মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুর: প্রথম প্রতিরোধ ১৯ মার্চ, হানাদার মুক্ত ১৫ ডিসেম্বর
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
ঢাকাঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চে দেয়া ভাষণে ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, ’এই মন্ত্রবলে বলিয়ান হয়ে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ক্ষণকাল আগেই ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে (গাজীপুর) অকুতোভয় মুক্তিকামী বাঙালিরা সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সামনে প্রথমবার রুখে দাঁড়িয়েছিল। হাজার-হাজার জনগণ অবতীর্ণ হয়েছিল সেই সম্মুখযুদ্ধে।
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরের (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। এ খবর জানা-জানি হতেই বিক্ষুদ্ধ জনতা জয়দেবপুরে এক বিশাল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করলে অকুস্থলেই হতাহত হয় অনেকে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ।১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে প্রথম প্রতিরোধে শুরু হওয়া গাজীপুর হানাদার মুক্ত হয় ১৫ ডিসেম্বর সকালে।
মহান স্বাধীনতার একবছর পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে তাঁর হাতে লেখা একটি বাণী প্রদান করেছিলেন।বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন : “১৯৭১ সালের ১৯ শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে আরো একটি স্মরণীয় দিন। ঐ দিন পাক মিলিটারী বাহিনী জয়দেবপুরে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদের নীরস্ত্র করার প্রয়াস পেলে জয়দেবপুর থানা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের যৌথ নেতৃত্বে কৃষক, ছাত্র, জনতা সবাই বিরাট প্রতিরোধের সৃষ্টি করে। ফলে মিলিটারীর গুলিতে তিনটি অমূল্য প্রাণ নষ্ট হয় এবং বহু লোক আহত হয়।আমি তার কয়েকদিন মাত্র পূর্বে ৭ই মার্চ তারিখে ডাক দিয়েছিলাম, যার কাছে যা আছে, তাই দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোল। জয়দেবপুরবাসীরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আমি তাদের মোবারকবাদ জানাই । কোন মহৎ কাজই ত্যাগ ব্যতিত হয় না। জয়দেপুরের নিয়ামত, মনু, খলিফা ও চান্দনা চৌরাস্তায় হুরমতের আত্মত্যাগও বৃথা যায় নাই। শহীদদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। তাই আজ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।প্রথম প্রতিরোধের ঐতিহাসিক দিনটি কেমন ছিল?’ ওই সাহসী সময়ের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এই প্রতিবেদন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার এবং এস ফোর্সের প্রধান হিসেবে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধ নিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেছিলেন : ‘ব্রিগেড কমান্ডার প্রাসাদে (জয়দেবপুর রাজবাড়ি) ঢোকার সাথে-সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ল যে, বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী এসেছে। ফলে, উত্তেজিত ও বিক্ষুদ্ধ জনতা আবার অল্প সময়ের মধ্যে জয়দেবপুর রেলক্রসিং-এ এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একটা ভর্তি মালবাহী গাড়ি, যেটা তখন ময়মনসিংহ থেকে জয়দেবপুরে এসেছিল, তা দিয়ে রেলওয়ে ক্রসিং-এর উপরে বিরাট এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। একথা শোনার সাথে-সাথে বিগ্রেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জাহান জেব আবরার বাঙালি লে. কর্নেল মাসুদকে নির্দেশ দেন যে ২০ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা হোক। যদি কোন বাধার সৃষ্টি হয়, তবে যেন সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হয়।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রে (নবম খন্ড) গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধ নিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘সেদিন ছিল শুক্রবার এবং জয়দেবপুরে হাটবার। প্রায় ৫০ হাজার লোকের সমাবেশ ছিল সেখানে। জাহান জেব আরবাব তার বাহিনী নিয়ে এসে যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর বাকি সৈন্য রাজবাড়িতে থেকে যায়। ব্রিগেড কমান্ডার আসার সাথে সাথে মেজর মইনকে আদেশ দেয় সে যেন তার সেনাবাহিনীকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে এসে রেলস্টেশনে যাবার পথের উপর জনতাকে সামনে রেখে মোতায়েন করে। মেজর মইন তখন ব্রিগেড কমান্ডারকে বললেন যে, নেতারা আপনার সাথে দেখা করতে চান এবং এই উদ্দেশ্যে তারা এদিকে আসছেন। ব্রিগেড কমান্ডার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আই ডু নট ওয়ান্ট টু সি দেম. টেল দেম টু গেট এওয়ে এন্ড ডিপ্লয় ট্রুপস’ মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বাঙালি) নির্দেশ মোতাবেক সৈন্যদের মোতায়েন করার জন্য আদেশ দিচ্ছিলেন। এ আদেশ শুনে এবং সৈন্যদের গতিবিধিও ব্রিগেড কমান্ডার জাহান জেব আরবাবের ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে নেতারা পেছনে সরে যান। নেতাদের পেছনে সরে যেতে দেখে এপাশের জনতা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়লো। তখন ব্রিগেড কমান্ডার মেজর মইনকে নির্দেশ দেন জনতার উপর গুলি ছোঁড়ার জন্য। একদিকে তিনি নিজে মেজর মইনকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন কিন্তু অপর দিকে তিনি মেজর মইনকে কর্নেল মাসুদের নির্দেশ নিতে বলছিলেন। কর্নেল মাসুদ ওইখানে ছিলেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, টাঙ্গাইলে আমাদের যে কন্টিনজেন্ট ছিল তাদের খাদ্য নেওয়ার জন্য একটা ট্রাক (বেডফোর্ড) টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুর আসছিল। ওই গাড়ি বাজারের নিকট এসে এক বিরাট জনতার ভিড় দেখতে পায়। তারা ভেবেছিল যে আজ হাটবার তাই এত লোক। তারা এখানকার ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। হঠাৎ জনতার মধ্যে থেকে কিছু লোক তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং বলে যে, সামনে পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। তোমাদেরকে আমাদের সাথে যোগ দিয়ে পাঞ্জাবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। ট্রাকের মধ্যে ড্রাইভারসহ ৭ জন বাঙালী সৈন্য ছিল। তারা হতবুদ্ধি হয়ে কি করতে হবে কিছুই ঠিক করতে পারল না। জনতা পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় এবং একটি ঘরে তাদেরকে বন্ধ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়। অস্ত্রের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল এবং চাইনিজ এসএমজি ছিল। ড্রাইভার এবং কো-ড্রাইভার কোন রকমে পালিয়ে এসে বলে যে, আমাদের পাঁচজন সৈন্যকে জনতা বোধ হয় মেরে ফেলেছে এবং আমরা মারধর খেয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। তখন বিগ্রেড কমান্ডার হুকুম দেয়, ‘ফায়ার এন্ড ক্লিয়ার দ্য বেরিকেড’ মেজর মইন এই হুকুম পাবার পর প্রথম বিউগল বাজালেন এবং পতাকা উঠিয়ে গুলি ছোঁড়া হবে বলে মাইকে ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণায় জনতার মাঝে কোন ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়নি। তারপর তিনি জনতার মাঝে একজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দেন। এ আদেশ শোনার পর জনতার মাঝে একটু ভয় ও ভীতির সঞ্চার হয়। মেজর মইন যাকে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে বাংলায় বললেন যে, নিচের দিকে গুলি ছুড়ে দাও। যেহেতু গুলিটা গিয়ে একটা গাছের মধ্যে লেগেছে সেহেতু বিগ্রেড কমান্ডার এটা দেখে খুব রাগাম্বিত হলেন এবং নির্দেশ দিলেন, ‘ফায়ার ফর ইফেক্ট’ এবারও জনতার মধ্যে একটু নড়চড় হচ্ছিল। এবারও তিনি বাংলায় বললেন- উপর দিকে মেরে দাও। এবার যে গুলি করছিল, সে রাইফেলটাকে এমনভাবে উঠিয়ে ধরছিলো যে মনে হচ্ছিল সে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে দেখে মেজর মইন এবার ঠিকভাবে গুলি ছোঁড়ার নির্দেশ দিলেন। গুলি একজন লোকের গায়ে লাগে এবং সে মাটিতে পড়ে যায়। এর ফলে জনতা ছত্রভঙ্গ হতে থাকে। এ সময় জনতার মধ্য থেকেও ভীষণভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছিল। জনতার গুলিতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কিছুসংখ্যক সৈন্যও আহত হয়। এ সময় জয়দেবপুর বাজারে অবস্থিত মসজিদের উপর থেকে বিগ্রেড কমান্ডার জাহান জেব আরবাবকে লক্ষ্য করে এস-এমজি ফায়ার শুরু হয়। আমাদের সৌভাগ্যবশত: বিগ্রেডিয়ারের গায়ে তা লাগেনি।’
গাজীপুরে প্রথম প্রতিরোধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এক সাক্ষাতকারে স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন- ‘১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজীপুরের (সেই সময়ের জয়দেবপুর) জনগণ সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। দিনটি ছিল শুক্রবার। আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরের (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। একজন জেসিও (নায়েব সুবেদার) জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলের পুকুরে (জকি স্মৃতির প্রাইমারি স্কুলের সামনে) গোসল করার সময় জানান যে, ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চলে এসেছে। খবর পেয়ে দ্রুত আমাদের তখনকার আবাসস্থল মুসলিম হোস্টেলে ফিরে গিয়ে উপস্থিত হাবিবউল্লাহ ও শহীদউল্লাহ বাচ্চুকে এ সংবাদ জানাই। শহীদউল্লাহ বাচ্চু তখনই রিকশায় চড়ে শিমুলতলীতে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট ও সমরাস্ত্র কারখানায় শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুরে চলে আসার খবর দিলে এক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ চারদিক থেকে লাঠিসোঁটা, দা, কাতরা, ছেন, দোনলা বন্দুকসহ জয়দেবপুরে উপস্থিত হয়।
সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিল। জয়দেবপুর রেলগেটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্লিপারসহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেওয়া হয়। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরও পাঁচটি ব্যারিকেড দেয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ (পরবর্তীকালে সেনা প্রধান)। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম, তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে একটি কনভয় জয়দেবপুরে আসছিল। সে সময় কনভয়ে থাকা পাঁচজন সৈন্যের চায়নিজ রাইফেল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়।
এদিকে, রেলগেটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব আদেশ দেয়। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর সফিউল্লাহকে জনগণের ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের (জনতা) ওপর গুলি না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে আসতে থাকলে আমরা বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করি।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা, আহত হন ডা. ইউসুফসহ শত-শত মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনী কারফিউ জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। আমরা পিছু হটলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিষ্কার করে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করেন। আমরা সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নেই। কিন্তু পেছনে আর এক পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করলে হুরমত সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।’
জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ সশস্ত্র যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকলেছুর রহমান বাসসের গাজীপুর জেলা সংবাদদাতার কাছে প্রথম প্রতিরোধের বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে- ‘আমি বিজেও ৩৯৭৩৩ ওয়ারেন্ট অফিসার (অব.) মোকলেছুর রহমান ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪নং কোম্পানির ১২নং প্লাটুনের ১নং সেকশন কমান্ডার হিসাবে জয়দেবপুর সেনা ক্যাম্পে কর্মরত ছিলাম। এফ আই ও হাবিলদার হাবিবুর রহমান আমাদের খবর দিল যে, ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান ও সুবেদার রাজ্জাক আমাদের সাথে দেখা করতে চান। অতি গোপনে ১২ মার্চ সন্ধ্যায় জয়দেবপুর উল্কা সিনেমা হলের পিছনে আমাদের কয়েকজনের সাথে মিটিং করেন। সেখানে ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান সুবেদার রাজ্জাক হাবিলদার হাবিবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং ঢাকায় পাক বাহিনীর সমস্ত খবরা খবর আমাদের নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে এবং আমাদের বাঙালী অফিসারদের পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে। সেদিন জয়দেবপুর সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা এমএনএ মো. শামসুল হক, হাবিবুল্লাহ, আজিম উদ্দিন মাস্টার, শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খান, এমএ বারী, আব্দুস সাত্তার মিয়া, এএ মোতাল্লিবসহ আরো অনেকে মিটিং এর পর থেকে সার্বক্ষণিক তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে প্রতিদিন রাত ১০টার পর রানী বিলাসমনি হাইস্কুলে তাদের সাথে মতবিনিময় হয়েছে। এর মধ্যে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, হাবিবুল্লাহ, আয়েশ উদ্দিন, আলীম উদ্দিন বুদ্দিন, আব্দুর রউফ নয়ন প্রমুখ।
সৈনিকদের মধ্যে হাবিলদার মান্নান মঙ্গল মিয়া আমি ও নায়েক মোজাম্মেল ১৭ মার্চ বুধবার রাত ৮.২০মি. আজিম উদ্দিন মাস্টারের বাড়ির সামনে একটি চা দোকানের পেছনে সর্বশেষ মিটিং হয়। সেখানে ব্যাটিলিয়নের ২জন সিনিয়র এনজিও বিএইএম আলী আহম্মেদ ও সিএইচএম সোনা মিয়া তারা আমাদের অবগত করান। নবম ও ষোল ডিভিশন সৈন্য (কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন) ঢাকা এসে গেছে তার একটি ব্যাটেলিয়ন দু’ভাগে ভাগ করে কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এ খবর বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর রফিকসহ বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়েছে। তোমরা প্রস্তুতি নিয়ে নাও। যে কোন সময় তোমাদের উপর আক্রমণ হতে পারে এর পর ১৯ মার্চ শুক্রবার বেলা ১০টায় আমার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী আমাকে জানান যে, আমাদের অস্ত্র জমা নেয়ার জন্য ঢাকা ক্যান্টমেন্ট হতে বিগ্রেড কর্মান্ডারসহ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আসছে। আমি তৎক্ষণাৎ এ খবর সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের কাছে নায়েব সুবেদার চান মিয়ার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেই। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী আমাকে আদেশ দেন তোমরা এক প্লাটুন সৈন্য সিভিল ড্রেসে অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে সিভিলিয়নদের সাথে যোগ দিবে এবং রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুলবে যাতে কোন অবস্থায় বিগ্রেডিয়ার জাহান জেব আরবাব খান জয়দেবপুর রাজ বাড়িতে পৌঁছতে না পারে।
মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর আদেশ মোতাবেক আমরা আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ শামসুল হক, আ.ক.ম মোজাম্মেল হক ও হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন সিভিলিয়নদের সাথে যোগ দিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হতে জয়দেবপুর বাজার রেল গেইট পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করি। ফলে, বেলা ২টার পর পাকবাহিনীর সাথে আমাদের মধ্যে ফায়ারিং শুরু হলে এক মারাত্মক রণক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। আমরা ভাগ-ভাগ হয়ে সিভিলিয়নদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করি। এক পর্যায়ে ধান গবেষণাকে কেন্দ্রে ফাঁকা মাঠ দিয়ে জয়দেবপুর সেনা ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলে অনেক সৈন্য নিহত হয়। আমাদের মধ্যেও অনেকে আহত হন। মুন খলিফা এবং হুরমত নামের ২ যুবক অসীম সাহসিকতার সাথে ২ পাক সেনাকে অস্ত্রসহ ঝাপটিয়ে ধরে ফেলেন। অন্য সেনারা গুলি করলে ঘটনাস্থলেই দু’জন শহীদ হন। পাক সেনাদলকে আমরা সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত করি যার ফলে তারা আর রাজবাড়ীতে পৌঁছাতে পারে নাই। আমাদের রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কৌশল নির্ণয় করে সাথে-সাথে হেডকোয়াটার কোম্পানিসহ ৫টি কোম্পানিকে যুদ্ধের নির্দেশ দেন রাজবাড়ির সকল অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে যাই। পরে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট দ্বারা ৩নং সেক্টর গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু নির্দেশনায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী ক্যাপ্টেন এএসএম, নাসিম, ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী, লে. জিএম হেলাল মুর্শেদ খান, লে. সৈয়দ ইব্রাহিম, লে. আবদুল মান্নান ও মেজর নূরুল ইসলাম শিশুর নেতৃত্বে কার্যকলাপ অব্যাহত রাখি। এ ঘটনায় বিদ্রোহের আগুন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আওয়াজ উঠে জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’