স্বপ্নের পদ্মা সেতু : পিরোজপুরে উচ্চ শিক্ষা কর্মসংস্থান পর্যটন পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে বয়ে আনবে সাফল্য
নিউজ ডেস্ক
সত্যবাণী
পিরোজপুর: পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা পিরোজপরে উচ্চ শিক্ষা কর্মসংস্থান পর্যটন পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে বয়ে আনবে আভাবনীয় সাফল্য।বাঙ্গালী জাতির স্বপ্নের পদ্মাসেতুটি উদ্বোধনের মুহুর্তটি যতই ঘনিয়ে আসছে সারা দেশের বিশেষ করে পদ্মার এপাড়ের ২১ জেলার মানুষ ততই আবেগে আনন্দে উত্তেজনায় শিহরিত হচ্ছে। সেতুর লৌহজং প্রান্ত থেকে ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর গাড়িটি বিশ্বের উত্তাল খরস্রোতা নদীর শীর্ষে থাকা পদ্মা নদীর উপর দিয়ে অতিক্রম শুরু করার সাথে সাথে বাংলাদেশসহ সারা বিশে^র বাঙ্গালীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবে। জয় বাংলা- জয় বঙ্গন্ধু স্লেøাগানে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হবে। শেখ হাসিনা এগিয়ে চল- আমরা আছি তোমার সাথে, আমার টাকায় আমার সেতু-নামটি তার পদ্মাসেতু স্লোগান উঠবে মাঠে ঘাটে প্রান্তরে। এ আনন্দের উচ্ছাস বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পন, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসা, ১৭ মে আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা দেশের মাটিতে পদার্পণ এর আনন্দঘন মূহুর্তের মতই আমাদের গৌরবের ইতিহাসে আরো ১টি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হবে।
দেশের দক্ষিণের সর্বশেষ জেলাগুলোর ১টি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পিরোজপুর জেলা। বাংলাদেশের মানুষের সামর্থ্যরে পদ্মাসেতু। এ সেতু নিয়ে পিরোজপুরের সর্বত্র চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পর্যটন, পরিবহন, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, ফলমূল, শাকসবজি খাতের ব্যাপক প্রসারে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এ জেলার ১৮ লক্ষাধিক নর-নারী। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ৯৯১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৬৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩৮৮টি মাদ্রাসা, ৪০টি মহাবিদ্যালয় এবং ১২টি কারিগরী মহাবিদ্যালয়।একাদশ সংসদের গত অধিবেশনে পিরোজপুরে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় আইন পাশ হয় এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পিরোজপুর-১ আসনের এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এর ঐকান্তিক দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এ বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয়টির চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়। এ বিষয় জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতু চালুর পরে আমাদের এ জেলায় উচ্চ শিক্ষার হার দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাবে, সাথে সাথে সারাদেশেও এ বিশ^বিদ্যালয়টির প্রভাব পড়বে এ কারণে যে, দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে এ সেতুটি অতিক্রম করে অতি সহজেই পিরোজপুর এসে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারবে এবং অনুরূপভাবে এ জেলার শিক্ষার্থীরা দেশের যেকোন স্থানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য সহজেই যেতে পারবে। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আরো জানান, অতি শ্রীঘ্রই এ বিশ^বিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হবে। সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আলী আজম জানান, পদ্মাসেতু চালু হলে এবং বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু হলে শুধু পিরোজপুর নয় সমগ্র দক্ষিণঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কর্মসংস্থানের বিষয়ে পিরোজপুর জেলার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দি পিরোজপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এর সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা নকীব জানান পদ্মা সেতু এ জেলার জন্য অনেকগুলো সুফল বয়ে আনবে এবং এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কর্মসংস্থান, পর্যটন ও পরিবহন। তিনি বলেন পিরোজপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ আসনের সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সফলতার দারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। পদ্মানদী পারের সীমাহীন দুূর্ভোগ লাঘব হওয়ায়, এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান শিল্প কারখানা স্থাপন করবে এবং এর ফলে আমাদের এ জেলাসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে।পদ্মাসেতু পিরোজপুরের পর্যটন শিল্পকে কতটা এগিয়ে নিতে পারবে এ নিয়ে জানতে চাইলে দৈনিক ইত্তেফাকের ষ্টাফ রিপোর্টার মনিরুজ্জান নাসিম আলী বলেন দীর্ঘদিন ধরে পিরোজপুরে পর্যটন শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে অনেক রিপোর্ট ছেপেছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় পর্যটকরা ৪/৫ ঘন্টা বসে থেকে ফেরি পার হয়ে এখানে আসা-যাওয়ায় আগ্রহী হত না। এ সমস্যাটা দূরীভূত হওয়ায় বাংলার আপেলখ্যাত পিরোজপুরের নেছারাবাদের বিশাল পেয়ারা বাগান, কাউখালীর সু-স্বাদু আমড়া বাগান, কাউখালীর বিশ^খ্যাত শীতল পাটি পল্লী, মঠবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মমিন মসজিদ, পিরোজপুর সদরের ঐতিহ্যবাহী রায়েরকাঠী জমিদার বাড়ি ও এশিয়ার সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ ও সারিসারি শিবমন্দির, ডিসি পার্ক, নাজিরপুরের পানিতে ভাসমান সবজি, ভান্ডারিয়ার হরিণপালার ইকোপার্ক, ইন্দুরকানীর নিঃস্বর্গ সবুজ পার্ক, মঠবাড়িয়ার মাঝের চরের বনায়ন, বড় মাছুয়া স্টিমার ঘাট সংলগ্ন বলেশ^র নদীতে শত শত নৌকায় ইলিশ আহরণ, হুলারহাটের প্যাডেল ষ্টীমার, কবি আহসান হাবিবের বসতবাড়ি, পাড়েরহাটের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও সুটকী পল্লী, নবনির্মিত বেকুটিয়া ব্রীজসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এমন স্থানগুলো পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে। সাথে সাথে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে দ্রুত গতিতে, বাড়বে কর্মসংস্থান, আর্থিকভাবে লাভবান হবে এলাকার লাখ লাখ মানুষ।
পরিবহন ব্যবস্থার ব্যাপক আধুনিকায়ন হবে পদ্মা সেতু চালু হলেই। এতদিন পিরোজপুর থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে লক্কর-ঝক্কর গাড়ি চলাচল করত। জেলা বাস মালিক সমিতির কার্যকরী সম্পাদক রতন চক্রবর্তী জানান ইতোমধ্যেই ঈগল, হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ পরিবহনের মত খ্যাতনামা পরিবহন কোম্পানীর গাড়ি পিরোজপুর থেকে গাড়ি চালানোর অনুমতি চেয়ে জেলা বাস মালিক সমিতির সাথে যোগাযোগ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানীর শতাধিক অত্যাধুনিক বাস এখন থেকে পিরোজপুর- ঢাকা, পিরোজপুর-চট্টগ্রাম, পিরোজপুর-নারায়নগঞ্জ, পিরোজপুর-গাজীপুর, পিরোজপুর-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচল করবে। বিআরটিসি’র নতুন-নতুন গাড়িও এরুটে চলাচল করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে। এর ফলে একদিকে যেমন যাতায়াতকারীরা আরাম-আয়েসে চলাচল করতে পারবে অন্যদিকে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
গাভীর খামার করে স্বাবলম্বী হওয়া পিরোজপুর শহরতলীর আলমগীর হোসেন জানান এখন থেকে অতি সহজেই জেলার খামারীরা গাভীর দুধ সংগ্রহ করে ঢাকার রথখোলার দুধের আড়তসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে ৪/৫ ঘন্টায় পৌছে দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে। একইভাবে মাছ, সবজি, পেয়ারা, আমড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের ফলমূল চাষিরা এবং পাইকাররা সরাসরি রাজধানীতে তাদের উৎপাদিত অথবা ক্রয়করা পণ্য নিয়ে বিক্রি করতে পারবে। পিরোজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণ জমিতে পানের বরজ রয়েছে। রায়েরকাঠী গ্রামের পানচাষি সুধির হাওলাদার জানান বরজে বসে পাইকারদের কাছে পান বিক্রি করে এতদিন খুব একটা লাভ হত না, এখন পদ্মা সেতু হওয়ায় বরজ মালিকরা সরাসরি বাসের ছাদে করে বা ট্রাক/পিক-আপ ভ্যানে করে ঢাকার শ্যামবাজারের সবচেয়ে বড় পানের আড়তে পান বিক্রি করে অনেক লাভবান হতে পারে।