বালাগঞ্জ শত্রুমুক্ত হওয়ার গল্প

হামিদ মোহাম্মদ
অতিথি প্রতিবেদক, সত‍্যবাণী

লন্ডন: একাত্তরের ঐতিহাসিক বছরটির প্রতিটি দিন ছিল বাঙালির জীবনে সোনাঝরা দিন। ডিসেম্বর মাস ছিল সেই সোনাঝরা দিনের শ্রেষ্ঠ মাস। বাঙালি পাক হানাদার বাহিনিকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেÑ বিজয় অর্জন করে নয়মাসের সশস্র লড়াই ও বহু রক্তের বিনিময়ে। এই ডিসেম্বর এলেই বাঙালিরা আবেগে, উচছ¡াসে আত্মহারা হওয়া শুধু নয় আত্মপরিচয়ের শিখরেও দাঁড়ায়। এত উঁচু মাথা বাঙালিরÑকে ঠেকায় তাকে! একাত্তরের সেই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কত বীরত্বগাথা বাঙালি জীবনে জড়িয়ে গেছে ইতিহাস হয়ে। অমর এসব ইতিহাস শুধুই আমাদের-বাঙালিদের,পৃথিবীর সংগ্রামী মানুষের পাশে বাঙালি বীর সন্তানরা অদ্বিতীয় ইতিহাস।

সেই ইতিহাসের একটি গল্প বলতেই আজকের এ লেখা শুরু। সিলেটের প্রথম শত্রুমুক্ত এলাকা বালাগঞ্জের শত্রুমুক্ত হওয়ার কাহিনি। যিনি এ বিজয়ের কাব্য রচনা করার মূল নায়ক ছিলেন তিনি এখন আমার পাশে বসা। নাম আজিজুল কামাল। ষাটোর্ধ বয়সের আজিজুল কামাল বিজয়ের বিয়াল্লিশ বছর পর কী ভাবছেন, কী অনুভূতি তাঁর? কীভাবে বলবেন কাব্যগাঁথা সেদিনের। ৭ডিসেমবর সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানা প্রথম শত্রুমুক্ত করেন আজিজুল কামাল।একদল মুক্তিযোদ্ধার সাহসী অভিযানের নেতৃত্ব দেন তিনি। বালাগঞ্জ থানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীর বাড়ি। এ এলাকায় বড় ধরনের তিন/চারটি গণহত্যা ঘটায় পাক বাহিনি আলবদর বাজাকারদের সহযোগিতায়।এর প্রতিশোধ স্পৃহা তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে। অন্যদিকে দেশকে শত্রুমুক্ত করার মরণ পণ অঙ্গীকার। একাত্তরের ডিসেমবর মাসের ১ তারিখ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র বাংলার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় এলাকায় প্রচন্ড আঘাত হানা শুরু করে। ২ ডিসেম্বর ৪০ জনের এক দল তেজদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সিলেটের পূর্ব সীমান্তের রাতাছড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে ভোর ৬টায় বালাগঞ্জ অভিমুখে অধিনায়ক আজিজুল কামাল রওয়ানা দেন।এ দলে ছিলেন সহ অধিনায়ক মছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, মজির উদ্দিন,ধীরেন্দ্র কুৃমার দে,আবদুল বারি,সমুজ আলী,আবদুল খালিক,জবেদ আলী,সিকন্দর আলী,নেহাবেন্দ্র ধর,আমান উদ্দিন, লালা মিয়া, আবুল হোসেন সহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী ওদের ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পথিমধ্যে রাজনগর থানার একটি জায়গায় রেখে অবশিষ্ট ১৪ জন নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজ গাঁওয়ে গণি মাস্টার ও বদরুল হক নিলুর বাড়িতে যাত্রা বিরতি করেন। সেখান থেকে রাত বারোটার দিকে অভিযান শুরু করেন। ঘনকুয়াশা আর কনকনে শীতের ভোররাত ৪টায় ইলাশপুর সেতুর কাছে বাংকারে অবস্থান নেন শত্রুকে এমবুস করার অপেক্ষায়। দিনটি ছিল ৬ ডিসেমবর। সিলেট থেকে একদল পাক বাহিনি ফেঞ্চুগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ইলাশপুর সেতুর কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে শুরু করে। যুদ্ধ শুরু হয়। পাকবাহিনিও পাল্টা আক্রমণ করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনির আক্রমণের মুখে পাক বাহিনি ঠিকতে না পেরে ফের সিলেটের দিকে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি তবে পাকবাহিনি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গোলাবারুদ ফেলে পলায়ন করে। ইলাশপুর এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কদিন আগে ফেঞ্চুগঞ্জ প্রচন্ড যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা করায়ত্ব করে। এর কদিন আগে ছোটলেখা চাবাগান আজিজুল কামালের নেতৃত্বে প্রচন্ড যুদ্ধের পর দখলমুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তুমুল যুদ্ধে ২ জন পাক সেনা নিহত ও কয়েকজন মারাত্বক আহত হয়। বাকীরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে বাগান ছেড়ে পালায়। এ বিজয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরও বেড়ে যায়। এই অভিযানের সাফল্য ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাদের ওপর দায়িত্ব পড়ে বালাগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার। ৬ ডিসেম্বর ইলাশপুর যুদ্ধে জয়লাভের পর ১২ কিলোমিটার দূরে বালাগঞ্জের থানা সদরে অভিযানের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।এ উদ্দেশ্যে আজিজুল কামালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রওয়ানা দেন বালাগঞ্জ অভিযানে।এদিকে রাজনগরে অবস্থানকারি দলটি ৬ তারিখ বালাগঞ্জে এসে আজিজুল কামালের মূল গ্রুপের সাথে মিলিত হন।রেকি পার্টির মাধ্যমে নিশ্চিত খবর পান পাকবাহিনি বালাগঞ্জ সদরে নেই। থানা নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ ও পাকদোসর রাজাকার বাহিনি। রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদর ঘেরাও করে পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পনের আহবান জানান। এ সময় বালাগঞ্জে কর্মরত ডা. জাকারিয়া, কানুনগো বদিউজ্জামান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুস সোবহান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বার্তা আদান প্রদান করতে বিশেষ সহায়তা করেন।৭ তারিখ ভোরে অধিনায়ক আজিজুল কামাল তার তিনজন প্রতিনিধিকে দিয়ে পুলিশসহ থানার ভেতরে অবস্থানরত সকল পাকসরকারের সহযোগিতাকারিদের আত্মসমর্পণের জন্য চুড়ান্ত আহবান জানান। পুলিশ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দুই ঘন্টা সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু তাদেরকে ১৫ মিনিট সময় বেঁেধ দিয়ে এরই মধ্যে আত্মসমর্পন নতুবা থানা ভবন উড়িয়ে দেয়ার হুঁশিয়ারি দেন মুক্তিযোদ্ধারা। অবস্থা বেগতিক দেখে সকাল ৯টায় ভীতসন্ত্রস্ত পুলিশ দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পনের কথা জানায়। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আত্মসমর্পনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। থানা সদরে অবস্থান করা রাজাকার দলটি অন্ধকার থাকতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে আত্মগোপন করে। পালাতে গিয়ে কয়েকজন ধরা পড়ে। দায়িত্বরত ওসি আবদুল জব্বার ও সেকেন্ড অফিসার ফয়জুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ দলটি ভবন থেকে বেরিয়ে থানা চত্ব¡রে তাদের অস্ত্র জমা দিতে থাকে। ইতোমধ্যে ডাকবাংলো ভবনে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দলের অধিনায়ক আজিজুল কামাল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে থানা চত্বরে হাজির হন। আনুষ্ঠানিকভাবে ওসি আবদুল জব্বার অধিনায়ক আজিজুল কামালের হাতে থানা ভবনের চাবি হস্তান্তর করে। থানা সদর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আসার খবর এবং পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পনের এ সংবাদটি আগেই মুক্তিকামী মানুষের কাছ পৌঁছে গিয়েছিল। তাই থানা সদর সকাল ১০টার মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।সকাল ৯টায় মুক্তিযোদ্ধাদের দলপতি আজিজুল কামাল থানার দায়িত্ব বুঝে নেন। আজিজুল কামাল সমবেত মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে আবেগঘন বক্তব্য রাখেন। তিনি ঘোষণা দেনÑ আজ থেকে বালাগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে। যে কোন আক্রমণ ও অপকর্ম মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করতে সক্ষম। তিনি বালাগঞ্জবাসীকে শান্তি শৃৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং যে কোন সমস্যার বিষয়ে থানা ভবনে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের অবহিত করতে উপস্থিত জনতার প্রতি আহবান জানান। আবেগঘন এ বক্তব্য প্রদানের পর জনতার জয়বাংলা ধ্বনি ও জাতীয় সঙ্গীত গীত হওয়ার মাধ্যমে আজিজুল কামাল আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকাটি থানা সদরে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে প্রথম উত্তোলন করেন। জনতার পক্ষ থেকে ছাত্রনেতা মখলিসুর রহমান অধিনায়ক আজিজুল কামালকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করেন। সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সহঅধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা মছব্বির বেগ, মইজ উদ্দিন দোলা, আনোয়ার উদ্দিন ও ছাত্র নেতা জামি আহমদ প্রমুখ।আটককৃত রাজাকার ও পুলিশ সদস্যদের থানা কাষ্টডিতে রাখা হয়।

৯ ডিসেমবর বালাগঞ্জের ত্রাস সাইদুর রহমান ওরফে কালা মৌলবীকে আটক করেন মুক্তিযোদ্ধারা। দুদিন পর সকল বন্দীদের জালালপুর ক্যাম্পে স্থানান্তর করেন। পাক দালাল মৌলভী ফজলুর রহমান,শান্তি কমিটির ইউনিয়ন কনভেনার আবদুল আহাদ চৌধুরী সাদ মাস্টার, বদরুল জায়গীরদার,আজিজুল হক জানু ও রাজাকার হারুন এবং থানা রাজাকার কমান্ডার আফতাবুজ্জামানকে আটক করা সম্ভব হয়নি। জনরোষ থেকে বাঁচতে তারা আত্মগোপন করে। বদরুল জায়গীরদার ছিল বোয়ালজুড় ইউনিয়নের শান্তিকমিটির কনভেনার। বোয়ালজুড় বাজারে শান্তিকমিটির অফিস স্থাপন করে এলাকায় সে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সাদ মাস্টার বুরুঙ্গা ও আদিত্যপুর গণহত্যার মূল নায়ক ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামাল এ উত্তেজনাকর অভিযানের গল্প সংঘটিত ঘটনার বিষদ বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার হাতে তুলে দেন যতœ করে রাখা ভাঁজ করা পত্রিকার পুরনো একটি অংশ। তরুণ সাংবাদিক হাবিবুর রহমানের লেখা সিলেটে প্রথম শত্রুমুক্ত জনপদ বালাগঞ্জ। কাগজটি হাতে ধরিয়ে দেয়ার সময় দেখলাম তাঁর চোখ আনন্দে চিক চিক করছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশীয় পাক দালালরা হত্যা, লুটপাটসহ নারীর সম্ভ্রমহানির মত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ জঘন্য অপরাধীদের বিচার হয়নি। বর্তমান সরকার আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্যাইবুনাল গঠন করে এ সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। আজিজুল কামাল আশান্বিত হয়ে বললেনÑ হয়তো জাতি কলংকমুক্ত হতে পারে। আজিজুল কামাল ১৯৭৪ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার পর স্বপ্নে ভরা বুক নিয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুক্তরাজ্যে বাস করলেও দেশে থাকেন বেশী। এক পুত্র ও এক কন্যার জনক আজিজুল কামালের বালাগঞ্জের বোয়ালজুরে পৈতৃক নিবাস। সিলেট শহরের শাহাজালাল হাউজিং এস্টেটের বাসিন্দা তিনি। তার গ্রাম বোয়ালজুরে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া দুইযুগ আগে শিক্ষায় পশ্চাদপদ বালাগঞ্জে কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন।এখন কলেজটি একটি লব্দ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যুক্তরাজ্যেও বালাগঞ্জের শিক্ষা ও সমাজ সেবামূলক কমিউনিটি সংগঠনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। মূলত দেশের কল্যাণ কামনায় নিবেদিত আজিজুল কামাল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। কিন্তু তার মাঝে কোন অহংকার বাসা বাঁধেনি। দেশপ্রেম আর সততা আজিজুল কামালের শ্রেষ্ঠ ভূষণ। ব্যক্তিগতভাবে সদালাপী ও বন্ধু বৎসল তিনি ।

১০ ডিসেম্বর ২০১৩.লেখক: কবি ও সাংবাদিক

You might also like