লন্ডনে দুইদিনব্যাপী বইমেলা শুরু: ‘তৃতীয় বাংলা নয়, বিশ্ব বাংলা ধারণায়ই এখন এগুতে হবে’
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
সত্যবাণী
লন্ডন: সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য আয়োজিত বইমেলায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্ঠা ড. গওহর রিজভী বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালির সাম্প্রতিক ইতিবাচক উত্তাণ এখন খন্ডিত প্রবাসী নয়, বিশ্ব বাঙালি পরিচয়টিই সুদৃঢ় করছে। বাঙালীর সমৃদ্ধ সংস্কৃতিই মূলত বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই জাতিটিকে প্রতিনিয়ত উদ্ভাসিত করছে অনন্য উজ্জলতায়।
বইমেলা জাতীয় অনুষ্ঠানে আলোচক বা অতিথি হিসেবে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধীজিবীদের উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি মানানসই এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্ঠা গওহর রিজভী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এবিষয়ে কিছু স্মৃতিচারণও করেন তাঁর বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ৭৩/৭৪ সালের দিকে ঢাকায় একটি বইমেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে উদ্যাক্তারা বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে গেলে বঙ্গবন্ধু তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শণ করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহসহ তৎকালীন শীর্ষ শিল্পী সাহিত্যিকদের একটি তালিকা দিয়ে বলেছিলেন, বইমেলার মত একটি জ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান তখনই স্বার্থক হয়, যখন উপস্থিত সূধীজন শীর্ষ এমন জ্ঞানতাপসদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনার সুযোগ পায়। উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাদের উচিত তেমন জ্ঞানতাপস বুদ্ধীজীবিদের এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো, আমাকে নয়। ড. রিজভী বলেন, প্রযুক্তির এই যুগে বর্তমান প্রজন্ম যখন ইলেকট্রনিক ডিভাইসেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করছে, সেখানে এদের বইমূখী করতে আজকের এই বইমেলার মত অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য’র এমন মহতি আয়োজনের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইতিহাসবিদ ড. রিজভীর বিনম্র মন্তব্য, ‘আমার মত আলোচকের আলোচনার চেয়ে এসব অনুষ্ঠানে প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর সেই পরামর্শ ফলো করে অতিথি সিলেক্ট করা’।
রবিবার, ৪ঠা সেপ্টেম্বর পূর্ব লন্ডনের মাইল এন্ড আর্ট প্যাভিলিয়নে দুইদিনব্যাপী আয়োজিত এই বাংলাদেশ বই মেলা এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে লন্ডন ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জড়ো হয়েছিলেন কবি, সাহিত্যক, সংস্কৃতিকর্মী ও প্রকাশকসহ বিপুল সংখ্যক বইপ্রেমী মানুষ।
সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য’র সভাপতি ময়নূর রহমান বাবুলের সভাপতিত্বে এবং এ কে এম আব্দুল্লাহ ও মুনিরা পারভিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান শরীফ, কথা সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান, ঘুংঘুর সম্পাদক, কবি ডা. হুমায়ুন কবীর ও সাপ্তাহিক রোববার সম্পাদক, মুক্তিযাদ্ধা লেখক সৈয়দ তোশারফ আলী।
হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বইমেলা উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলা, বাঙালী ও বাঙালী জাতির জনক সম্পর্কে বিদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রজন্মের ব্যাপক আগ্রহ দেখে সত্যি আমরা আশাবাদী হই। সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্য’র আজকের এই উৎসবের মত আয়োজন গুলোই মূলত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্থে বসবাসরত আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই আগ্রহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। মেলায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের দেয়া স্টল ‘বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ন’ এ প্রদর্শিত বিভিন্ন বই পড়তে চাইলে বাংলাদেশ হাই কমিশনে বইপ্রেমীদের স্বাগত জানান সাইদা মুনা তাসনিম। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক প্রচেষ্টা ও বিশ্বাঙ্গনে ছড়িয়ে থাকা আমাদের শিকড়প্রেমীদের যৌথ প্রয়াসই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব সম্প্রাদায়ের কাছে দিনকে দিন সমাদৃত করছে।
এর আগে অনুষ্ঠানের জন্য পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বইমেলার সাফল্য কামনা করে বলেন, পেশাগত ব্যস্থতার কারনে অনুষ্ঠানে থাকতে না পারাটা আমার নিজেরই ক্ষতি। জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনার এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও ভবিষ্যতে কোন এক সময় আবার এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবো এমনটিই আমার আশা। নিজের বয়স ৮৯ উল্লেখ করে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, জীবনের শেষ প্রান্থে হলেও আশারাখি বইমেলার মতো এমন একটি ভবিষ্যত অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়তো পাবো।
অমর ২১শে গানের রচিয়তা আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে উৎসর্গ করা উৎসবে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উদীচি ও সত্যেন সেন স্কুল অফ পারফর্মিং আর্টস’র শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রথম বারের মতো সম্মিলিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পদক প্রদান করা হয় কবি নুরুজ্জামান মণিকে।
বাংলা একাডেমি সহ ১৫ টি বাংলাদেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। মেলার দ্বিতীয় দিনের আয়োজন নিয়েও কমিউনিটির মাঝে ব্যাপক উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই লন্ডনে বসে পছন্দের বই কিনতে পেরে আনন্দিত। সময় প্রকাশনীর কর্নধার ফরিদ আহমেদ বলেন, অনেক বই আমরা এক কপি করেই নিয়ে এসেছি, কারণ বই পরিবহণ অনেক ব্যয়সাধ্য আবার বিক্রি না হলে ফেরত নিয়ে যাওয়া ও অনেক কষ্টকর। তাই ইচ্ছে থাকলেও সীমিত বই নিয়েই আমাদের অংশ নিতে হয়।
প্রথম দিন বিকেল সাড়ে তিনটায় শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে বইমেলাটি।
আজ মেলার দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে রয়েছে প্রবাসী লেখকদের প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সামাজিক সংস্থা “আপাসেন এর বিশেষ শিশুদের পরিবেশনায় বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।