বিজয়ের ৫০ বছর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব নিকাশ


আবু মুসা হাসান

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শেষে ৫০ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। তবে ৫০ বছর যে কেটে গেছে তা মনে হয় না, এ যেন সেদিনের ঘটনা।  

দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাঙালি জাতি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। অগনিত মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই এবং আত্মত্যাগের এক পর্যায়ে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে  স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেয়।

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আম্মাকে খুব মনে পড়ছে, তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। আম্মার আশির্বাদ নিয়েই দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলাম। বাংলার  মায়েরা হাসিমুখে তাঁদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে আমার মা ভাগ্যবতী, স্বাধীনতার পর তিনি আমাকে ফিরে পেয়েছেন। অনেক মা তাঁদের সন্তানদের ফিরে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। সেইসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের মহিয়সী মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক নারীর উপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতা ঘটেছে নজিরবিহীন। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া, আশ্রয় দেয়া ছাড়াও বহু নারী অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
দেশব্যাপী হানাদার বাহিনী নয় মাস ধরে করেছে হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট।

৫০ বছর আগে পাকিস্তানী শাসনআমলের বঞ্চণার দিকে তাকালে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমরা দেশ স্বাধীন করে অনেক কিছু পেয়েছি। তবে চেয়েছিলাম একটি বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ।

পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন যারা দেখেনি, কিংবা যারা তাদের চাটুকার, তারা হয়তো তখনকার বঞ্চণার ইতিহাস মানতে রাজি হবেনা। এখনও ভাবতে অবাক লাগে যে ‘৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের চারণ ক্ষেত্র বানানোর জন্য শাসকগোষ্ঠী বাঙালীর মায়ের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিয়ে, উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনই বাঙালী প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক এবং বিমাতাসূলভ আচরণের ফলে বাঙালীর নাভিশ্বাস উঠেছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সামরিক-বেসামরিক চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে ছিল এই বৈষম্য। স্বাধীন বাংলাদেশে এখন আর দুর্ভিক্ষ হয়না, মঙ্গা হয়না। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মানুষ না খেয়ে মরেনা। অর্থনীতির সকল মানদন্ডে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ এবং মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশী। বাংলাদেশের মূদ্রা পাকিস্তানী মূদ্রার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এক ডলারের মূল্য বাংলাদেশে এখন ৮৪ টাকা আর পাকিস্তানী মূদ্রায় ১৪৭ রুপী। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে অনুমোদন দিয়েছে।

 না পাওয়ার বঞ্চণা

মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন একটি সুন্দর দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে থাকবেনা অন্যায় -অবিচার আর শোষণ -বঞ্চণা। ৫০ বছর পর অকপটে বলা যায় যে আমাদের ঐ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। আমাদের জি ডি পি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) এবং মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে । কিন্তু বৈষম্যের অবসান হয়নি। জাতির জনকের ঘোষিত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ব্যাংক -বীমা এবং বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করেছিলেন, দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। তাইতো সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষেতা এবং জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা

এই অর্ধ শতাব্দীতে  বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। ঘটেছে অনেক মর্মান্তিক ঘটনা। পঞ্চম বিজয় দিবস আসার আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারায় দেশ চলতে লাগলো। এমনকি সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির ওপরও ছুরি চালালো ‘৭৫ পরবর্তী জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার। শুধু তাই নয়, সংবিধানের প্রস্তাবনায় “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের” পরিবর্তে প্রতিস্থাপন করলো “জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের”। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির জন্য ১৯৫২ সালের  মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে ‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত যত আন্দোলন -সংগ্রাম  হয়েছে, যত আত্মদান হয়েছে, তার স্বীকৃতি থাকলো কোথায়? আর এই পরিবর্তনের মাধ্যমে সুকৌশলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হলো। কিন্তু আমাদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলমান প্রক্রিয়া। ১৯৭১ সালে আমারা রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আজ অবধি বাংলাদেশের আপামর জনগণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়নি।

পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার সংবিধানে  ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম  হিসাবে সংযোজন করলো।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত কার্যাবলী এবং ফরমান সমূহের বৈধতাদানকারী সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করার পর, ২০১১ সালে  জাতীয় সংসদে সংবিধানকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি পুনর্বহাল করা হলেও ‘৭২ এর সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। 

দূর্বার গণআন্দোলন

আবার ফিরে আসা যাক মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পটভূমীতে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার আর সীমাহীন শোষণ -নির্যাতনে সর্বস্তরের বাঙালীর জীবন যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো তখন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঘোষণা করলেন ঐতিহাসিক ৬-দফা। তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া ও মেনন গ্রুপ, এন এস এফ- এর দোলন গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা দাবীর মাধ্যমে দূর্বার ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে তুললো। এই ১১-দফা দাবীর  মধ্যে স্বায়ত্ব শাসনের দাবী সম্বলিত ৬-দফা দাবীগুলো যেমন ছিল, তেমনি ব্যাংক- বীমা ও বৃহৎ জাতীয়করণসহ প্রগতিশীল দাবীগুলোও ছিল।

ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনে অংশগ্রহণ

১৯৬৮ সালে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ছাত্র রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেলাম। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ঐতিহাসিক ১১-দফা ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ১১-দফা ছাত্র আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় এবং মিছিলে ঢাকার বিভিন্ন কলেজ এবং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নিতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২০ শে জানুয়ারী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের ওপর পুলিশের গুলীবর্ষনে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ শহীদ হওয়ার পর ছাত্র আন্দোলন আরও দূর্বার হয়ে উঠে এবং ২৪ শে জানুয়ারী গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুবের পতন ঘটে।

৭ই মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের গ্রীন সিগন্যাল

পরবর্তীকালে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক       পরিষদের নির্বাচন। নির্বাচনের পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা অর্পনের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রমনা মাঠে (বর্তমানে সোহরায়ার্দী উদ্যান) এক জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঐ ঐতিহাসিক জনসভায় আমারও থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পাশাপাশি যার যা আছে তা নিয়ে হানাদারদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার গ্রীণ সিগন্যাল।

 ৭ই মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্ততি নেয়ার জন্য আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করলাম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তৎকালীন ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর্স (ইউওটিসি) এর ডামি থ্রী নট থ্রী রাইফেল যোগাড় করে  মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কাশেম ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের প্রশিক্ষণ চলে। অন্যদিকে, ছাত্রলীগের কর্মীরাও একইভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকা শহরে মার্চপাস্ট করেছিলাম। সাদা শাড়ী পড়া মেয়েরা ছিল মিছিলের অগ্রভাগে আর ছেলেরা ছিলাম মিছিলের পেছনে।

 ২৫শে মার্চ -প্রতিরোধের রাত

২৫শে মার্চ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী রাত ১২টার দিকে অতর্কিতে হামলা চালালো। তবে রাত ১০টার দিকেই তাদের আক্রমনের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় চারদিকে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ আন্দোলন। আমাদের বাসা ছিল আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনে। আমার বন্ধু শাহীনসহ কয়েকজন প্রতিরোধের জন্য বেড়িয়ে পড়ি। বাসার কাছে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি ) গেটে গিয়ে দেখি শত শত মানুষ কুড়াল দিয়ে দ্রুত বড় বড় গাছগুলো কেটে রাস্তার ওপর বেরীক্যাড তৈরী করছে, আমরাও বেরীক্যাড তৈরিতে হাত লাগালাম। নিউ মার্কেটের গেট পার হয়ে আমরা সব বন্ধুরা মিলে যখন তৎকালীন বিউটি রেস্টুরেন্টের কাছে মীরপুর রোডে পৌঁছলাম, তখন বাজে রাত ১২টা।  হঠাৎ করে শুরু হলো হানাদার বাহিনীর আচমকা আক্রমণ। গোলাগুলির সময়মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকার আকাশ দিনের চেয়েও বেশী পরিস্কার হয়ে উঠতো। পরে জানতে পেরেছি যে, ঐগুলো ছিল ট্রেসার বুলেট। রাতের অন্ধকারে শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য ট্রেসার বুলেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমরা চার বন্ধু দৌড়ে দেয়াল টপকে আজিমপুর কলোনীতে গিয়ে একটি বিল্ডিং এর সিঁড়ির নীচে কিছু সময় অপেক্ষা করি। পরে আজিমপুর কবরস্থান অতিক্রম করে নতুন পল্টন লাইনে ফিরে এলাম। কিন্তু অবিরাম গোলাগুলির জন্য সেই রাতে বাড়ী ফিরতে পারলামনা। দেয়াল টপকে মানিক ভাইদের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। মানিক ভাই মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে শহীদ হয়েছেন।

ভোর বেলায় বাসায় ফিরে দেখি যে ইপিআর-এর এক সিপাহী আমাদের ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ঐ সিপাহী জানালো যে, ব্যারাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাকিস্তানীদের হামলার শিকার হয়ে তাদের অনেকেই নিহত হয়েছে। যারা সুযোগ পেয়েছে তারা তাদের হাতিয়ার নিয়ে ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসেছে। হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চরাতভর গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি প্রচন্ড গোলাগুলির মাধ্যমে আতংক সৃষ্টি করে বাঙালী জাতিকে ভয় দেখিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে বিরত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর আহবানে উজ্জিবীত বাঙালী জাতি স্বাধীনতার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পিছপা হলোনা।

২৫শে মার্চ রাতে হামলার পর ঢাকায় কারফিউ জারি  করা হয়েছিল। ২৭শে মার্চ কারফিউ শিথিল হলে প্রতিবেশীরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছে। মা-বাবা ও দুই বোনকে নিয়ে আমি ঢাকা থেকে বের হয়ে জিঞ্জিরা এবং মুন্সীগঞ্জে কয়েকদিন অবস্থান করি। পরে নবীনগর হয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ী কসবার রাইতলায় চলে আসি।

তখনও পুরো ব্রাম্মণবাড়িয়া মুক্ত এলাকা। আমি আর আমার খালাত ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য আখাউড়ার কাছে গঙ্গাসাগর স্টেশন সংলগ্ন আমার মেঝ মামা মরহুম গোলাম রফিকের বাড়ীতে চলে যাই। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গঙ্গাসাগরের পতন ঘটলে মামা-মামী, নানী এবং ছোট দুই মামাতো ভাই-বোন সহ আমি এবং খালাত ভাই মহিউদ্দিন বুলবুল দ্রুত বের হয়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকি। তবে দুঃখের ঘটনা হলো বড় মামা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম মামার বাড়ীতে  আগুনের লেলিহান শিখা। ঐ আগুনে বাড়ীর সাথে বড় মামাও ভস্মীভূত হয়ে গেলেন।

মামাদের সীমান্তবর্তী গ্রামের বাড়িতে এক রাত কাটিয়ে পরের  দিন আমরা চলে যাই আগরতলায়। মামারা বড় হয়েছেন আগরতলায়। ভারত বিভক্ত হওয়ার আগে নানা আগরতলা রাজবাড়ীর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ঐ সময় ত্রিপুরা রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী সচিন শিং সহ রাজ্যের কর্তাব্যক্তিরা প্রায় সবাই ছিলেন নানার ছাত্র এবং মামার সুপরিচিত। আমরা আগরতলার বটতলায় ধীরেন দত্তের বাসায় উঠি। ধীরেন দত্ত ছিলেন আগরতলা থেকে নির্বাচিত তৎকালীন সিপিএম দলীয় এমপি বীরেন দত্তের ভাই। আমার প্রচন্ড জ্বর হওয়ায় আগরতলার জি বি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হাসপাতালে শয্যাশয়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। এখনও মনে পড়ে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং সিস্টারদের অকৃত্রিম সেবা শুশ্রূষার কথা। আমাকে ওরা সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে ডাকতো।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর আমার বড় আপা ও  দুলাভাই ঢাকা থেকে আগরতলায় আগেই  চলে গিয়েছিলেন। আমার সাথে তাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। আগরতলা গিয়ে মামার কাছ থেকে বড় আপা জানতে পারলেন যে, আমি অসুস্থ এবং হাসপাতালে আছি।

বড় আপা চারুকলায় এবং দুলাভাই সরকারী চাকুরী করতেন বিধায় তাদেরকে ক্র্যাফট হোস্টেলের একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বড় আপার সাথে আমি চলে আসি।

ক্র্যাফট হোস্টেলেই  ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাম্প ছিল। আমার দলের নেতা-কর্মীদের পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। কিন্তু অচিরেই খুব বিষন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কারণ  আগরতলার রাস্তায় সকালে ’পিটি’ করা ছাড়া অন্য কোন ট্রেনিং এর সুযোগ হচ্ছিল না। তার অন্যতম কারণ ছিল আমাদেরকে ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিতে ভারতের কংগ্রেস দলীয় সরকারের অনীহা। এর ফলে তখন কংগ্রেস সরকারের প্রতি খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন উপলব্ধি করি যে, ইন্ধিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার আমাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র যোগানের ব্যবস্থা না করে তেমন কোন গর্হিত কাজ করেনি। তার কারণ ঐ সময়টা নক্সালপন্থী অস্ত্রধারীরা কংগ্রেস সরকারকে ব্যতিব্যাস্ত করে রেখেছিল। নক্সালপন্থীরা যাতে রাইফেল ছিনিয়ে নিতে না পারে তারজন্য শিকল দিয়ে রাইফেলগুলো পুলিশ কোমরের সাথে তালা দিয়ে রাখতো। তাই ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের মতো কমিউনিস্টদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকারের অনীহা থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়ানোর পর ভারত সরকার আমাদের ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা এবং অস্ত্র দিতে সম্মত হয়। এক পর্যায়ে ভাসানী ন্যাপের মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমিউনিষ্ট পার্টির মনি সিং, মোজাফফর ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দলের নেতাদের সমন্বয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্ব গঠিত স্বাধীন বাংলা সরকারের একটি কনসালটেটিভ কমিটি (উপদেষ্টা পরিষদ) গঠন করা হয়।

ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার লম্বা কিউ থাকাতে ১১-দফা ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মরহুম সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিক মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য আমাকে গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। আগরতলা থেকে বাড়ী এসে দেখি আমার মা-বাবা দুবোনকে নিয়ে পাকস্তানী হায়েনাদের হামলার আশংকা করে আরও কয়েক মাইল পশ্চিমে আমার ফুফুর বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন।

দাদীকে নিয়ে কাকা রয়ে গেলেন গ্রামের বাড়ীতে। কারন এই অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারের যোগসূত্র ছিলেন আমার কাকা মরহুম ডাঃ ওয়াহেদউদ্দিন আহমেদ ময়না মিয়া। বহু মুক্তিযোদ্ধাই আমাদের বাড়ী হয়ে দাদীর হাতের রান্না খেয়ে আগরতলা গেছেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালও আমাদের বাড়ীতে কয়েকদিন থেকে আগরতলা গিয়েছিলেন। শেখ জামালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাকা নিজেই তাকে সাথে করে নিয়ে আগরতলায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।

আগরতলায় যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম

এদিকে ফুফুর বাড়ীতে থেকে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আগরতলায় আবার ফিরে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। কিন্তু ঐ সময়টা কুমিল্লা-ব্রাম্মনবাড়িয়া মহা সড়ক অতিক্রম করাটা ছিল খুবই বিপদজনক। আগরতলা যাওয়ার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ পাশ্ববর্তী একটি গ্রামের বাজারে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী শওকতের সাথে দেখা হয়ে গেল। শওকতের বাড়ী নবীনগরে। ভৈরবের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ঐদিনই আগরতলায় যাওয়ার কথা রয়েছে বলে শওকত জানালো। আমি তাদের সাথে যেতে চাইলে শওকত দলের কমান্ডার অধ্যাপক হান্নান সাহেবের সাথে আমাকে আলাপ করিয়ে দেয়। হান্নান সাহেব তাদের সাথে আমাকে নিতে রাজী হলেন। দৌড়ে ফুফুর বাড়ী গিয়ে ঝোলাব্যাগে দুই একটি কাপড় নিয়ে তৈরী হয়ে গেলাম। আমার আগরতলায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুনে আম্মার মুখ ভারী হয়ে গেল। বল্লেন, আমি তো তোকে হাসিমুখে আশির্বাদ করে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তুই ফিরে এলি কেন? এখন এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আগরতলায় যেতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতে চাস কেন?  কিন্তুু আমার কানে কিছুই প্রবেশ করছিল না। সবার আপত্তির মুখে আমি বিদায় নিয়ে চলে গেলাম।

কমান্ডারের কথা অনুযায়ী খালের পাশে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকাটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। পড়ন্ত বেলায় মেঘলা দিনে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সেখানে এক যুবক জাল দিয়ে মাছ ধরছিল। আমি তাকে আমার অপেক্ষার কারণ বলার পর সে বল্লো যে, মনে হয় একটা ‘মুক্তির‘ নৌকা চলে গেছে।  তখন আমার মাথায় বাজ পড়লো। সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবেই হোক, আমাকে আগরতলায় যেতেই হবে। কমান্ডার হান্নান সাহেব আমাকে বলেছিলেন যে তারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী নিমবাড়ী গ্রামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সূদন মিয়ার মাধ্যমে আগরতলায় যাবেন। আমি সূদন মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা, কিছুদূর হেঁটে হাঁটু পানি এবং কোমড় পানি ভেংগে চারগাছ বাজারের কাছে জাঙ্গাইলের সড়ক নামে একটি উঁচু রাস্তায় গিয়ে উঠলাম। বেশ দূরে একজন নৌকা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ডেকে আমাকে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করলাম। আমাদের নৌকাটি সূদন মিয়ার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা থেকে টর্চ জ্বালিয়ে হল্ট-হল্ট বলে একজন হুংকার দিয়ে উঠলে আমি পরিচয় দিলাম।

 আইজ রাইতে ক্লিয়ারেন্স নেই

এদিকে সূদন মিয়া ঘর থেকে বের হয়ে জানিয়ে দিলেন যে, সি এ্যান্ড বি রোড (কুমিল্লা-ব্রাম্মণবাড়িয়া মহাসড়ক) এবং রেল লাইনের কালভার্ট পার হওয়ার ক্লিয়ারেন্স নেই। তিনি কাছাকাছি কোথায়ও রাত্রিযাপন করে পরের দিন এসে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেছে কিনা তা জানার জন্য পরামর্শ দিলেন। আমি তখন ২০-২৫ জনের পুরো মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলে যাই। দাদী রান্না করে সবাইকে খাওয়ালেন। আমরা নৌকা নিয়ে পরদিন আবার ঐ ব্যাবসায়ীর বাড়ীতে যাই। তিনি যথারীতি জানিয়ে দিলেন যে, ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়নি। এভাবে চারদিন কেটে যায় এবং কাকা ও দাদী যত্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটির খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

পঞ্চম দিন সূধন মিয়া জানালেন যে, ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেছে। তার তত্ত্বাবধানে আমরা রাতের আঁধারে একটি কালভার্ট অতিক্রম করে রেল লাইনের আরো একটি ছোট সেতু পার হয়ে নিরাপদে আগরতলায় পৌঁছি। কিছুদিন পর ট্রেনিং এ যাওয়ারও সুযোগ পেয়ে যাই।

 ট্রেনিং ক্যাম্পের কিছু স্মৃতি

আমি ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর তৃতীয় ব্যাচের ট্রেনিং-এ অংশ নেই। আসামের তেজপুরে ভারতীয় সামরিক ঘাঁটিতে এক মাসের গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।

ট্রেনিং ক্যাম্পের দিনগুলো কখনও ভোলার নয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে আমাদের ব্যাচে মোট চারশ‘ জন ছিলাম। আমাদের দলনেতা ছিলেন প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার মর্তুজা খান। ট্রেনিংয়ের প্রথম দিনের একটি ঘটনা আজও আমার মনে পড়ে। প্রথমেই আমাদেরকে দৌড় দিয়ে একটি বিশাল মাঠ চক্কর দিতে বলা হলো। দৌড় যখন দিচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিচ্ছি। তারপর কমান্ড আসলো লীডারের সাথে পিটি শুরু করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে মর্তুজা ভাইয়ের দম ফুরিয়ে এসেছে, কমান্ডের সাথে সাথেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

ট্রেনিং ক্যাম্পে আর একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। জয়দেবপুরের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মানব কুমার গোস্বামী মানিক মহা বিপাকে পড়েছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ছোঁড়ার প্র্যাকটিস করতে গিয়ে। এক চোখ বন্ধ করে নিশানা তাক করতে হয়। কিন্তু মানিক এক চোখ বন্ধ করতে পারতোনা। এক চোখ বন্ধ করতে গেলে তার দু‘চোখই বন্ধ হয়ে যেতো। ভারতীয় আর্মির ইন্সট্রাক্টর ধমক দিয়ে হিন্দিতে বলতো, ‘তুম কিয়া মরদ হায়, লারকিকো কাভি আঁখ নেই মারা।‘

জোঁক ভর্তি নদীতে গোসল

ট্রেনিং ক্যাম্পের আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়লে গা এখনও শিহরিয়ে উঠে। ক্যাম্পের পাশে বয়ে যাওয়া একটি সরু নদীতে আমাদের গোসল করতে হতো। ঐ নদীর পানিতে ছিল বড় বড় জোঁক। আমরা লাফ দিয়ে জোঁকে গিজগিজ করা পানিতে নেমে কোন রকমে একটা ডুব দিয়ে উঠে আসতাম।

দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি

এক মাসের ট্রেনিং চলাকালে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষকরা একটি  দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। থ্রী নট থ্রী রাইফেল, সাব-মেশিনগান (এস এম জি), লাইট-মেশিনগান (এল এম জি) এবং টু-ইঞ্চ মর্টার পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি আমরা গ্রেনেড নিক্ষেপ, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করে ব্রীজ-কালভার্ট ধ্বংস করা এবং শত্রু সেনাদের অতর্কিতে হামলা বা এম্বুস করার যাবতীয় কলা-কৌশল রপ্ত করেছিলাম।

প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিয়েৎনামের মতো দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দীপ্ত শপথ নিয়ে আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলাম। আমাদের স্কোয়াড লীডার ছিলেন মাহবুব জামান। মাহবুব ভাই স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ঢাকসু) নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাহবুব ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা মুন্সিগঞ্জের টুঙ্গিবাড়ী থানার হাসাইল গ্রামে অবস্থান নেই।

১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজী দলবল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পন করার পর বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হলো। আমরা ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছি। পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী শহীদ মিনারের মিনারগুলো ভেঙ্গে ফেলেছিল। বিধ্বস্ত শহীদ মিনারের পাদদেশে তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলার মাটিতে আমরা দেশ গড়ার শপথ নিয়েছিলাম। শহীদ মিনারে আমাদের বিজয় উল্লাসকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন ফটো সাংবাদিক রশীদ তালুকদার।

চল্লিশতম বিজয় দিবসের মধুর স্মৃতি

১০ বছর আগে ৪০তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকা পৌঁছার পর পরই  আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গ্রূপ কমান্ডার মাহাবুব জামান ফোনে জানালেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪০তম বিজয় দিবস উপলক্ষে ৪০ টাকার স্মারক নোট এবং ১০ টাকার রুপার স্মারক মূদ্রা রিলিজ করবে। ঐ নোটের ও কয়েনের একপাশে জাতির জনকের ছবি এবং অন্য পাশে শহীদ মিনারে আমাদের গেরিলা স্কোয়াডের বিজয় উল্লাসের ছবি অছে। মাহবুব ভাই আরও জানালেন যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিয়ার রহমান একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মারক নোট এবং কয়েন উদ্ভোধন করবেন এবং ঐ অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ জানাবেন ।

উল্লেখ্য, স্মারক নোট এর ছবি নির্ধারণের জন্য গঠিত কমিটি ঐ ছবিটি নির্বাচিত করেছিল।

শুধু তাই নয়, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় বিলবোর্ডে আমাদের ঐ ছবিটি ব্যবহার কর হয়। চিটাগাং গিয়েও দেখি ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে ঐ ছবিটি স্থান পেয়েছে। ঢাকায় রয়টার্সের ফটোগ্রাফার রফিকুর রাহমান জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে আমাকে বিজয় স্মরণীতে নিয়ে গিয়ে একটি বিলবোর্ডের সামনে আমার ছবি তোলেন।

লন্ডন, ১৬ডিসেম্বর, ২০২১

(আবু মুসা হাসান: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীন সাংবাদিক। ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্য। সত্যবাণী অনলাইন নিউজ পোর্টালের উপদেষ্টা সম্পাদক।)

You might also like