে মানুষ হতে দে’। ড.রফিক জানান, ১৯৭৪ সালে যখন সরকারী বৃত্তির জন্য আবেদন করেন, তখন শেখ জামাল নাকি তাকে বলেছিলেন, ‘বৃত্তি নিয়ে বিদেশ চলে যা। এখানে স্বাধীন দেশের ছাত্রছাত্রীরা হরতাল ধর্মঘট করে, আমাদের ধর্মঘট নয় শিক্ষার প্রয়োজন’। বঙ্গবন্ধু বিমান ভাড়া না দিলে পড়াশোনার জন্যে বিদেশ আসা হয়তো সম্ভব হতো না এমন মন্তব্য করে খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, সেই কাহিনীও শেয়ার করেন আমার সাথে। তিনি জানান, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রোমানিয়া, তিনটি দেশ থেকে একসাথে বৃত্তির অফার পেলে কোন দেশে যাবেন তা স্থির করতে পারছিলেন না তিনি। শেখ জামালের পরামর্শ চাইলে জামালই তাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে বলে। ড. ইসলাম বলেন, ‘সব ডকুমেন্ট দাখিল করার পর শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে বলা হলো বিমান ভাড়া বৃত্তি প্রাপ্তদের নিজেদেরই যোগার করতে হবে। কোথা থেকে জোগার করি বিমান ভাড়া, এই চিন্তায় যখন অস্থির, তখন জামাল বললো চিন্তা করিসনা, শিক্ষা মন্ত্রনালয় যদি ভাড়া না দেয় তবে ভাড়া আদায় করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। তোরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যা। জামালের কথা শুনে আমরা যারা বৃত্তি পেয়েছিলাম তারা মিলিত হলাম, তাদের বললাম চল বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। তারা আমার কথায় আস্থা আনতে পারলো না। দুজন রাজি হলো আমার প্রস্তাবে। আমরা গেলাম ৩২ নং এ। ‘বাসার সেই ছোট্র রুমে গিয়ে জানালাম আমাদের সমস্যার কথা। বললেন, ‘কেন দেবেনা বিমান টিকেট’। পরদিন সকালে তাঁর অফিসে আসার পরামর্শ দিয়ে আমাদের বিদায় করলেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় তারা তিনজনই হাজির হলেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে, এমনটি জানিয়ে ড. ইসলাম বললেন, পিএম এর একান্ত সচিব আমাদের বসালেন তার রুমে। কিছুক্ষন পর বঙ্গবন্ধুর রুম থেকে আমাদের ডাক পড়লো। রুমে ঢুকে দেখি মন্ত্রী ইউসুফ আলী ও শিক্ষা সচিব বসে আছেন বঙ্গবন্ধুর সামনে। কিছুক্ষন তাদের সাথে কথা বলে আবারও আমাদের সচিবের রুমে অপেক্ষা করতে বলা হলো। এরপর প্রায় আধাঘন্টা পর আমাদের ডেকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর একান্ত সচিবকে বললেন ১৫ হাজার টাকার একটি চেক রেডি করতে’। ৫ হাজার করে তিনজনের হাতে তিনটি চেক ধরিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের বললেন আর দেরি করোনা, এখনই গিয়ে টিকেট বুকিং দাও, স্মৃতিচারণে এমনটিই জানালেন খোন্দকার ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দেশ ছাড়ার আগে তাঁর সাথে দেখা করে যাওয়ার কথাও আমাকে বললেন বঙ্গবন্ধু’। জাতীর জনকের সাথে তাঁর শেষ দেখার কথা স্মরণ করতে গিয়ে অশ্রুসজল খোন্দকার ইসলাম জানান, ২৩ নভেম্বর ১৯৭৪, বিমান টিকেট হাতে নিয়ে তারা তিনজন বঙ্গবন্ধুর অফিসে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘এটিই ছিলো আমাদের শেষ দেখা। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন ভালো থাকিস, মন দিয়ে লেখাপড়া করিস। দেশে আসলে অবশ্যই আমার খবর নিস। আমার দুই বন্ধুকে বললেন রফিককে দেখে রাখিস’।
বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কখন কিভাবে পেলেন? এমনটি জানতে চাইলে খোন্দকার রফিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, তিনি তখন রোমানিয়ার অংশ মালডোভায় বসবাস করতেন। ১৮ই আগষ্ট’১৯৭৫, দুপুরের খাবার শেষে ছাত্রাবাসে ফিরলে সেই হৃদয়বিদারক খবরটি পান তিনি। তিনি বলেন, ‘ছাত্রাবাসে ফিরে দেখি আমার জন্যে একজন লোক অপেক্ষা করছেন। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ডাইরেক্টর, আদ্রিয়ান পেয়নেস্কো (Adrian Paynescu) যিনি বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের দেখাশোনা করতেন, তিনি আমাকে জানালেন বাঙালির ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক খবরটি। জানালেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই।’ ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষোভ, দু:খে হতবাক হয়ে বসে থাকি দীর্ঘক্ষন। সপ্তাহখানেক ঘর থেকে বের হইনি। আমার রুমমেট কঙ্গোর একটি ছেলে এই একসপ্তাহ আমার দেখাশোনা করে। ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক হয়ে যখন খোজ খবর নিলাম, তখনই জানতে পারলাম পুরো পরিবার নয়, বিদেশে থাকায় ঘাতকের বুলেট থেকে রক্ষা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।’ ড. ইসলাম বলেন, ‘কত অকৃতজ্ঞ আমরা। জাতির জন্মদাতাকে আমরা হত্যা করে ফেললাম, অথবা তাকে ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলামনা।’ নিজের দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি অভিমানী হয়ে ওঠেন ড. ইসলাম। বলেন, ‘না জাতির পিতার ঘাতকের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই দেশে আর যাবোনা, এমনই সিদ্ধান্ত নিলাম।’ তিনি বলেন, ‘এখনও প্রায় রাতেই বঙ্গবন্ধু ও শেখ জামালকে মনেকরে কেঁদে উঠি’। শেখ জামাল সর্বশেষ ব্রিটেন থেকে তাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এমনটি জানিয়ে অশ্রুসজল ড. ইসলাম বলেন, ‘এটিই তাঁর সাথে আমার শেষ যোগাযোগ’। খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যদিয়ে হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিলো সেই ক্ষত দিয়ে এখনও রক্ত ঝড়ে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে জাতীর জনকের সোনার বাংলা কিভাবে বিপরিত দিকে হাটছিলো দুর প্রবাস থেকেও তা দেখেছি। ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র সমালোচক হওয়ায় স্থানীয় বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনুষ্ঠানগুলোতে নিষিদ্ধও হয়েছি আমি। এক পর্যায়ে নবায়ন করতে দেয়া আমার পাসপোর্টও আটকে দেয়া হয়। এরপরও প্রতিজ্ঞা করেছি না, ঘাতকদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত যাবোনা আর এই অভিশপ্ত দেশে।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে আশায় বুক বেধেছিলেন এমনটি জানিয়ে খোন্দকার ইসলাম বলেন, ‘এই আশা বিফল হয়নি। ঘাতকদের বিচার হয়েছে, হয়েছে শাস্তিও। কিন্তু এখনও বেশ কয়জন ঘাতক পালিয়ে বেড়াচ্ছে এটি যখন মনে হয়, তখন ভাবি অপেক্ষাতো করলাম ৪২ বছর, দেখিনা আরও কিছুদিন। পৃথিবীর যেখানেই থাকুক এই ঘাতকরাও নিশ্চয়ই তাদের শাস্তি এড়াতে পারবে না।’
ড. ইসলামের স্ত্রী কষ্টাডিনকা পেনকভা ইভানোভাও ঐসময় কথা বলেন আমার সাথে। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে দেখছি বঙ্গবন্ধু’র কথা বলে মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠে রফিক। সহপাঠি শেখ জামালের স্মৃতিচারণ করতে করতে অশ্রুসজল হয়ে যায় তার চোখ।’ তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে রফিকের কাছ থেকে শুনতে শুনতে আমিও যে কখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের সাথে এত পরিচিত হয়ে উঠেছি তা বুঝতেই পারিনি।’ কষ্টাডিনকা জানান, একবার বাংলাদেশ ঘুরে আসবার জন্যে বহুবার অনুরোধ করেছেন তার স্বামীকে। কিন্তু তিনি কিছুতেই যাবেন না জনক হত্যাকারী ঔ ঘাতকগুলো শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত। স্বামীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ক কোন সংবাদ দেখলেই স্বামীর কাছে তা তুলে ধরতেন কষ্টাডিনকা। হার্ট সার্জন খোন্দকার ইসলামের স্ত্রী বুলগেরিয়া স্টেইট ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা কষ্টাডিনকা পেনকভা ইভানোভা ৪২ বছর যাবত বাংলাদেশ ছাড়া তাঁর স্বামীকে মাতৃভূমি সম্পর্কে আপডেট রাখতে নিজেই ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে বাংলাদেশের অর্জন, উন্নয়ন সম্পর্কে অবহিত রাখার চেষ্টা করেন। দেশের বাইরে ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশীদের সবাইকে চিনেন তিনি। আলোচনায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন বাংলাদেশী এমপি, রানীর জন্মদিনের কেক কারিগর নাদিয়া হোসেইনসহ ব্যারনেস পলা উদ্দিন সবার সম্পর্কে গল্প করলেন কষ্টাডিনকা, বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে চাইলেন আমার কাছে। বাংলাদেশে কোনদিন না গিয়েও ঢাকার বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজার ইত্যাদি যেমন চিনেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সব মুভমেন্ট সম্পর্কেই রাখেন খবর । ড. খোন্দকার ইসলাম বললেন, বুলগেরিয়ায় বাংলাদেশ এম্বেসি না থাকায় প্রধানমন্ত্রী যে সোফিয়া আসছেন এটি তিনি জানতেননা। তাঁর স্ত্রীই তাঁকে এখবরটি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে আগ্রহী করে তুলেন। শেখ হাসিনার সফরের বিস্তারিত কর্মসূচী এমন কি সাথে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও আসছেন এটি পর্যন্ত জানিয়েছেন কষ্টাডিনকা।
না, অভিমানী ড. খোন্দকার রফিকুল ইসলাম আর বাংলাদেশে যাননি। বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ ঘাতকগুলোর মৃত্যুদন্ড কার্যকর শেষেই যেতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে, কিন্তু সে সময় আর তিনি পাননি। চীরতরে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যজগতে।
মৃত্যুসংবাদ দিয়ে ড. ইসলামের স্ত্রী কষ্টাডিনকা যখন ফোন করেন, তখন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ড. রফিক এরমধ্যে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন কি না। বললেন, বঙ্গবন্ধুর সব ঘাতকের ফাঁসি যে কার্যকর হয়নি, উনি যাবেন কিভাবে?
সরি, খোন্দকার ইসলাম। আপনার দেশে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি আমরা।এই সুযোগ হয়তো হবে, কিন্তু তখন আপনাকে এই খবরটি পৌঁছানোর সুযোগ আমরা পাবোনা। অন্যজগতে ভালো থাকুন প্রতিনিয়ত।
কৃতজ্ঞতা মিসেস ইসলাম কষ্টাডিনকা পেনকভা ইভানোভার প্রতি। ক্ষনিকের পরিচয় হওয়া স্বত্বেও আমাকে মনে রেখে তাঁর স্বামীর মৃত্যুসংবাদটি প্রথমই আমাকে জানিয়েছেন। পেশাগত জীবনে এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, সম্পাদক, সত্যবাণী