সিলেটের ঐতিহ্যঃ জিয়াফত ————

মোহাম্মদ ইকবাল লতিফঃ
সুদুর প্রবাসে ব্যস্ত সময়ের মাঝেও মনের মুকুরে ভেসে আসে আমাদের শৈশব, কৈশোরকালের ফেলে আসা বিভিন্ন স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন প্রথা, ঘটনা, প্রচলিত অনুষ্ঠান ইত্যাদি যেনো মন থেকে দেখতে পাই আর স্মৃতি রোমন্তন করি।
আজ যে বিষয় নিয়ে লিখবো, তা হলো আমার স্মৃতিতে আমাদের সিলেটের বিলুপ্তপ্রায়একটা অনুষ্ঠান, যাকে আমরা ‘জিয়াফত’ বলতাম। আর অন্য জেলাগুলোতে কেউ ‘মেহমানি বা মেজবানি’ বলে থাকেন।
জিয়াফত সাধারণত কারো মৃত আত্নীয়-স্বজনের নামে শিরনি, আকিকা, খতনা অথবা মেয়েদের কান দাগা বা কান ফোঁড়ানো ইত্যাদি অনুষ্ঠান করার জন্য সমাজের বিত্তশালীরা এর আয়োজন করতেন।
আমি আমার ছোটবেলার সত্তর/আশির দশকের কিছু স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
এই অনুষ্ঠানগুলি সাধারণত শীতকালে শুকনো মৌসুমে যখন ধান ও অন্যান্য ফসল তোলা শেষ হয়ে যেতো, বাচ্চাদের স্কুল পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো, সকলের কাছে অফুরন্ত সময় থাকতো, তখনই এর আয়াজন করা হতো।
প্রথমেই আয়োজনকারী পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করে কত লোক দাওয়াত দেয়া হবে, কোন কোন গ্রাম বা পাড়ার লোক দাওয়াত দেয়া হবে, এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হত। এই বৈঠক থেকেই এলাকার বিভিন্ন স্তরের লোকজন স্ব-প্রণোদিত হয়ে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে নিতেন। এ যেন সকলের নিজের অনুষ্ঠান। শুরু হতো মহা অনুষ্ঠানের মহা আয়োজন।
অনুষ্ঠানের ২/৩ দিন আগে থেকেই ঐ বাড়িতে নাইওরীদের আগমনে আনন্দ, হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে যেতো। আগের দিন আয়োজক তার আত্মীয় আর প্রতিবেশী নিয়ে গরুর হাট থেকে গরু কিনে আনতেন। বাড়িতে গরুর আগমনে উৎসবের মাত্রা আরও বেড়ে যেতো। বাচ্চারা এই নতুন গরুকে খুব যত্ন করে খাওয়াতো আর নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করতো।
অনুষ্ঠানের আগের সন্ধ্যায় কসাই (সিলেটি ভাষায় বা খালুয়া) ছুরি-চাকু আর সহযোগীদের নিয়ে আসতেন। এদিকে গরু জবাইকে ঘিরে প্রতিবেশি মুরব্বী ও যুবকরা নিজ নিজ বাড়ি থেকে দা-ছুরি নিয়ে আসতেন স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করার জন্য। গৃহকর্তা বা মসজিদের ইমাম গরু জবাই করতেন আর সবাই মিলে মাংসগুলো কেটেকুটে সুন্দর করে ধোয়ামোছা করে পরিস্কার করে রাখতেন। বিকেল থেকেই চলতো চা আর কাটাতুছ (টোস্ট বিস্কুট)।পান্দানতো অত্যাবশ্যক। তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লোকজন আসতেন তদারকি করার জন্য। চলতো নানা গালগল্প, স্মৃতিকথা, ময়মুরুব্বিদের ভালোবাসার আর আন্তরিকতার কথা। রাতেই ঐ বাড়িতে জিয়াফতের জন্য জবাই করা গরুর কলিজা আর পঞ্চা (গরুর পুরো পায়ের হাড়গোড়) রান্না করে মেহমানদের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো, সাথে গ্রামের কিছু প্রতিবেশিদেরও খাবার দেয়া হতো। ইতিমধ্যে বাবুর্চি তার সহযোগীদের নিয়ে বাড়ির উঠানে বা আশেপাশে কোথাও মাটিতে গর্ত করে ইট দিয়ে কয়েকটা চুলা তৈরি করে লাকড়ি সহকারে আগুন দিয়ে রান্না শুরু করেন। রাত ১০ টার পর থেকে, বড় বড় পিতলের বা খাসার ডেকসি (হান্ডি) সংগ্রহ করা হতো মসজিদ বা বিভিন্ন বাড়ি থেকে। এইসব বড় বড় ডেকছিতে খোদাই করে মালিকানা নাম লেখা থাকতো। আমাদের বাড়ির ডেকছিগুলোতে আমাদের পুর্বপুরুষের নাম লেখা ছিল। তবে নামের পুর্বে শ্রী শ্রী লেখা থাকতো। ওই আমলে মুসলমানদের নামের সাথে এটা প্রচলিত ছিল। গ্রামে বা মহল্লায় বিদ্যুৎ ছিল না। পাম্প করে জ্বালানো যায় পেট্রোমাস লেন্টন যোগাড় করা হতো। মাটির হানকি (সানকি বা প্লেট)আর টিনের গ্লাস স্তুপ করে রাখা হতো।
সারারাত থেকে চলে রান্না-বান্না। সত্তর দশকে জেয়াফত-এ শুধু সাদা ভাত আর মৌসুমের নতুন বড় বড় আলু দিয়ে গরুর মাংস রান্না করা হতো আর ডানোর গুড়ো দুধ দিয়ে রাত ১০টার দিকে মাটির পাতিলে দই বসানো হতো। ৭/৮ ঘন্টায় এই জমানো দইগুলো অত্যন্ত সুস্বাদু হতো।
এদিকে বিকেলেই নীচে ও উপরে ত্রিপাল দিয়ে বাড়ির উঠোনে বা সংলগ্ন জমিতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। মাটিতে ত্রিপাল রেখে তার উপর সোজা বাঁশ দিয়ে লাইন নির্ধারণ করা হতো, সবাই এই বাঁশের আসনে বসেই খেতেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে অবশ্য ডেকোরেটার্সের সামিয়ানা, চেয়ার-টেবিলের প্রচলন হয়। তবে বাঁশের আসনে বসে খাওয়ার আমেজটাই ছিল ভিন্ন।

জিয়াফত সাধারণতঃ সকাল ৭টা থেকে শুরু হতো, যাতে করে খাওয়া-দাওয়া করে কর্মজীবী সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে পারেন।
এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে মুরব্বীরা সবাইকে ডেকে ডেকে দলে দলে নিয়ে আসতেন। সাদা ভাত অথবা আখনি সাথে আলু দিয়ে গরুর মাংসের তরকারি আর সাদা ভাতের সাথে বাবুর্চির তৈরী পাতিলের দই দিয়ে খেতেন। কেউ কেউ অবশ্য সাদা ভাত গরুর মাংস আর দই মাখিয়ে এক সাথে খেতেন। এটার স্বাদটাও অন্যরকম। অবশ্য কিছু ফরেজির (অসুখ-বিসুখ বা নানা কারণে যাদের গরুর মাংসে মানা আছে) জন্য মোরগের মাংস বা মাছের তরকারির সীমিত ব্যবস্থা থাকতো। জিয়াফতের খাবারের অনন্য এবং অসাধারণ স্বাদ আর প্রতিবেশী ও স্বজনদের মিলনমেলা যেন সারাদিন গ্রামটি উৎসবমূখর হয়ে থাকতো।
এখন জামানা আর প্রথা বদলে গেছে। এইসব অনুষ্ঠান হয়, তবে এখন আর ওই রকম আন্তরিকতার জিয়াফত হয় না। যান্ত্রিকজীবনে পার্টি হয়। হয়তোবা কোন স্টার হোটেলে বা কমিউনিটি সেন্টারে। যেখানে গ্রামের ও গরীব আত্মীয়-স্বজন যেতে সাহস পায় না, দাওয়াত পায় না। এসব অনুষ্ঠানে থাকে হরেক রকম স্ট্রাটাস, মেইন কোর্স, ডিজারট, নানান রকম পানীয়, মিষ্টি আর পানীয়। তবে থাকেনা জিয়াফতের মত সেই আন্তরিকতার আমেজ।
আহা, সেইসব দিনগুলো!
শুধু মনে হয়….
দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
সে যে আমার নানা রঙের দিনগুলো।।

লেখকঃ-
কমিউনিটি লিডার ও বেতার উপস্থাপক
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
গ্রামের বাড়িঃ লাউয়াই (দালানবাড়ি), ২৯ নং ওয়ার্ড
সিলেট সিটি কর্পোরেশন, সিলেট, বাংলাদেশ।
তারিখঃ ২০.০২.২০২৪ খ্রিঃ

You might also like