বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভরতার কাণ্ডারি
পঙ্কজ ভট্টাচার্য
আমাদের জীবনে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকজুড়ে যে মানুষটিকে আমরা দেখেছি প্রেরণার উৎস হিসেবে, তিনি আমাদের শিখিয়েছেন সাম্যবাদ, যিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে প্রকৃত জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় মুজিব ভাই। ভিন্ন দলের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। ভিন্নদলের কর্মীকে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রাম-ঝঞ্ঝার দিনে। মাস্টারদা সূর্যসেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা, বীর ক্ষুদিরাম, নেতাজি সুভাষ বসুকে আমরা দেখিনি, পরম নির্ভরতার কাণ্ডারি হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি। যিনি আমাদের মতো অন্যদলের নেতাকর্মীদের কাছে উচ্চ আসনে আসীন ছিলেন।
রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর স্নেহাচার্য পেয়েছি সবসময়। তার বাড়িতে ছিল আমাদের জন্য অবারিত দ্বার। ১৯৬৩ সালে যুব জাগরণের জন্য তার পরামর্শ নিতে গিয়েছি। সবার প্রিয় মুজিব ভাই তখন ৩২ নম্বরেই থাকতেন। আমি একাধিকবার ৩২ নম্বরে গিয়েছি। নিজ দলের বাইরে আমাদের দলের জন্য নিজে অর্থ দিয়েছেন, এমনকি মানিক মিয়ার কাছে অর্থ সংগ্রহে পাঠিয়েছেন। রাজনীতিতে এমনটি এখন আর নেই। মুজিব ভাই সবসময় সংগঠন-আন্দোলনের কাজে উৎসাহ দিতেন। এমনকি বিদায়বেলায় কর্মীদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের পকেটে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা দিতেন। (মুজিব ভাই কর্মীদের জন্য টাকাগুলো অনেকটা পুরিয়া মতো করে রাখতেন) এভাবেই উদ্দীপনার রসদ জোগাতেন তিনি। তার এসব কথা আজ কল্পকাহিনির মতো শোনাবে। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অব্যাহত প্রেরণা দিতেন।
১৯৬১ সালের মে মাসে মণি সিংহ, খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠক করে স্বাধীনতার এজেন্ডা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেছিলেন মুজিব ভাই। মণি সিংহ বলেছিলেন, এখনো সময় হয়নি। আগে ধৈর্যের সঙ্গে মানুষকে গড়ে তুলতে হবে। মুজিব ভাই মণি সিংহের একথা মেনে নেন। ওই সময় মুজাফ্ফর আহমেদ, খোকা রায়, মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার পরস্পর সম্পূরক ভ‚মিকা পালন করতেন। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করে। বিশেষ করে সাভার, নরসিংদী এলাকায় শ্রমিক দাঙ্গা উসকে দেয়। ওই ঘটনার সময় জগন্নাথ হলের সামনে অ্যাসেম্বলি ভবনে দাঙ্গা উপদ্রুত হাজার মানুষের আশ্রয় দেয়া হয়। আমি দায়িত্বে ছিলাম। সাধারণ মানুষের চাঁদা দিয়ে আমরা তাদের সহায়তা করি। পাকিস্তানের কোনো সহায়তা আমরা নেইনি। মুজিব ভাইয়ের কাছে সাহায্যের জন্য আখলাককে পাঠাই। মহিউদ্দিন আহমেদের কাছেও পাঠাই। চিঠি লিখে সাহায্যের কথা জানিয়েছিলাম। মুজিব ভাই সঙ্গে সঙ্গে দুই হাজার টাকা, পাঁচ বস্তা চাল, দুই বস্তা ডাল ও দুটি হ্যাজাক পাঠিয়ে দেন। পর দিন মহিউদ্দিন ভাইও অনুরূপ সহায়তা করেন। ১৫ জানুয়ারি দাঙ্গার বিরুদ্ধে শান্তি মিছিল বের হয়। মুজিব ভাই, কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজনীতিবিদ জহুর হোসেন চৌধুরী ওই মিছিলে সামনের সারিতে ছিলেন। মিছিলেই খবর পাই কবি সুফিয়া কামালের ভাতিজাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৬৭ সালের ১৭ অক্টোবর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় স্বাধীন বাংলা করার ষড়যন্ত্রের অপরাধে। টানা চার দিন কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন দেখি মুজিব ভাই আমার মাথার কাছে ডাক্তারের চেয়ারে বসে আছেন। রিমান্ডে কী হয়েছে তিনি আমার কাছে সব কিছু জানতে চান। আমিও অকপটে সব সত্য মুজিব ভাইয়ের সামনে তুলে ধরি। জিজ্ঞাসাবাদের বেশিরভাগই ছিল মুজিব ভাই সম্পর্কে। ২০ অক্টোবর মুজিব ভাইয়ের প্রতিবেশী হিসেবে কারাগারে ঠাঁই হয় আমার। কারাগারে পাশাপাশি ছিলাম ১৯ দিন। ইতোমধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আমি যা শুনেছিলাম তাই মুজিব ভাইকে জানাই। মুজিব ভাই বলতেন, ছয় দফার প্রতি লাখ লাখ মানুষ সমর্থন জানাবে, তখন স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে মানুষের সমর্থন জোরদার হবে। কারণ সশস্ত্র যুদ্ধের পার্টি আওয়ামী লীগ নয়, ন্যাপও নয়। মুজিব ভাই বলতেন, এই মুহূর্তে সশস্ত্র যুদ্ধে ২৭ জন লোকের বেশি পাশে পাব না। এই ২৭ জনের মধ্যে একজন শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতি। এরকম কথাবার্তা মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে হতো। ইতোমধ্যেই আমি জামিনে মুক্তি পেলাম। আমাকে এগিয়ে দিতে জেলখানার গেট পর্যন্ত এলেন মুজিব ভাই। গেটে এসেই পুলিশ অফিসার সুবেদারকে বললেন, তোমার ডেপুটি জেলার নির্মল সিনহা কোথায়? তাকে ডাকো। আমার ভাই আজ বাইরে যাচ্ছে। প্রধান ফটক খুলে দাও। আমি মুখে পাইপ নিয়ে মাথা উঁচু করে জেলখানায় প্রবেশ করি, আবার মুখে পাইপ নিয়ে মাথা উঁচু করেই মূল ফটক দিয়ে বের হই। পঙ্কজও প্রধান ফটক দিয়ে বাইরে যাবে। জেল গেটে বেলি ফুলের মালা দিয়ে আমাকে বিদায় জানালেন মুজিব ভাই। বললেন, শহীদুল্লাহ কায়সারকে বলিস পাকিস্তান নিয়ে রাশিয়ান লেখকের বইটি আমাকে দিতে। বইটি রাশিয়া থেকে এনেছিলেন কবি জসীমউদ্দীন। বইটির কথা আমিই মুজিব ভাইকে বলেছিলাম। মুজিব ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিলেও আমি কাজটি করতে পারিনি।
স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রপিতা মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি। অর্থাৎ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুই দিন পর। তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তিনি আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ন্যাপের বাচ্চা সেক্রেটারি। বইটি তো আমাকে দিলি না। কিন্তু দেখ বইটি না পড়েই বইয়ের মতো কাজ করে সফল হলাম!
১৯৭৩ সালের দিকে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তিন দলীয় ঐক্যজোট হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ত্রিদলীয় জোট গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলাম। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয় ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই। তার সচিব ড. ফরাসউদ্দিনের মাধ্যমে বিকাল ৩টায় গণভবনে গিয়ে দেখা করেছিলাম। একটি বিশেষ বার্তা জানাতে মুজিব ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম আমি। বার্তাটি দিয়েছিলেন বাংলাদেশে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত বরিস বাইজস্টিক, যার বয়স ছিল ৮৭ বছর। এই বয়সে কেউ রাষ্ট্রদূত হয়ে আসে না। কিন্তু বুলগেরিয়া সরকার এই অভিজ্ঞ মানুষটিকে পাঠিয়েছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে। তিনি হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছিলেন। তিনি আমাকে ১১ জুলাই ডেকে নিয়ে একটি গুরুতর সংবাদ জানালেন। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর ছোট ও মধ্যস্তরের কর্মকর্তাদের একটি অংশ দেশে একটি ক্যুর ষড়যন্ত্র করছে। রক্তাক্ত এই অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত নিহত হতে পারেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করা দরকার। বার্তাটি তার কাছে পৌঁছানো দরকার।
আমি বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে জানাচ্ছেন না কেন? তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন তার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমরা নাক গলাচ্ছি কিনা, এ কারণে তারা জানাচ্ছেন না। আর যেহেতু আমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা তারা জানতেন, তাই আমাকেই বার্তাটি জানানোর জন্য অনুরোধ করলেন। আমি তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ-মোজাফফর) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা।
বার্তাটি মুজিব ভাইকে পৌঁছাতে পরদিনই ছুটে যাই। শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। এরপর বললেন, ‘বাংলাদেশে কেউ আমার বুকে অস্ত্র তাক করতে গেলে তার হাত কি কাঁপবে না? আমি ভাত-কাপড় না দিতে পারি; কিন্তু এ দেশের স্বাধীনতা কি এনে দিইনি? এ দেশের মানুষের জন্য আমি কি জেল খাটিনি?’ বললাম, ষড়যন্ত্রের নেশায় যারা মেতেছে, তারা তো এসব ভাববে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, মেজর ডালিম, রশিদ ও ফারুক এরা এসেছিল আমার কাছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ওরা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। এখন এসে কান্নাকাটি করছে সেনাবাহিনীর চাকরিতে তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেনানিয়মে এটা তো সম্ভব নয়। তাদের বললাম, তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করো। তারা বলল, ব্যবসা করবে, টাকা পাব কোথায়? আমি বললাম, আমি অর্থমন্ত্রীকে বলে দিচ্ছি, তোমরা ব্যাংকের লোন নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করো।
বঙ্গবন্ধু সে দিন নিজেই খুনিদের নাম বলেছিলেন নিজের অগোচরে। তিনি বলেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। আমাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চাইলে আমি নিজেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চাদরটা কাঁধে দিয়ে বাউলি মেরে আমার প্রিয় জনতার মধ্যে চলে যাব। আবার মানুষকে নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম গড়ে তুলব। আমি বললাম, যারা ষড়যন্ত্র করছে, তারা কি আপনাকে জীবিত রাখবে? তারা জানে, আপনাকে জীবিত রাখলে তাদের কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না। সুতরাং আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। মুুজিব ভাইকে জানালাম, রাষ্ট্রদূত বলেছেন, আপনার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি নিরাপদ নয়। এক কিলোমিটার দূর থেকেও এই বাড়িকে টার্গেট করে আপনাকে আঘাত করা সম্ভব। সে তুলনায় গণভবন অনেক নিরাপদ। তিনি বললেন, তোর ভাবি তো এই বাড়ি ছাড়তে চায় না। সে বলে, সারা জীবন জেলে থেকেছ। এখন এখানেই থাক। তোমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে পারব না। সারা জীবন এখানে থেকেছি, কত গাছপালা লাগিয়েছি, না থাকলে সব নষ্ট হবে।
সেদিন মুজিব ভাই কিছুটা বিচলিত হলেও বলেন, আমি তোদের জন্য ভাবি। বঙ্গবন্ধু বললেন ইন্দোনেশিয়ায় কি হচ্ছে তা দেখিস না? মণিদা, মুজাফ্ফর, পীর হাবিবদের সাবধান থাকতে বলিস। তিনি আমাকে আশ^স্ত করলেন, আমি এন্টি ট্যাংক আনার জন্য মার্শাল টিটোর কাছে নুরুজ্জামানকে পাঠিয়েছি। এক মাসের মধ্যে প্রতিষেধক ব্যবস্থাটি এসে যাবে। এর মধ্যে আমি একজনের জুতো দেখে শিউরে ওঠলাম যিনি পাকিস্তানের সাবেক পুলিশকর্তা আবদুর রহিম। আমার মতো অনেক আন্দোলনের কর্মীদের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানালেন, আবদুর রহিম তার সচিব ও বিশ^স্ত লোক। তিনি ট্যাংক আনার বিষয়টি পুনরায় উল্লেখ করলেন। কিন্তু মুজিব ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরব তখনই আরেক বিপদ! খন্দকার মোশতাক আহমেদ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। মুজিব ভাই বললেন, পঙ্কজ, দেখে যা, এই যে আমাদের রি-অ্যাকশনারি নেতা এসে গেছেন। ক্রুর হাসি হেসে মোশতাক আহমেদ জবাব দিলেন, নেতা আপনার জীবদ্দশায় আমি আপনার বিরোধিতা করব না।
খুনি মোশতাক তার কথা রেখেছিল। পঁচাত্তরের পনের আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেনি। বাংলার ইতিহাসে এইভাবে মোশতাক দ্বিতীয় মীরজাফরে পরিণত হলেন। আমি দ্রুত সব ঘটনা অধ্যাপক মোজাফ্ফর, মণি সিংহ ও কমরেড ফরহাদকে জানাই। আমরা জেনেছি আমেরিকা, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও চীনের মদতে সেনাবাহিনীর মেজররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। মুজিবনগর সরকারের সময় মোশতাক কনফেডারেশন চেয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকারের সময়ে তা সফল হতে পারেনি তাজউদ্দীনের কারণে। পঁচাত্তরে এসে সেই শোধ নিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম, নুরুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুর যুক্ত হয় খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। আর তাদের মদত দেয় আমেরিকা, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য-চীন। লিফসুলজের বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, জিয়া খুনিদের সহায়তার আশ^াস দেয়। খুনিদের বয়ানেও এর সত্যতা মেলে। লিফসুলজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খুনিরা নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ইত্তেফাকে খুনিদের সাক্ষাৎকারেও পড়েছি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আমলের শেষের দিকে ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছিল, পাটের গুদামে আগুন, নকশালরা বিভিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছিল। থানা থেকে অস্ত্র লুট হচ্ছিল। সব ঘটনা উসকে দিচ্ছিল খন্দকার মোশতাক। মওলানা ভাসানী পর্যন্ত মুসলিম বাংলার পক্ষে বক্তৃতা দেন মোশতাকের উসকানিতে। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমি কষ্ট করে আনি চাটার দল খেয়ে ফেলে। সবাই পায় সোনার খনি, আমি পাই চোরের খনি।’ বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। সেই অপরাধবোধ কাজ করে। সেদিনের দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসছে। যে মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিল, সে আবার সুযোগ পেয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে দেশটাকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিল।
মনে পড়ে, ১৪ আগস্ট অনেক রাত পর্যন্ত আমি শেখ মনি ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। কীভাবে যুবশক্তিকে কাজে লাগানো যায় এ বিষয়ে তার একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। কারণ পরদিন এ ব্যাপারে আমার একটি বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। ভোরবেলায় আমি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারি। দিগভ্রান্তের মতো আমাদের পার্টির সদস্য মোনায়েম সরকারের শান্তিনগরের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। চারদিকে স্তব্ধ, ভয়ার্ত পরিবেশ। মাঝে মাঝে জাসদের মিছিল, ‘রুশ-ভারতের দালাল ধর’ ইত্যাদি স্লোগান। রাস্তায় আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীকে দেখিনি। আমরা ওইসময় কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনি। অবশ্য শোকে বিহ্বল জাতির পক্ষে প্রথম প্রতিবাদ বামরাই করেন। অবশ্য তখন পরিবেশটা অন্যরকম ছিল। সাইফুদ্দিন মানিক, আমি, তোফায়েল, রাজ্জাকসহ অনেকেই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করি। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শোক মিছিল করি। গায়েবানা জানাজা করি। সবার সামনে ছিলাম আমি। পরদিন ইত্তেফাক ওই ছবিটি প্রকাশ করে আমার মাথায় লালবৃত্ত এঁকে। সেদিন আমি বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটে ১৭ জন মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম গায়েবানা জানাজায় আসার জন্য। একমাত্র মহিউদ্দিন ছাড়া অন্য কেউ আসেননি।
নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহে ঐক্য-ন্যাপের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। মিছিল করে। অনেকে জেলও খাটেন। কিন্তু কোথাও আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ডিসেম্বরে আমাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। আমি ছয় মাস ভারতে ছিলাম। পরে দেশে ফিরে আসি। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগসহ বামদলগুলো মিলে আবার লড়াই সংগ্রাম শুরু করি। কিন্তু আমাদের দাঁড়াতে দাঁড়াতে তিন-চার বছর লেগে যায়। এর আগেই কুখ্যাত ইনডেমিনিটি আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় খুনি চক্র। শোকের মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সবার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য: রাজনীতিক, ঐক্যন্যাপের সভাপতি।