সামসুল আলম কেন আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু

 হামিদ মোহাম্মদ 

শুভেন্দু ইমাম ও আমি ছিলাম এক সময় মানিক জোড়। আমাদের আলাপ ছিল সব সময় সাহিত্য নিয়ে। বেশিরভাগ কবিতা জুড়ে থাকতো আলাপের সর্বত্র। এই  সময় যুক্ত হন কবি তুষার কর। অল্পদিনে ভিড়েন কবি আলী মোস্তাফা চৌধুরী। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রনেতা সামসুল আলম সিলেটে এক আড্ডায় এক দিনেই অন্তরঙ্গ। সময়টি বাহাত্তর থেকে আশি। ততদিনে আমি যুগভেরীতে কর্মরত। সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একাট্টা। শুভেন্দু ইমাম পড়তেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুভেন্দু ও সামসুল আলম অধ্যয়ন শেষে আশির দশকে সিলেটে থিতু হলেন। কবি তুষার কর, আলী মোস্তফা চৌধুরী, জিষ্ণু রায় চৌধুরী, পরীক্ষিত দত্ত চৌধুরী, নুরুজ্জামান মনি, আজিজ আহমদ সেলিম সবাই মিলে আমরা ছোটখাটো একটি গোত্র, এতে নিয়মিত হন শুভেন্দু ইমাম ও সামসুল আলম। দেশে সামরিক শাসন। আমরা এই সময়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার শুন্যতা নিয়ে ভাবতে থাকি। মনে হত দিনগুলো একটি কৃষ্ণগহবের নিমজ্জিত। সামরিক স্বৈরশাসন ও মৌলবাদের ছোবলে দেশের মানুষ হিমসিম। এই অবস্থায় আবার হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নিলেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। কিছু করার তৃষ্ণার দিগন্তে আবার কুঠারাঘাত। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ জড়ো হলাম বন্ধু আফতাব হোসেইনের বাসায়। বন্ধু একরাম উদ্দিন আহমদ ছিলেন আমার দীর্ঘ দিনের একসাথে থাকার সাথী। তিনিও যোগ দিলেন আমাদের সাথে। জন্ম হল এরাতেই ‘শিকড় সংস্কৃতি চক্র’, এক কথায়  ডাকা হত শিকড়।

সিলেটে স্থবির হয়ে পড়া সাংস্কৃতিক জগতকে প্রগতিশীল ধারায় প্রবাহিত করতে তখন থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। আন্দোলনমুখী নানা কর্মসূচী পালন, স্বৈরাচার ও মৌলবাদ বিরোধী কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও সেমিনার আয়োজনে যুক্ত হন সিলেটের প্রগতিবাদী শিক্ষাবিদ, চিন্তক, লেখক, কবি, শিল্পী, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। মজিদখান শিক্ষাকমিশন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৪ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আমরা সিলেট প্রেসক্লাবে একটি সেমিনার ‘শিকড়’ থেকে আয়োজন করি।‘মধ্য ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি’ নামে নিবন্ধ পাঠ করেন সামসুল আলম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধীজন এ নিবন্ধকে অত্যন্ত দিক নির্দেশমূলক বলে মন্তব্য করেন।

সিলেটে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন সদ্য প্রয়াত সামসুল আলম

এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈয়দ এনামুল ইসলাম কবি মোহাম্মদ রফিকের ‘খোলা কবিতা’র একটি মুদ্রিত কপি আমাদের কাছে পাঠান ‘৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে। আমরা তখন একুশে অনুষ্ঠান আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছি। কবিতাটি পেয়ে আমরা আরো উদ্দীপ্ত হই। সামরিক শাসন বিরোধী এই কবিতা রেজিস্ট্রি মাঠে শিকড় আয়োজিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উন্মুক্ত অনুষ্ঠান’ এ শামীমা চৌধুরী আবৃত্তি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে  শিকড়-এর কর্মকান্ডে যোগ দেন সৈয়দ এনামুল ইসলামও।

শিকড়-এর প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে শুভেন্দু ইমাম ও আমি হামিদ মোহাম্মদ থাকলেও অন্যতম মেধা শক্তি ছিলেন সামসুল আলম। তাঁর অনেক মূল্যবান কথা, দ্বিধাহীন সাহসী উদ্যোগ ও দিকনির্দেশনা  আমাদের যে কোন জটিল কাজকে শাণিত করতে সহায়ক ছিল। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল দুর্বার হয়ে ওঠার পেছনে প্রাণশক্তি। সেই সময় তাকে আমরা পাই আমাদের মাঝে একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শুধু নয়, একজন শ্রেষ্ঠ সংগঠক ও মানুষ হিসেবে। শিকড়-এর  পরবর্তী চার দশকের আন্দোলন সংগ্রামে সামসুল আলম বিভেদহীনভাবে জড়িত ছিল। আমরা আজ আমাদের এই শ্রেষ্ঠ বন্ধুটিকে হারিয়ে নি:স্ব, হতবিহবল।

আমাদের এই প্রিয় বন্ধু সামসুল আলম ২০২২ সালের ১৭ জুন আমাদের ছেড়ে গেল। আর আমরা অন্য বন্ধুরা মুক ও বিমূঢ় হয়ে আজ নানা কথাই বলছি। স্মৃতি রোমন্থন করে দেখছি কে কী করেছি বা করছি। আমরা সকলেই ক্ষুদ্র মানুষ। এই ক্ষুদ্র মানুষদের মাঝে সামসুল আলম বড় মানুষই ছিল।

জীবনের প্রশ্নে সামসুল আলম সল্পকালের শিক্ষকতা করেন তাজপুর কলেজে। কিন্তু রাজনীতির টানে সরে পড়েন সে পেশা থেকে। ক্ষেতমজুর সমিতির আন্দোলন সংগ্রামে ডুব দেন। যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টিতে। স্বৈারাচার বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের জ্বলন্ত দিনে তাকে বেশিরভাগ রাজপথেই দেখা যেতো।

১৯৮৭ সালে  আমি, সামসুল আলম ও সৈয়দ রকিব আহমদ আমরা তিনজন লন্ডনে আসি। এসে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর শাখা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই। সামসুল আলম থাকতেন পূর্ব লন্ডনের সিকসেন স্ট্রিটে একটি বাসায়। এখানে সামসুল আলমের সভাপতিত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ও উদীচী যুক্তরাজ্য শাখা গঠনের দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার  সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তীতে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি ও উদীচীর শাখা গড়ে তুলি। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন নিখিলেস চক্রবর্তী ও  সৈয়দ বেলাল আহমদ।

সামসুল আলম এক পর্যায়ে থিতু হন সিলেট ওভারসিজ সেন্টারের নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে। খুব বড় চাকরি নয়, কিন্তু দায়িত্ব বড়। এখানেই শুরু হয় বড় পরীক্ষা। ওভারসিজ সেন্টারে বিনা ফিতে প্রবাসীদের সামসুল আলম পরামর্শ দেয়ার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। সামসুল আলম পারতেন সেখানে নামমাত্র পরামর্শ দিয়ে ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে ব্যবসা জুড়তে। বিদেশপ্রত্যাশী মূলত বিলেত প্রবাসীদের নানা সমস্যার সমাধান বা সহায়তা দিয়ে বিস্তর কামাই করা খুব সহজ ছিল। কিন্তু তা সামসুল আলম করেননি। বরং অনেক প্ররোচনা থেকে হাসিমুখে নিজেকে সরিয়েছেন। কুয়েত যুদ্ধের অভিঘাতে আমাদের সিলেটের কয়েক লক্ষ প্রবাসী যখন  ফিরে আসে এবং পরে জাতিসংঘের ব্যবস্থায় পুনর্বাসন কার্যক্রম চলে তখন সামসুল আলম প্রবাসীদের মুখে হাসি ফোটাতে যে শ্রম দেন তা ছিল অনেকটা তার সীমিত পেশার বাইরেও দৃশ্যমান। সামসুল আলম পারতেন অর্থকড়ির বিনিময় নিয়ে সে সেবাদান করার পথে হাঁটতে। তা করার কথা তাঁর মাথায় কেউ ঢুকিয়ে দিতে পারেনি, যদিও সুযোগটা ছিল শতভাগ। এখানেই সামসুল আলম একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমরা দেখতে অভ্যস্ত আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে এরকম দৃশ্য। সরকারি চাকরি করেন যে সব চিকিৎসক তারা প্রাইভেট প্র্যাক্টটিস শুধু করেন না, তারা হাসপাতাল খুলে কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করছেন। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালমুখী করার জন্যই যেন তারা  সরকারি হাসপাতালে চাকরিটা ধরে রেখেছেন, ধারণা করা নয়, শতভাগ সত্য। ওভারসিজ সেন্টারে বিনা ফিতে সেবা না-দিয়ে সামসুল আলম সে পথে হাঁটলে কেউ  কোন সমালোচনাই করতো না। কিন্তু সামসূল আলমের  যে, সে শিক্ষা ছিল না। সামসুল আলম এখানে একজন ক্ষুদ্র মানুষ হলেও প্রকৃত মানুষ হিসাবে সমাজকে সেবা দিতে দ্বিধান্বিত হননি, নিজেকে বিক্রয় করেননি  কোন লোভের কাছে, অনৈতিক হাতছানির কাছে।

সামসুল আলম কেন আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু ছিল বা আছে, সেটা আজ তাঁর তিরোধানের পর আরও বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। বার বার তাঁর মুখ, চেহারা, তাঁর প্রাণখোলা হাসি ভেসে উঠছে চোখে।

জীবদ্দশায় সামসুল আলম আমাকে তাঁর অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দু:খ ও কষ্টের কথা ভাগাভাগি করতো, তবে কারো প্রতি অভিযোগ ছিল না। জীবনের স্বচ্ছতার কথাই ছিল এসবের পেছনে। আমিও অনেক অমীমাংসিত বিষয়ের সাথী, পরামার্শক হিসেবে সামসুল আলমের নৈকট্য লাভে তৃপ্তি পেতাম। এই তৃপ্তি যেন শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, উপলদ্ধি করতে পারি তাঁর আপসহীন চেতনাকে, সে আনন্দ ভাগ সবার সাথে করতেই এই লেখা।

হামিদ মোহাম্মদ: কবি, সাংবাদিক ও সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট

 

You might also like