আমি কলকাতা বইমেলা বলছি
দিলীপ মজুমদার
এতদিন পরে আমি আমার নিজের ঘরে থিতু হতে পেরেছি । মাথার উপর ছাদ তো সকলেরই দরকার । এবার আমার মাথার উপর সেই ছাদ হয়েছে । আর আমাকে ঘুরে বেড়াতে হবে না । তাড়া খেতে হবে না । এবার আমার নিজের ঘরে বইমেলা হয়ে গেল । সেন্ট্রাল পার্কের বইমেলা চত্বর এখন ফাঁকা । এবার নাকি রেকর্ড বিক্রি হয়েছে । প্রকাশকরা খুশি । খুশি মনে বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা । আবার একবছর অপেক্ষা করতে হবে ।সকালবেলা ফাঁকা মাঠে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে । আমি সেই ফাঁকা মাঠে পা ছড়িয়ে বসে স্মৃতি রোমন্থন করছি । মনে করার চেষ্টা করছি আমার ঠিকুজি-কোষ্ঠী । আমার পূর্বপুরুষ কিন্তু জার্মানির লোক । জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের বইমেলাই আদি বইমেলা । কেউ কেউ লিপজিগের নাম করেন । সেটা ঠিক নয় । ছাপাখানা আবিষ্কার করেছিলেন যিনি সেই জোহানস গুটেনবার্গের বাড়ি ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে মেঞ্জ শহরে । গুটেনবার্গের জন্য পৃথিবীতে এল বই । সেই বই নিয়ে হল বইমেলা । আজ থেকে পাঁচশো বছর আগের কথা এসব । তারপরে লণ্ডনে , কায়রোতে , আবুধাবিতে , আমেরিকায় , হংকংএ শুরু হয়ে যায় বইমেলা ।
আমার কথা শুনতে শুনতে তোমরা কেউ কেউ মনে মনে বলছ , বইমেলাভাই , তোমার আয়ু তো খুব বেশি নেই । তোমরা ই-বুকের কথা বলছ তো ! কিন্তু জেনে রাখো , ছাপা বইকে ই-বই এখনও মেরে ফেলতে পারে নি । যাক সে কথা । পূর্ব পুরুষের গর্ব না করে এবার নিজের কথা বলি । ১৯৭৬ সালে জন্ম হয়েছে আমার । কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কথা জানো তো ! শোনো তবে । আজ থেকে একশো বছর আগের কথা । ১৯১৮ সাল । এপ্রিল মাস । বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে পালন করা হয় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ । সেই অনুষ্ঠানে দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল –একটি শিল্প প্রদর্শনী , আর একটি পুস্তক প্রদর্শনী । কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে । সেই পুস্তক প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালা লাজপত রায় , গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , বিপিনচন্দ্র পাল , সতীশচন্দ্র মুখার্জী, নীলরতন সরকার , চিত্তরঞ্জন দাশ , অরবিন্দ ঘোয ।
আরও একটি ঘটনার কথা বলি তোমাদের । ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাস । মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরের রঘুনাথগঞ্জে আয়োজন করা হয়েছিল এক বইমেলার । সাতদিন চলেছিল মেলা । প্রতিদিনের একটি করে নামকরণ করা হয় , যেমন রবীন্দ্র দিবস , নাট্য দিবস , সংবাদপত্র দিবস ইত্যাদি । এই মেলায় এসেছিলেন উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য , বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় , কানু ব্যানার্জী , কবিয়াল গুমানি দেওয়ান । মেলার আয়োজকরা চমৎকার এক স্মারক পুস্তিকা প্রকাশ করেন ।
১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ বেলা সাড়ে তিনটেয় আমি জন্মগ্রহণ করলাম কলকাতার ময়দানে । তখনকার রাজ্যপাল আমার জন্মের ঘোষণা করলেন । আমি চোখ মেলে তাকালাম । এই সেই ময়দান যেখানে কত মিছিল এসেছে , কত জনসভা হয়েছে । অনেক সংগ্রাম , অনেক শপথ , অনেক স্লোগানের সাক্ষী এই ময়দান । বসন্তের মনোরম পরিবেশে আন্দোলিত হতে হতে আমি দেখছিলাম সে সব । দেখছিলাম বই- প্রেমিক মানুষদের । কলকাতা বইমেলার প্রথম ষুগে মেলায় বই ছিল প্রথম ও শেষ আকর্ষণ । পরে তার পরিবর্তন হয়েছে । সেখানে চিত্রকরদের সমাবেশ হয়েছে । খাবারের স্টল বসেছে । আরও কত কি ! প্রথম যুগের মেলায় লেখকরা ঘুরে বেড়াতেন মেলায় । ভক্ত পাঠকদের সঙ্গে তাঁদের সহজ যোগাযোগ হত ।
আমি অনেক ঘটনার সাক্ষী । সব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে । তাই গুটি কয়েক ঘটনার কথাই বলি । ১৯৮৩ সাল । মোহরকুঞ্জে মেলায় এসেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোককুমার সরকার । হার্ট অ্যাটাক হল তাঁর । তাতেই মৃত্যু । তাঁর স্মৃতিতে পরের বছর অশোককুমার স্মৃতি বক্তৃতা চালু হল । ১৯৮৪ সালে জেনিভার ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্সের সদস্য হয়ে ক্যালকাটা বুক ফেয়ার আন্তর্জাতিক ক্যালেণ্ডারে স্থান করে নিল । ১৯৯১ থেকে শুরু করল থিম । ১৯৯৭ সালে ঘটল ভয়ংকর ঘটনা । খাবারের দোকান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে লণ্ডভণ্ড করে দিল মেলা । তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোল করে তিন দিন পর আবার শুরু হল মেলা । বিশ্বাস করো আগুন যখন তার লেলিহান শিখা বিস্তার করছিল , তখন আমি চিৎকার করে সতর্ক করার চেষ্টা করছিলাম ।কিন্তু তোমাদের মতো আমার তো ভাষা নেই , স্বর নেই । তাই কেউ আমার কথা শুনতে পায় নি । পরের বছর প্রবল বৃষ্টিতে বহু বই নষ্ট হয়ে যায় । সে বারেও কেউ শুনতে পায় নি আমার আর্তনাদ ।
একবার বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশ নিয়ে মেলায় খুব গণ্ডগোল হয় । তিনি ধর্মের অবমাননা করেছেন বলে একদল মানুষ প্রতিবাদ করেন । বইমেলা কর্তৃপক্ষ তাই তাঁর বই রাখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন । তখন আমার ,মনে হয় এ যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ । রনু গুহ নিয়োগীর একটি বই নিয়েও বইমেলার মধ্যে একদল মানুষ প্রতিবাদী মিছিল বের করেছিল ।
বহুদিন ধরে ময়দানই ছিল আমার ঘর । পরিবেশ দূষণের প্রশ্নে কলকাতা হাইকোর্ট ময়দানে বইমেলা নিষিদ্ধ করেন । সেটা ২০০৭ সাল । তখনকার মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারকে ‘বইএর বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আখ্যা দেন । বিভিন্ন লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা হাইকোর্টের নির্দেশিকার প্রতিবাদ করেন এবং এক প্রতীকী বইমেলার আয়োজন করেন । ময়দান ছেড়ে যেতে হবে বলে আমারও কষ্ট হচ্ছিল । কিন্তু আমার জন্য বহু মানুষের ক্ষতি হলে সেটাও তো মেনে নেওয়া যায় না । আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বিধাননগরের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন সংলগ্ন মাঠে । পার্ক সার্কাস মাঠে বইমেলার আয়োজন ব্যর্থ হয় । সেখানকার নাগরিকরা প্রতিবাদ করেন । সরকার ও গিল্ডের সহযোগিতায় কলকাতা পুস্তক মেলার বদলে আয়োজন করা হয় ‘বইমেলা ২০০৮’ । তারপর মিলন মেলা ঘুরে আমার স্থায়ী ঠিকানা হল সেন্ট্রাল পার্ক । এ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই ঘোষণা করে দিলেন ।
এবার সেই স্থায়ী ঘরে বসে আমি স্মৃতিচারণ করব । আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব , বইমেলায় ভিড় হলেও মানুষের পড়ার অভ্যেস কতটা বেড়েছে , রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলি কত বই ও কি ধরনের বই কিনছে । কারণ এ সব প্রশ্নের উপর নির্ভর করছে আমার অস্তিত্ব ।