শ্রদ্ধাঞ্জলি: বাম রাজনীতির নিবেদিতপ্রাণ নেতা ডা: এম এ ওয়াদুদ
পরিতোষ দেবনাথ
বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম আদর্শিক প্রাণ পুরুষ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনৈতিক শিক্ষক, ন্যাপের নিবেদিত প্রাণ নেতা, গণমানুষের নেতা ডা: এম এ ওয়াদুদ ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন।
আজ তাঁর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের এই দিনে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে এই মহান নেতার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপরে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মদনপুরের সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদে। এই পরিষদ চত্বরে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের অন্যতম প্রিয় সহযোদ্ধা, প্রিয় মানুষ ছিলেন ডা: এম এ ওয়াদুদ। জীবদ্দশায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বহুবার বহুজনকে বলেছিলেন, তাঁকে যেন তাঁর প্রিয় মানুষটির পাশে কবর দেওয়া হয়। আমাদের প্রিয় নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের শেষ ইচ্ছে অপূরণীয় থেকে যায়। এমনকি অনেকে সোচ্চার থাকা সত্বেও সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ চত্বরে তাঁর মরদেহ নেয়া হয়নি।
সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ যেমন মনের টানে, প্রাণের টানে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আমিও মাওলানা ভাসানীর অনুপ্রেরণায় মদনপুরে সেটা করেছি।”
সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইদুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ শুরু থেকে যারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা: এম এ ওয়াদুদ । ১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অবিসংবাদিত নেতা পীর হবিবুর রহমান সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদের উদ্বোধন করেন।
এই প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণের প্রধান কান্ডারী ছিলেন ডা: এম এ ওয়াদুদ। বিভিন্ন রকমের বহু তথ্যসমৃদ্ধ দেয়ালচিত্র দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে তাঁর বক্তব্য ছিল অতুলনীয়, অবিস্মরনীয়।শিক্ষার্থীরা অভিভূত হয়েছেন, জ্ঞান অর্জন করেছেন । বাস্তব জীবনে অর্জিত জ্ঞান প্রগতির রাজনীতিতে প্রয়োগ করেছেন।
২০/২১, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দোতালায় ন্যাপ অফিস নির্মাণে ডা: এম এ ওয়াদুদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা । অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রেরণায় পীর হবিবুর রহমান, ডা: এম এ ওয়াদুদ, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, এম এ গনিসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অর্থ দিয়ে, কায়িক পরিশ্রম করে ন্যাপের অফিস নির্মাণ করেছিলেন।
ডা: এম এ ওয়াদুদ কলকাতার নীলরতন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবি পাস করেন। তিনি এবং তাঁর বন্ধু ডা: আহমেদ হোসেন, ডা: দীন মোহাম্মদ, ডা: তাজুল হোসেন, ডা: জোহরা কাজী প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক। ডা: প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর এম আর খান, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ প্রখ্যাত ডাক্তাররা ছিলেন তাঁর ছাত্র।
৪ সন্তানের জনক ডা: এম এ ওয়াদুদ ১৯১১ সালে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
ডা: এম এ ওয়াদুদের ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের বাসায় বহু গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বের দিন ৬ মার্চ ডা: এম এ ওয়াদুদের বাসায় বঙ্গবন্ধুসহ বাম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২৫ মার্চ দিনভর বাম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর বাসায় উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে চিরকূট আদান প্রদান করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করে কলকাতায় পার্টির নেতৃবৃন্দের কাছে পাঠিয়েছেন। জিয়া সরকারের সময়ে তিনি মন্ত্রিত্বের অফার প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ডা: এম এ ওয়াদুদ মার্কস-লেনিন- এঙ্গেলসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, “অসংগঠিত জনতা প্রকৃতির অন্ধ শক্তির (ঝড়-তুফান-বন্যা ইত্যাদি) মতো আচরণ করে । কখন কি করিয়া বসিবে ঠিক নাই। তাই দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষকে একটি সঠিক বিপ্লবী সংগঠনে সংগঠিত করিতে হইবে।”
ডা: এম এ ওয়াদুদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ন্যাপের প্রদর্শিত পথ, অধ্যাপক মোজাফফর আমাদের ধর্ম কর্ম গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্রই মুক্তির পথ । আমৃত্যু তিনি বাম রাজনীতির আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে গেছেন।
গরিবের চিকিৎসক হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি। সমাজ বিপ্লবের কথা না শুনে কোন রোগীর রেহাই ছিল না। কোন রোগীর ঔষধ কেনার টাকা নেই তো নিজের পকেটের টাকার দিয়ে ঔষধ কেনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই করে যেটুকু আয় হতো, তার অধিকাংশই পার্টি ফান্ডে দিয়ে দিতেন। আজকের সমাজে এমন মানুষ, এমন নেতা খুঁজে পাওয়া বিরল।
পরিতোষ দেবনাথ: রাজনীতিক ও সাংবাদিক